Ameen Qudir

Published:
2018-05-04 17:43:48 BdST

'আমার পিতৃত্ব' : এক ডাক্তার পিতার জীবনের পাতা থেকে


 


ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

_______________________________________

আমার পিতৃত্ব।।
বিয়ের পরে ই স্বাভাবিক নিয়মেই আসে পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব। আমারো তাই ই। আমার সন্তানের মা র নানান পরীক্ষা করে নিদেন দিলেন ডাক্তার দিদি, আমি বিয়ের দু বছরের দু মাস আগেই পিতা হতে চলেছি।
প্রথমটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলুম। অবশ্য শুঁড় টানলে যে মাথা আসবেই, এটি শাশ্বত নিয়ম। আমিই বা কোন কেউকেটা যে ব্যতিক্রম হবে! সত্যি বলতে ব্যতিক্রম চাইনি আমাদের কেউই।
তবে যিনি গর্ভে এলেন প্রভূত গর্ব করে তিনি বিস্তর ভোগালেন তাঁর গর্ভধারিণী কে। নাহ, তিনি নিজেও ভুগলেন অবশ্যই, কিন্তু পরে দেখলুম সে সব তাঁর স্মরণে নেই। যাক নিশ্চিন্দি।
তাঁর মায়ের প্রবল জ্বর হলো মাঝে। কাঁপুনি আর জ্বর। তখনো ডাক্তারবাবু অ্যালকালি মিক্সচার বিনে কিছুটি দিতেই রাজী নন। অনেক দিন আগে অবশ্য। ১৯৯২। আমি ৩২+ । এদিকে ভিডাল পজিটিভ এলো আর জ্বর কমার নাম টি নেই।
একদিন গেল।
দুদিন গেল।
জ্বর বেড়েই চলে, আর কাঁপুনি। সিপ্রোফ্লক্সাসিন তখন ওষুধ টাইফয়েডের। কিন্তু অন্তস্বত্তা মা কে দেওয়া বোধকরি বারণ। দু -- তিন জনের মত নেওয়া হলো কিন্তু ধন্দ কাটলো না। তখনো গুগল আসে নি।
আতান্তরে পড়লুম যাহোক।
৮৫ তে হাউস স্টাফ শিপ শেষ করেছি।
চাকরি করি না। করবো না এমন এক টা ভাব।
নিজেই সিদ্ধান্ত নিলুম।
সিপ্রো ই দেবো। আর বাড়ীতে রেখেই।
যা হবে, হয় যদি কিছু, দেখা যাবে।
বাবা চলে গেছেন আমার ২৭ বছর বয়সে।
মা আছেন। মাও চিন্তিত,উদ্বিগ্ন।
৭২ ঘন্টা পরে জ্বর একটু যেন ল্যান্ডিং করবে, এমনতরো ভাব।
তারপরে সত্যি অত্ত জ্বর এক্কেবারে নেই হয়ে গেল।
চিন্তা রেখে গেল একরাশ।

দিন, সপ্তাহ, মাস পার হয়। সন্তান ফুটবল খেলছে জেনে পুলক লাগে বটেক।
আর সব পরীক্ষা ঠিক ঠাক, শুধু হবু মায়ের হিমোগ্লোবিন টা কম।
এরপরে বড় ডাক্তারবাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন
উলত্রাসনোগ্রাফি করতে হবে।
ডাক্তারবাবু প্রি পোজিশান দেখবেন।
একটি মারুতি ভ্যান নিয়ে চললুম সিঁথিমোড় -- মেডিকেভ। তখনো এতো উলত্রাসনোগ্রাফি র মেশিন শ্যামবাজার পার করে বসেনি তেমন।
খুব ধীর লয়ে ঘুম ভাঙছে শহরতলীর।
ডাক্তারবাবু যিনি উলত্রাসনোগ্রাফি করলেন, যেন একটু গম্ভীর মুখো হয়ে গেলেন।
কেন জানিনে।
এবারে বললেন, বাচ্চা যে চরকিপাক ঘুরছে।
নাকি ট্রান্সভার্স লাই। মানে,
সাধারণত মাথা নীচে থাকে,
অসাধারণত মাথা ওপরে থাকে,
ইনি আছেন আড়াআড়ি।
ট্রান্সভার্স মিথ্যে না কি বলে।
খুব মুশকিল ভাই -- ডাক্তারবাবু বলছেন।
আমি অবাক কেঅনো?
তিনি কহিলেন, বুঝেছ উপেন,
অস্ত্রোপচার করা ছাড়া গতি নেইকো।
এ আর এমন কি? অপারেশানের নামে কাঁপি না।
তিনিও কাঁপেন না।
অকুতোভয়।
সেই সাধ আহ্লাদ কি সব হলো দূর্গাপূজোর পরেই।
আমার মা, মানুষ টি বেজায় শান্ত।
মার অসুবিধের কথা বলতেন ই না কখনো।
এবারেও তাই ইতস্তত করছিলেন।
সেদিন যজ্ঞিবাড়ীর রাতে মা কিছু খেলেন ই না।
দুধ টুকুও না। মুখে শব্দ নেই কোন।
যা হয়, কিছু খাবার দাবার তো বাঁচেই, তার ভাগ বুঝিয়ে দিলেন হবু মা কে।
মেজোকাকীমা কে এই এই আর এই পায়েস দেবে।
ফুলকাকীমা কে এই এই আর এই মিষ্টি আর এই পায়েস দেবে। আমার তিন খুড়তুতো ভাই বোন।
আলাদা বাড়ি, কিন্তু মোটে কয়েকবছর পৃথগন্ন হয়েছি তো। আর আমার মা বড়ো।
মনে মনে পৃথগন্ন হইনি আসলে। মা হননি অন্তত।
সব রাতের ই শেষ হয়। সেই রাতেরো তাই।
ওমা, তুমি কথা বলছোনা কেন গো?
বরাভয় মুদ্রা দেখাচ্ছেন মা, অথচ স্পষ্টত ঘোর অসুস্থা।
ও মা,কি হয়েছে বলবে তো। ও মা। মা।
মার ডান পা আর নাড়াতেই পারছেন না।
কালকে তোদের বলিনি, কাজের বাড়ী তো।
আমার কাল থেকেই কুচকুচে কালো পায়খানা হচ্ছে।
বলোনি কেন গো, ও মা!
না, কাজের বাড়ি যে।
কতবার হয়েছে গো। মার আর হিসেব নেই।
আমি আমার পিসশ্বশুর কে ফোন করলুম।
বললুম সব।
বললেন অ্যাম্বুলেন্স বা ট্যাক্সি করে এখুনি নিয়ে এসো আনন্দলোক হাসপাতালে। সল্ট লেকে।
তাই ই। মা আর আমি। ট্যাক্সি। আনন্দলোক।
মেয়ের মা একা বাড়ি তে। ডেট লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে এগিয়ে।
আনন্দলোকে একজন কমবয়েসী ডাক্তার বললেন, চোখ টাও দেখেননি।
সত্যি দেখিনি। মাথা কাজ করেনি।
ওঁরা দেখালেন, প্যালর, এক্সট্রিম প্যালর। শাদা।
মায়ের আবার ও নেগেটিভ। ভারি রেয়ার গ্রুপ।
ভোরুকা ব্লাড ব্যাঙ্ক একবোতল ও দিতে পারলো না সকালে। মার হিমোগ্লোবিন ৩ কি ৪। রক্ত ভারী দরকার। সন্ধ্যেবেলা আসতে বললো।
এক বোতল রক্ত মিললো সন্ধ্যেবেলায়। হিমাক্সিল চলছে নাগাড়ে।
দেওয়া হলো এক বোতল। আরো একটা কাল মিলতে পারে। আমি বাড়ি ফিরলুম রাত করে। বাড়ি তে যে বাচ্চার মা, প্রায় ফুল টার্ম।
পরদিন সকালে আমার মেজ পিসেমশায় ( বাবারই বয়সী এবং আগে বন্ধু, পরে শালা ভগ্নীপতি।) আমাকে বললেন, তুই মিঠু কে ফেলে যাচ্ছিস কি বলে? কিছু দরকার হলে আমরা কি করবো বলতো ! যা নিয়ে যা, ওর পিসেমশায় পিসিমার কাছে সল্ট লেকে থাকুক।
পরদিন বাড়ি তালাবন্ধ করে আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী, ইয়ে সল্ট লেক পন্থী। মিঠুকে পিসশাশুড়ি র কাছে গ্যারাজ করে আমি সোজা আনন্দলোক। মায়ের হাত, মুখ, পা নড়ছে। কিন্তু ফ্যাটফ্যাট করছে শাদা, চোখ এবং প্রায় গোটা শরীর টাই।
একবার টি দেখেই আবার দৌড় ভোরুকা ব্লাড ব্যাঙ্ক। আমার সামনেই খুললো। তিনি কহিলেন, আর এক বোতল শীঘ্র মিলিবে।
করি ত্বরা নিয়ে এলেম সেই রক্তবর্ণ তরল।
চালানো হলো।
এবারে কারণ খোঁজা --- কেন এত মলিন, কেন এত মেলিনা।
মা ব্লাডপ্রেসার এর রোগিণী। বাঁ চোখে থ্রম্বোসিস হয়েছিল। দিশা খ্যাত ডাঃ দেবাশিস ভট্টাচার্য ইকোস্প্রিন ১৫০ দিয়েছিলেন। তখনো পি পি আই আসেনি। ফ্যামোটিডিন দিয়েছিলেন,কিন্তু ফ্যামোটিডিন অ্যাসপিরিন এর বীভৎস মুখ কে আটকাতে পারেনি। ম্যালিনা মলিন হয়ে গেলেন মা।
হিমোগ্লোবিন উঠলো ৬ তে। এবার কেন মা হলেন অমন মলিন। ডাঃ ওম তাঁতিয়া তখন সবে এন্ডোস্কোপি শিখে, এন্ডোস্কোপি করেন আনন্দলোকে।
আমার থেকে ঠিক সাত বছরের ছোট, মামাতো ভাই, মেডিকাল কলেজের সার্জারি র হাউস সার্জেন খবর পেয়ে এলো। আমার মা কে বললো --- মেজ পি ( মেজ পিসির সংক্ষিপ্ত রূপ) চলো তো মেডিকাল কলেজে। আমাদের এন্ডোস্কোপির নতুন যন্ত্র এসেছে।
ডি ও আর বি লিখে ট্যাক্সি নিয়ে মেডিকাল কলেজ। এন্ডোস্কোপি হলো। ওমা, কিছুটি নেই স্টমাক -- ডিওডেনাম এ। আলসার তো নেই ই , ইরোসান অবধি নেই। রক্তাক্ত হয়েছিলেন মা, এখন আর চিহ্ন টিও নেই। দেবুর খুব প্রিয় স্যার ডাঃ মামুন একবার ক্লিনিকালি দেখলেন। সব নর্মাল।
এই ডাঃ মামুন ভারি সুগৌর সুপুরুষ। লম্বা। বেকবাগান অঞ্চলের খানদানি বাঙালি বংশ। চিফ জাস্টিস আলতামাস কবির এনাদের ই জ্ঞাতি।
মাকে নিয়ে ফিরলুম বাড়ি। ডেক্সরেঞ্জ, বেদানা, দুধ, মাছ, ছানা চললো ঘন্টা ঘন্টায়।
মা ৬ থেকে ৯ হিমোগ্লোবিনে পৌঁছে গেলেন কয়েক দিনেই। অবশ্য খুব দূর্বল।
আমার পিতৃত্ব কাহিনী আগামীকাল।।
মাফ করবেন। আজ চলছেনা আর আঙুল।
প্রমিস। কালকেই। শুক্রবার।।
___________________________

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
সুলেখক । কবি।

Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC)

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়