Ameen Qudir

Published:
2018-05-04 17:26:18 BdST

নির্জন সৈকতে লাশ হয়ে পড়ে থাকা কিশোরীর আত্মকথা


লেখাটি লেখকের ভাষ্য মতে; "প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক,মিল খুঁজে পেলে কাকতালীয় ।"  প্রতিকী ছবি ব্যবহার করা হল। ছবির চরিত্র বা মডেল বাংলাদেশ বা পশ্চিমবাংলার নন। বা/স।




ডা. শরীফুল আলম রুবেল
____________________________

আত্মার_আত্মকথা

আমি আজ সকালে মারা গেছি। ঠিক সকাল বললে ভুল হবে,আসলে সকালে আমার মৃতদেহটা উদ্ধার হইছে। সকালে ওরা আসছিল দোকান খুলতে,তখন দেখে আমি উপুড় হয়ে পড়ে আছি,এলাকার কাউন্সিলরকে জানানো হল,ফোনে ফোনে অনেকে জানল,পুলিশে খবর দিলেন কর্তা ব্যক্তিরা। দুপুর নাগাদ তারা এসে তদন্ত করে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্য ‘মর্গে’ পাঠালেন। “সকল অপমৃত্যুর ময়না তদন্ত হবে”—এরকমই কে বলতেছিলেন। আত্মারা সব শুনে।

প্রথমে একটু ঘাবড়েই গেছিলাম, এভাবে পাজামা ছাড়া পড়ে আছি,সেলোয়ারটা ও ঠিকঠাক নাই। যাক বাবা,উপুড় হয়ে পড়ে আছি তাই লজ্জাটা কিছু কম হচ্ছে। আর মানুষ ও কেমন পাজী,আরে ভাই আমি তো মারাই গেছি; আগে আমার কাপড় ঠি ক করে দিবি না ! তা না তোমরা শুরু করলা ভিডিও করা। অবশ্য অপমৃত্যু বরণকারীর দেহে হাত না দেয়াই উচিত,পড়ে পুলিশ ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাবে আর বারোটা বাজবে। পুলিশে ছুঁলে ১৮ ঘা।এখন আমার সব ছেলেবন্ধুর জন্য বিপদ হল,পুলিশ ১৮ ঘা বসাইবেই। আমার তো কাউকে সাহায্য করার জো নাই,আপাতত আমার মৃতদেহের সাথে সাথে যাচ্ছি হাসপাতাল ‘মর্গে’।

আমার দেহটা পড়ে আছে মর্গের শক্ত টেবিলের উপর। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার পুলিশের কাগজপত্র দেখে নিচ্ছেন। ডাক্তারের চেহারাটা পরিচিত লাগছে,আরে ইনি তো আমাদের এলাকায় একটা ক্লিনিকে ডিউটি করতেন। ২ বছর আগে,ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় রাত্রে সে কী জ্বর,মা-বাবা বৃষ্টির রাতে,গাড়ীর ড্রাইভারকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ঐখানে নিয়ে গেছিলেন। ডাক্তারকে হাঁকডাক দিয়ে ঘুম থেকে তুলে আমাকে দেখতে বললেন,উনি লিখে দিলেন টয়লেটের রাস্তায় “ঢুস” দেয়ার জন্যে। কী লজ্জা যে লাগছিল,একজন পুরুষ ডাক্তার এটা দিবেন ভেবে ! কীন্তু না , পরে একজন নার্স এসে দিয়ে গেলেন,তা ও কম লজ্জা তো লাগে নি। হ্যা, এইজন্যেই তো ডাক্তার সাহেবের চেহারাটা পরিচিত ঠেকছে। আচ্ছা,উনাকে বলে দেব না কী পুরা ঘটনাটা,আদ্যোপান্ত তো আমার জানা। কীভাবে সন্ধ্যার সময় আমার সিএনজি আটকানো হল,শহর থেকে বাইরে ‘পতেঙ্গায়’ নিয়ে গেল ওরা,কোনদিন যা কল্পনাও করিনি আমার সাথে তাই হল। কত রাত পর্যন্ত বাইরে কাটিয়েছি,বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতেই তো রাত ১১ টা বেজে যেত। ফেসবুক,ইন্সটাগ্রামে স্ট্যাটাস-কমেন্টে রাত ১ টা তো বেজেই যেত। আম্মু বকতেন,বিরক্ত হতাম। আব্বু ব্যস্ত ব্যবসা নিয়ে,তবে আম্মু একবার “সাইদের” সাথে এফ্যেয়ারের কথা বলে দেয়ায় আব্বু খেপেছিলেন। উনারে ঠান্ডা করতে ইন্সটাগ্রাম দিলাম বন্ধ করে। উনারা খুশী,আমি ও ফেসবুক চালাতে লাগলাম লুকিয়ে।

ডাক্তার সাহেব কাছে আসলেন,অনাবৃত সারা শরীরটা দেখলেন। উপুড় হয়ে ছিলাম বলে বুক,পেট,উরু লাল হয়ে আছে,’হাইপোস্টেসিস’ বলে নোট নিলেন। শরীরের প্রত্যেক জোড়া নেড়ে দেখলেন, ‘রিগর মর্টিস’ ডিসএপেয়ারিং লিখলেন। গলাটা লাল হয়ে আছে,পুলিশ-সাংবাদিক সবাই লিখেছে ‘ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করিয়া হত্যা’—-শুনে আমার হাসি পেল,আত্মারাও হাসে। সবাই বলত আমার হাসি খুব সুন্দর। ডাক্তার সাহেব ভালো করে খুঁজতেছেন গলার চামড়ার নীচে ‘শ্বাসরোধের লক্ষণ’। শরীরের নিম্নাঙ্গ ও দেখতেছেন খুঁটিয়ে,পুলিশ লিখেছে ‘ধর্ষণ করিয়া থাকতে পারে’ তাই এতো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।আমার ইচ্ছে হল বলে দিই,আমি কীভাবে মরলাম,কখন মরলাম,কেন উপুড় হয়ে পড়ে থাকলাম,কাপড়ই বা কেন এমন হয়েছিল,কিন্তু আত্মার তো মানুষের সাথে যোগাযোগ করার কোন সুযোগই নাই। ইন্টারনেটের এ যোগে এটা কোন কথা হইল !!

হ্যা,এখন মনে হচ্ছে ক্লু পাবেন,আমার খুলির ভেতরে ঊনি ঢুকতেছেন।আচ্ছা আমার স্বপ্নগুলা কী উনি দেখতে পাবেন ? আমার প্ল্যান-পোগ্রাম,রাত জেগে চ্যাটিং,হৈ হল্লোড়,বাবা-মার উপদেশে বিরক্তি এসব কী ঊনি বুঝতে পারবেন ? ঊনি কী সন্ধ্যায় অপহরণের সময় থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আমার মাঝে যে ভয়,বাঁচার আকুতি,কান্না,কষ্ট ছিল তা বুঝবেন ? ঊনি কী মৃত্যুর আগে আমি কতটা অপমানিত হয়েছি তা ‘ময়না তদন্ত রিপোর্টে’ উল্লেখ করবেন। মনে হয় সবই বুঝবেন, মেডিকেল সাইন্স কত আগাইছে। মৃত্যুর সময়,কারণ,ধর্ষণ হইছি কী না,রোগের উপস্থিতি,প্রতিটি অঙ্গের ভেতরগত অবস্থা এসব ব্যাখ্যা তারা দিতে পারলে এটা কেন পারবেন না ?

ময়নাতদন্ত শেষে আবার ঘরে এলাম। প্রচুর মানুষ হয়েছেন। আম্মুকে স্বান্ত্বনা দিচ্ছেন,আব্বু ভাব নিচ্ছেন শক্ত আছেন,আসলে উনার ও মন ভেঙ্গে গেছে। আমি মন ও পড়তে পারতেছি।আত্মারা দেখি অনেক সুবিধা ভোগ করে! আমার রুমটা এক চক্কর দেখে নেয়া দরকার,ক্লজেটের কাপড় গতরাত্রে যেমন রেখে গেছলাম তেমনি আছে,বিছানায় নতুন চাদর, চেয়ার-টেবিল ঠি কঠাক আছে। পুলিশ তো তদন্ত করার কথা,আল্লাই জানে পুলিশি জেরার মুখে কতজন পড়বে ? অথচ পাড়লে আমি ‘ওদের’ নাম,পরিচয় বলে দিতাম। ঘটনার পুরা বর্ণনা আমার চেয়ে ভালো আর কে বলতে পারবে।কে বুঝবে ‘সেলোয়ার ছাড়া,উপুড় হয়ে’ মরে পড়ে থাকার কী কষ্ট; আমি ছাড়া। আমার চেয়ে ভালো ভয়,যন্ত্রণা,ব্যথা,মৃত্যুর বর্ণনা আর কেউ দিতে পারবে না।থাক এসব, এখন অনন্তের পথে যাত্রার সময়,মর্ত্যবাসী গবেষণা করুক আমাকে নিয়ে। আমি যন্ত্রণাবিহীন,দীর্ঘ,নিরন্তরের সান্নিধ্যে চললাম। যেখানে মৃত্যুভয়,ব্যথা,যন্ত্রণা নাই।

(প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক,মিল খুঁজে পেলে কাকতালীয়)
_____________________________
ডা. শরীফুল আলম রুবেল। সুলেখক। আলোকচিত্রী।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়