Ameen Qudir
Published:2018-04-17 15:07:51 BdST
"দেখলেন ডাক্তার সাব?আপনার কম্পাউন্ডার আপনার খাইয়া, পইড়া আমার গোলামি করে"
ফাইল ছবি। সংগৃহীত।
ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন
_____________________________________
"স্যার,উনি বিরাট সাধু।"
কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো আমার এসিস্ট্যান্ট ছেলেটা।আমাকে সে এক সাধুবাবার আশ্রম দেখাতে নিয়ে এসেছে।আমি এই এলাকায় নতুন এসেছি,একটা এনজিও'র আন্ডারে।এই অজ পাড়াগাঁয়ে আমার আজ সপ্তম দিন।আমার কাজ তেমন কিছু না,সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত রুগী দেখা,আর তারপর কিছু অফিসিয়াল কাজ সেরে দেয়া।এইটুকুই,সব কাজ গোছাতে গোছাতে আমার বড়জোর চারটা কি সাড়ে চারটা বাজে।এর মাঝেই দুপুরের খাবার সেড়ে ফেলি,একলা মানুষ,বাসায় যেয়ে রান্নাবান্না কে করতে বসবে?ও ভালো কথা,নিজের পরিচয়টাই তো।দিলাম না,আমি রাশেদ,ডক্টর।পাশ করেছি আজ প্রায় চার বছর হলো,শহরের কোলাহল আমাকে একেবারেই টানে না,তাই এই চাকরীর অফার পাওয়ামাত্র লুফে নিয়েছি।বিয়ে থা করিনি,বাবা মা ভাই ঢাকা ছাড়বেন না,তাই একাই চলে এলাম এখানে।
আমার এসিস্ট্যান্টের নাম মোকলেস,মোকলেস মিয়া।ছোটখাটো গড়নের ছেলেটাকে ঠিক এখনো বুঝে উঠতে পারিনি,কেমন যেন সবকিছুতেই অত্যুৎসাহি।অতিরিক্ত এবং অতিরঞ্জিত কথা বলা মনে হয় ছোটবেলার অভ্যাস।মাঝে মাঝে মনে হয় খুব সরল দিলখোলা মানুষ,আবার মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলে বসে যে অবাক হয়ে যাই,এই ছেলে এইসব কথা ভাবলো কেমন করে।তখন তাকে খুব কুটিল স্বভাবের একজন মনে হয়,যার মনে ইয়া বড় বড় জিলেপির প্যাচ।
সাধুর কথা বলার সময় তার গলার স্বর যেভাবে বিনয়ে মিইয়ে এলো,অবাক লাগলো।এতো সম্মান আর শ্রদ্ধা তো কারো গলায় এমনি এমনি আসে না।ঘটনা কি?
'দূর,কিসের সাধু।সব বুজরুকি।এখানে পেয়েছে সব অশিক্ষিত,বোকা,সহজ সরল মানুষ,দু চারটা চমকে দেয়া কথায় সবাইকে ভড়কে দিচ্ছে।আসলে খবর নিয়ে দেখো,এক নাম্বার ভন্ড।'
জিবে কামড় দেয় মোকলেস।
"ছি ছি স্যার,ও কথা মুখেও আনবেন না।আমাকে বলছেন বলছেন,আর কাউকে বইলেন না।একেবারে দক্ষযজ্ঞ বেধে যাবে।আকি এই এলাকায় আজকে সাত বছর ধরে আছি স্যার,আমিও ঢাকার ছেলে,শুধু বুজরুকি হলে কি আমি কিছু ধরতে পারতাম না?উনি আসলেও সাধু স্যার,উনার বিরাট পাওয়ার।"
মোকলেসের কথার ধরণে হেসে ফেললাম।
'আচ্ছা,কি পাওয়ার শুনি?'
"স্যার,উনি বাজা মহিলাদের চিকিৎসা দেন।উনার কেরামতিতে কতো বাজা মহিলা যে মা হইসে,আপনি জানেন না স্যার।"
'কি বলো?সত্যি?সবাই মা হয়েছে?কেমন করে সম্ভব?'
"সবাই কি আর হইতে পারে স্যার?দোষ লাগা মাইয়াগুলা হইতে পারে না।সাধুবাবা সবাইরে চিকিৎসা দেন,শুধু দোষ লাগা মেয়েগুলার তাতে কোন উপকার হয় না।সাধুবাবা পাক পবিত্র মানুষ,উনার কাছে পাপী মানুষের ঠাই নাই।"
'বাহ,ইন্টারেস্টিং।একবার তো যেতে হয় তোমার সাধুবাবা দর্শনে।কিন্তু আজ না,অন্য কোনদিন যাবো।এখন চলো যাই,সন্ধ্যা হয়ে আসছে।'
পরের পুরো সপ্তাহেও আর সময় করে উঠতে পারিনি।নতুন কাজ,গুছাতে সময় লেগে যাচ্ছে।নতুন নতুন কাজ আসছে,নতুন দায়িত্ব।
সেদিন সকালে রোগী দেখছি।এখানকার মানুষের রোগ মোটামুটি সাধারণ।জ্বর,ঠান্ডা,সর্দিকাশি, গলা ব্যাথা,পেটে ব্যাথা-মোটামুটি এর মাঝেই সবার অসুখ ঘোরেফেরে।এর মাঝেই সেদিন ভিন্ন এক সমস্যা নিয়ে হাজির হলো তহুবন।
একুশ বাইশ বছর বয়সী হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটা,শ্যামলা,শরীরে অপুষ্টি আর ময়লা শাড়িটায় দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট।
চোখ তুলে তাকাতেই কেমন ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে বললো,
"স্যার,আমি বাজা মাইয়া মানুষ দেইখা আমার সোয়ামী আমারে তালাক দিবো কইসে।আপনি আমারে চিকিৎসা করেন,আমারে একটা বাচ্চার ব্যবস্থা কইরা দেন।আমার বাপ মা কেউ নাই,আমারে বাইর কইরা দিলে আমি কই যামু?"
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাপাতে লাগলো তহুবন।জানতে চাইলাম,
'কতোদিন হইলো বিয়ে হইসে?এর আগে কাউকে দেখাও নাই?'
"বিয়া হইসে আইজকা ধরেন চাইর বছর হইবো।কতো চেষ্টা করলাম,কতো ঝাড়ফুঁক,তাবিজ কবজ নিলাম,শিকড় বাকড় খাইলাম,কই কি হইলো?এখন আপনি মেডিকেল পাশ দেওয়া ডাক্তার,আপনি আমারে বাচ্চা আইনা দেন।"
এই পাগল বলে কি?আমি কি বাচ্চা এনে দেবার মালিক নাকি?আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো,পেছন থেকে মোকলেস আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"ওই মাইয়া,তুমি সাধুর কাছে যাও নাই?এতো কিছু না কইরা শুধু সাধুর কাছে গেলেও তো হইতো।"
এই কথা শোনামাত্র চোখ জ্বলে উঠলো মেয়েটার।
"সাধুরে নিয়া একটা কথা কবি না চামচার বাচ্চা।যা ভাগ এইখান থেইকা।তুই এইখানেও ওর চামচামি করস?স্যার আপনি ওরে যাইতে কন।যাইতে কন কইলাম।"
পরিস্থিতি খারাপ হবার আগেই আমি মোকলেসকে বিদায় করলাম।এর পর যতো যা ই জিজ্ঞেস করি,তহুবনের মুখে আর কোন কথা নাই।মুখ গোজ করে রেখে দিলো তো দিলোই।পরের দিন আসতে বলে বিদায় করে দিলাম।
পরের দিন পার হলো,তার পরের সপ্তাহটাও,তহুবনের খবর নাই।যখন আবার দেখা হবার আশা ছেড়েই দিসি প্রায়,সেইদিনই প্রায় সতেরো আঠারো দিন পরে তহুবন আবার আসলো।এইবার তার চেহারা আরো মলিন,আরো বিপর্যস্ত।
'কি ব্যাপার,তোমার না পরের দিন আসার কথা ছিলো?এতোদিন কই ছিলা?'
কিছু না বলে হাতের উপর থেকে শাড়ি সরিয়ে দেখালো তহু।দেখে একেবারে শিউরে উঠলাম।পুরো হাতে মারের দাগ,কালশিটে পড়ে গেছে।বসতে বললাম।আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম কিভাবে কি হলো।
কাদতে কাদতে যা জানালো তহু,তার সারসংক্ষেপ এই,তার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির সবাই মিলে সেদিন রাতে তাকে সাপপিটানি দিয়েছে।কেন সে কাউকে কিছু না বলে ডাক্তারের কাছে গেলো এই অপরাধে।শুধু তাই না,তার তিনদিন পর তাকে আবারও একইভাবে মারা হয়েছে,এইবারের অপরাধ সে তার স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে দিতে রাজি হচ্ছে না।এই এতোদিন পর সে একটু হাটতে পারছে,তাই সে এসেছে আমার কাছে।
কি বলবো আমি?এইসব কি মানুষের কাজ?
'তহুবন শুনো,তোমার চিকিৎসা করার আগে তোমার কিছু বড় বড় পরীক্ষা করা দরকার।শুধু তোমার না,সাথে তোমার স্বামীরও।তাকে কি নিয়ে আসা সম্ভব?'
"না স্যার।হে আইবো না আপনের কাছে।তার কথা পুরুষ মাইনষের আবার কিয়ের দোষ?ওই বদমাইশ সাধুও তারে একই কথা কইসে।আসলে তো আমি জানি,সাধু কেন কইসে এইসব।ওই ব্যাটা একটা ভন্ড,খাটাশ।"
রহস্যের গন্ধ পাই তহুর কথায়।
'আচ্ছা তুমি এমন ক্ষেপে যাও কেন সাধুর কথা শুনলেই?গ্রামের সবাই যেখানে তার ভক্ত,শুধু তুমিই তারে দেখতে পারো না দেখলাম।কেন বলতো?'
"স্যার ওয় একটা হারামীর বাচ্চা হারামী।ওই হারামী কি করে জানেন স্যার?যেইসব বাজা মাইয়াগুলা আসে,সবগুলার সাথে ওয় মেলামেশা করে।করার আগে সবগুলিরে কি জানি একটা খাওয়ায়,খাইলে পড়ে মাইয়াগুলা মরার মতো হইয়া যায়,বেবোধ হইয়া পইড়া থাকে।আর ওই খাটাসের বাচ্চা তখন মাইয়াগুলার সর্বনাশ করে।পরে ভয় দেখাইয়া কয়,এই কথা কাউরে কইলে সবাইরে বইলা দিবে তার যে সর্বনাশ হইসে,তারে মাইরা ফেলবে।এইসব কথা কেউ জানলে সেই মাইয়ারে কেডায় ঘরে রাখবে কন?আর সাধুরে সবাই খুব মানে,তারে অবিশ্বাস করবো কে?তাই কেউ কিছু কয় না ভয়ে।আর লাভের মধ্যে লাভ,যেইডির জামাইয়ের জন্য বাচ্চা হয় না,তাদের বাচ্চা আসে পেডে।ঝামেলা বাড়াইয়া আর কি করবো?সবাই চুপ মাইরা থাকে।"
বলে কাদতে থাকে তহু।আমি বিহ্বল হয়ে বসে থাকি।কি শুনলাম এইটা?তহু আবার বলতে শুরু করে,
"আমারেও লইয়া গেসিলো আমার সোয়ামী ওই হারামীর কাছে।আমি তো কিছুই জানতাম না,আমারেও খাওয়াইসিলো সেই নেশার পানি।কি কমু স্যার,গন্ধ।মুখে যাইতেই বমি কইরা দিসি।তবুও কি ওই হারামী ছাড়ে?পরে জোরাজুরি শুরু করসে।আমি তখন কইসি আমার শরীর বন্ধ।কুত্তার বাচ্চা তারপর আমারে ছাড়সে।আর আমারেও একই ভয় দেখাইসে,কাউকে যেন না কই।পরে বাইরে আইসা আমার সোয়ামীরে সে কি গালি,শরীর বন্ধের সময় কেন আমারে ওর কাছে নিয়া আসছে।শরীর বন্ধ মাইয়া নাকি নাপাক,আমারে ছুইয়া নাকি ওয় অপবিত্র হইয়া গেসে।কত্তোবড় জানোয়ারের বাচ্চা।"
প্রচণ্ড রাগে আমার তখন দিশেহারা অবস্থা।এই আধুনিক সময়েও তাহলে এমন হয়?ছিঃ
রাগ সামলে বললাম,
'এই একটা মানুষ,এতো বড় ভণ্ডামি বছরের পর বছর করে যাচ্ছে,কেউ কিছু জানতেসে না,কেউ কিছু বলতেসে না?এইটা কি করে সম্ভব?'
"কেউ জানবো না কেন,অনেকেই জানে।জানলে কি হইবো,ওই যে,ডরায়।আর যারা কইতে যায়,তারা আর কওয়ার অবস্থায় থাকে না।সবডিরে মাইরা ফেলায় ওই হারামী।মাইরা দোষ চাপায় খারাপ বাতাসের,জীনের উপরে।পেত্যেকবছর সামনের নদীতে দুই চারডা লাশ ভাসে স্যার।কেউ কিছু কয় না,ভয় পায় সবাই স্যার ওরে।পচ্চুর ডরায়।"
পরের দিন,বিকাল।মোকলেসকে নিয়ে যাচ্ছি সেই সাধুর ডেরায়।সারা রাত ঘুমাতে পারিনি,অসহায় রাগে আর ক্ষোভে।মোকলেস আমাকে বাইরে বসিয়ে ভেতরে যায় সাধুর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে।পাক্কা এক ঘন্টা পর ডাক পড়ে আমার।
ভেতরটা প্রায় অন্ধকার,কেমন যেন আলো আধারীর খেলা চলে সারাক্ষণ।কিন্তু এই সামান্য আলোতেও ডেরার চাকচিক্য ঠিকই বোঝা যায়।বাইরের প্রচন্ড গরম এখানে অনুপস্থিত।কেমন ঠাণ্ডা একটা ভাব।যে সোফায় বসলাম,অনেক ধনী ব্যক্তির বাড়িতেও থাকে না।
"কেমন আছেন ডাক্তার সাব?আপনারে অনেক উত্তেজিত মনে হইতাসে?এতো অস্থির কেন আপনি?"
চমকে উঠলাম।কি করে জানলো?সামলে নিয়ে বললাম,
'কই,তেমন কিছু না তো।এই গ্রামে আছি,কিন্তু আপনার সাথে পরিচয় নাই।তাই পরিচিত হতে আসা।'
হা হা করে হেসে উঠলো লোকটা।মাথা নাড়তে নাড়তে বললো,
"না ডাক্তার সাব,আপনি খালি পরিচিত হইতে আসেন নাই।আপনার চোখ অন্য কথা বলতেসে যে।আরে বলেন বলেন,মন খুইলা বলেন।কতো মানুষরে সারাইয়া দেই,আর আপনার মনের অস্থিরতা সারাইতে পারবো না সেইটা তো হয় না।"
'আরে না না,আমি মোটেও অস্থির না।আসলে এসেই শুনলাম আপনি নাকি নিঃসন্তান মেয়েদের চিকিৎসা করে ভালো করে দেন।আর আমিও যেহেতু চিকিৎসক,বলতে পারেন সেই আগ্রহেই আশা আর কি।একটু জানলাম আপনার চিকিৎসা পদ্ধতি।লাগলে আমিও কাজ লাগাইতে পারতাম হয়তো।'
অট্টহাসিতে ফেটে পরলো সাধু।অন্ধকারে তার সাদা ধবধবে দাত মুগ্ধ করলো আমাকে।এতো সাদা দাত মানুষের হয়?
"ডাক্তার সাব,আপনি সেইটা জানতে আসেন নাই।আপনি আসছেন আপনারে তহুবন যেইটা কইসে সেই খবরটা যাচাই করতে,ঠিক কইলাম কি না?"
এইবার পুরো ঘাবড়ে গেলাম।আশ্চর্য,এই কথা সাধু জানলো কেমন করে?আমি তো তহুর সাথে কথা বলেছি আমার চেম্বারে বসে,সেই কথা তো কোনভাবেই তার জানার কথা না।তাহলে কি তহুই....
আমার বিস্ময় কাটার আগেই ভয়ানক শান্ত গলায় সাধু বলে উঠলো,
"কি ভাবেন?কেমনে জানলাম?আরে বোকা,আমার মাছির মতো চক্ষু,সবদিকে আমারে দেখতে হয়,খেয়াল রাখতে হয়।আপনি শিক্ষিত মানুষ,আপনারে বুঝ দেয়া যাইবো না,আর আমি।দিতেও যাবো না।যা জানেন সব ঠিকই জানেন,ঠিকই শুনসেন তহুবনের কাছে থেইকা।কিন্তু কি জানেন ডাক্তার সাব,এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।প্রমাণ দেখবেন?দাড়ান আপনারে প্রমাণ দেখাই।এই মোকলেস,কই গেলি?ওই হারামীর বাচ্চা,এইদিকে আয়।"
ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকলো মোকলেস।চোখ মাটিতে,একবারের জন্যেও আমার দিকে তাকাচ্ছে না।সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো আমার কাছে।কার থেকে কিভাবে সব জেনেছে এই বদমাশ সাধু।
সাধু এইবার উদার গলায় বললো,
"মোকলেস,ডাক্তার সাব যা শুনছে এইটা তুমি বিশ্বাস করো?বলো আমারে কি তোমার ভন্ড,লুইচ্চা মনে হয়?ভয়ের কিছু নাই,যেইটা মনে আসে সেইটা বলো।"
মোকলেস হাত কচলাতে কচলাতে বলে,
"ছি ছি বাবা,এইসব কথা মুখে আনা তো দূরের কথা,ভাবাও পাপ।আপনি কতো পবিত্র মানুষ,এইসব কাজ কি আপনার দ্বারা সম্ভব?"
হা হা করে ঘর কাপিয়ে হাসে সাধু।
"দেখলেন ডাক্তার সাব?আপনার কম্পাউন্ডার আপনার খাইয়া,আপনার পইড়া আমার গোলামি করে।কত্তোবড় নাফরমান।ওই যা তুই এইখান থেইকা।"
মোকলেস কে বিদায় করে দিয়ে এইবার আমার দিকে ফিরলো সাধু।
"আপনি বিশ্বাস করেন নাই,তাই না?আচ্ছা কইরেন না,দুই একজন বিশ্বাস না করলে কিছু হবে না।আপনি যান ডাক্তার সাব,শুধু এই নিয়া বেশি নাড়াচাড়া কইরেন না।"
কথাটা শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেলো।আমাকে হুমকি দেয়,কত্তো বড় সাহস!আমিও ঠান্ডা গলায় সাধুর চোখে চোখ রেখে বললাম,
'আমার অভ্যাস খারাপ সাধুবাবা।আমাকে কেউ কিছু না করলে আমি সেইটা আরো বেশি কইরা করি।কি করবো বলেন,ছোটবেলার অভ্যাস,যাইতে চায় না আর কি।'
কিছুক্ষণ চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আবার ঘর কাপিয়ে হেসে ওঠে সাধু।
"ওই ডাক্তার সাবরে পৌছাইয়া দিয়া আয়।ডাক্তার সাব আমার কথায় রাগ করছে।রাগ কইরেন না,রাগে বুদ্ধিনাশ হয়।আমার কথা না,শাস্ত্রের কথা।যান,আপনি যান।সাবধানে যাইয়েন।রাস্তাঘাট ভালো না।একে অন্ধকার,তার উপরে আবার জীনের উৎপাত।কতো দিক একা সামলানো যায় কন তো ডাক্তার সাব?"
রাগে দাত কিড়মিড় করতে করতে বেরিয়ে এলাম।মোকলেসের ছায়াও দেখলাম না আশেপাশে।সন্ধ্যা মিলিয়ে যাচ্ছে,একাই রওনা দিলাম।ভাবছিলাম,কিভাবে কি করবো।পুলিশের সাহায্য নিতেই হবে,বড় মামা আছেন পুলিশে,তাকেই আগে জানাতে হবে।লাগলে তহুকে নিয়ে যাবো সাথে করে,এর একটা বিহিত হওয়া খুব দরকার।
পরের দিন,ভোরবেলা।সামনের নদীর পাড়ে পুরো গ্রাম ভেঙে পড়েছে।কারণ আজ অনেকদিন পর নদীতে লাশ ভেসেছে।নিজেরা নিজেরা কানাঘুষা করছে,কিভাবে কি হলো সবাই নিজেদের মতো ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করছে।
এর মাঝেই মোকলেস প্রায় কাদতে কাদতে ধরা গলায় বলে উঠলো,
"ডাক্তার সাহেব অনেক ভালো মানুষ আছিলেন।আমার ফেরেশতার মতো স্যারটারে কেডা এমন করলো,কেমনে এই সব হইলো?কেমনে?"
পেছন থেকে গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ ভেসে আসে।সবাই সম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে পথ করে দেয়।ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সাধুবাবা।মাথা নেড়ে জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলে,
"জীনের আসর হইসিলো রে।আমার কাছে গতকাল যখন আসছিলো,তখনই বুঝছিলাম।এতো কইরা বইলা দিলাম,সাবধানে চইলেন।নাহ,শুনলো না,কিছুতেই শুনলো না।"
দূর থেকে এই দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে তহুবন।বোবাকান্না করা ছাড়া তার আর কি ই বা করার আছে....।
___________________________________

আপনার মতামত দিন: