Ameen Qudir

Published:
2018-04-08 15:44:04 BdST

স্বপ্নমৃত্যু : মেডিকেল শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে মর্মস্পর্শী কাহিনি


বিষন্ন সব স্মৃতি। এই তো জীবন। প্রতিকী ছবি। ছবির মুখ বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের নয়।

ডা. আমেনা বেগম ছোটন
___________________________

চারদিকে উৎসবের আমেজ। ক্যাম্পাসে লাইটিং করা হয়েছে। ঢাকা থেকে এল আরবি এসেছিল, উত্তাল অডিটোরিয়াম। ক্যাম্পাসে ইন্টার্ণ এন্ডিং প্রোগ্রাম চলছে।
এসব থেকে দূরে পুকুরপারে বসে আছে অমিত আর সায়রা। অস্বস্তিকর নিরবতা তাদের মাঝে।

--কেমন আছ অমিত? সায়রা জিগ্গেস করে।
-- ভাল, তুমি?
-- ভাল। আমি কাল ময়মনসিংহ চলে যাচ্ছি।
-- হ্যা, তা ত যেতেই হবে। তোমার ইন্টার্নি ত শেষ।
-- তুমি এই জুলাইতে এক্সাম দিবে?
-- হ্যা। দিই ত, প্রতিবার।
-- সিরিয়াসলি পড়ছ?
-- প্রথম দুবার পড়েছি। এখন মেডিসিন বই দেখলে বমি পায়। সায়রা, আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু বলতে চাও। বলে ফেল, হেজিটেট কর না।
-- তুমি কি জান আমি কি বলব?
-- হ্যা, শান্তিপুর্ণ ব্রেক আপ চাও, তাই ত। ক্ষমা টমা চাও নাকি? অমিত হাসে।
-- নাহ, ক্ষমা চাই না। তুমি নিজের খেয়াল রেখ।
-- রাখব। তোমার বিয়ের জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে? নাকি ঠিক হয়ে গেছে?
-- এখন আমি বিয়ে করব না।
-- পরে আর কেউ জুটবে না। ত্রিশ পার হলেই তুমি এক্সপায়ারড। অমিত হাসে।
সায়রা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। যাই অমিত।
-- যাও।

অমিত হোস্টেলের দিকে হাটতে শুরু করে। এক জায়গায় বেশিদিন থাকলে নাকি মায়া পরে যায়। তার মায়া পরে মায়া ফুরিয়েও গেছে। হোস্টেলে তার ব্যাচমেট রা মরাকান্না জুড়েছে। তাদের ছাত্রজীবন ইন্টার্ন, দুটোই শেষ। এই ক্যাম্পাস ছাড়তে তাদের কলিজা ফেটে যাচ্ছে।

অমিত দূর থেকে দেখে, তার ও এমন কলিজাফাটা দুখের সৌভাগ্য হতে পারত, হয় নি। মেডিসিন পরীক্ষায় প্রথমবার ভাইভাতে ফেল, দ্বীতিয়বার লংকেসে । এখন মার্চ, জুলাইতে আবার বসবে।
স্যারেরা কি শুনতে চাইছেন, এটা সে ধরতে পারে না।

সায়রা প্রথমবার এ পাশ করেছে। ইন্টার্ন শেষ করল।
ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল ফার্স্ট প্রফে। দুইজনে ফিজিওলজি তে ফেল করেছিল। প্রতি সন্ধ্যায় ক্লাসমেট রা স্টেথো ঝুলিয়ে ওয়ার্ডে যেত। দৃশ্য টা প্রতিদিন দেখতে বিরক্ত লাগত বলে শাখাওয়াত আর রিফ্লেক্স ( ফিজিওলজি গাইড) হাতে লাইব্রেরী তে চলে আসত। সায়রাও তাই। তখন তারা রিডিং পার্টনার হয়। মেডিকেল কলেজের আবহমান ঐতিহ্য থেকে তাদের মধ্যে প্রেম হয়ে যায়। প্রেম মানে একজন আরেকজনের সাথে সারাদিন লেগে থাকা। যা এখন হচ্ছে তা ভবিষ্যৎ এও থাকবে। উথালপাতাল লাভ স্টোরি বলে কিছু নেই।

পড়াশোনায় সায়রা খুব ডেডিকেটেড ছিল। অমিত কিভাবে পড়া মুখস্থ করবে সেজন্য নিজেই সব পড়ে ফেলত। পড়াত। পড়া নিত। মাঝেমধ্যে অমিত করুণ গলায় বলত, পাবলিক হেলথের ডেফিনিশন টা বাদ দেয়া যায় না?

তা সত্ত্বেও, ভাইভা বোর্ডে অমিত এক্সটারনাল এর প্যাচ খেলানো প্রশ্ন শুনে ভোম্বল হয়ে যেত। স্যারেরা দয়াপরবশ হয়ে ক্লু দিলে সব আরো গুলিয়ে যেত। নামের পাশে একটা এফ বসত, আর ৬ মাস হারিয়ে যেত জীবন থেকে।

অমিতের এইম ইন লাইফ ডাক্তার হওয়া ছিল কিনা সে নিজেও জানে না। নার্সারি থেকে লেখাপড়ার বোঝাই জীন আর ভাল রেজাল্টের লক্ষ্য তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, সেই দৌড়েই হাপাতে হাপাতে একদিন সে নিজেকে মেডিকেলে আবিষ্কার করেছে সে। বাবা মার প্রত্যাশার চাপ নিতে গিয়ে নিজে কি চাইত তাও কখনো ভেবে দেখে নি।

শান্ত ছেলে বলে অমিতের বেশ সুনাম ছিল। শান্ত হবার উপকারিতা সে তেমন পায় নি। বরং শান্ত ছেলে পেয়ে সবাই তাকে পেয়ে বসেছে। ছোটবেলায় একবার কান্না করাতে সবাই অবাক হয়ে বলেছে, এ মা, ছেলে হয়ে কাদে, কি লজ্জা। অমিত কান্না গিলে ফেলেছে। তার খুব স্বাধীন হতে ইচ্ছে করে, একদিন তার বয়সী এক ছেলে রাস্তায় মারামারি করছিল, ঠোট কেটে রক্ত পরছিল - সে মুগ্ধ হয়ে ছেলেটিকে দেখছিল। অথবা সেদিন রিক্সাওয়ালাকে দেখছিল বেশ করে চা আর বনরুটি খাচ্ছিল, ওরকম একটা প্রত্যাশাবিহীন জীবন হলে বেশ হত।

মেডিকেলে শান্ত ছেলে পরিচয় পরিবর্তিত হল গবেটে। তার চৌকস বন্ধুরা ঠাট্টাতামাসা করত তাকে নিয়ে, সায়রার বউ বলে ক্ষেপাত। ঘুমের মাঝে বেসামাল লুঙ্গীর ছবি ফেসবুকে দেবে বলে বিরিয়ানি খাওয়াতে হল ৫ জন কে। সদ্য কৈশোর পেরুনো বন্ধুরা বুঝত না, তাদের খেলা অমিতের জন্য কতখানি পীড়াদায়ক। ছাত্র রাজনীতির পক্ষ বিপক্ষ দু দল ই তাকে পিটিয়ে যেত, কেননা সে কারুর বিশ্বাসযোগ্যতাই অর্জন করতে পারে নি। অমিতের কাছে কোন প্রতিকার নেই।

এহেন গবেট প্রেমিক নিয়ে সায়রার ও লজ্জার সীমা ছিল না। কি দেখে এই গাধার প্রেমে পরেছে এ উত্তর তাকে প্রায়ই দিতে হত। তবুও সুপারি গাছ বাওয়ার মত কষ্টেসৃষ্টে তারা তিন বছর পার করল। ইন্টার্ন ও শেষ। সায়রা চলে গেল, অমিত জাতিকলের ইদুরের মত আটকা পরে গেল।

অমিত বাড়ি যায়। বাবা মার দুখিত দৃষ্টি দেখে হোস্টেল ফিরে। মেডিসিন বই নিয়ে থম ধরে বসে থাকে। সায়রা নেই, পড়িয়ে দেবার কেউ নেই। প্রফ ক্লিয়ারেন্স পেতে জুনিয়র দের সাথে ক্লাসে বসে। কানে আসে আদু অমিত নাম। সায়রার পরিত্যক্ত হবার সংক্্ষিপ্ত গল্প। প্রফ আসে, কিছু লিখে, উত্তর ভুলে গেলে জুনিয়র কে বিব্রত ভঙ্গী তে জিগেস করে, জুনিয়র স্টুডেন্ট না শোনার ভান করে। আদু অমিত কে উত্তর বলতে গিয়ে ধরা খাবার শখ নেই তার। গার্ড দিচ্ছিলেন শিক্ষক আসেন, ভৎসনার স্বরে বলেন এবারো কিছু পড়ে আস নি?

ক্লিনিকাল এক্সাম দূরে দাঁড়িয়ে দেখে, প্রাক্টিস করা হয় না। সংকোচে জুনিয়র দের বলা হয় না, আমার এক্সাম হচ্ছে কি না দেখবে? পরীক্ষা হলে আবার ডান বাম উলটা হয়ে যায়। লিভার পাল্পেশনে ইন্সপিরেশন এক্সপিরেশন এ হাতের তালে গণ্ডগোল বাধে, স্কলেরায় ইয়েলো কিনা বলা হয় না, ভাইভায় মুখে তালা লেগে যায়, কিচ্ছু মনে পড়ে না। অসকির এক্স রে শীটে চেস্ট ক্লিয়ার দেখায়, ডায়াফ্রামের নিচের অপাসিটি চোখে পরে না।

গোটা পৃথিবী তে অমিতের কথা শোনার ও কেউ নেই। তার যাবার ও জায়গা নেই। মাথানিচু, ঘরকুনো যুবক টিকে কেউ জিগেস ও করে না তার সমস্যা কি? মা বাবা অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে, এমন অদ্ভুত কুলাঙ্গার তারা কিভাবে জন্ম দিয়েছে? স্কুল কলেজে ত কিছু বুঝা যায় নি।

শেষবার পরীক্ষা দিল ৫ বছর জুনিয়র দের সাথে। খাতায় যা পারে লিখল, ৪০ নম্বর ছেড়ে দিল।
ভাইভাতে ডায়াবেটিস হাইপোর সাইনের বৈশিষ্ট্য জিগেস করাতে মাথানিচু করে রইল। ইন্টারনাল ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন তোমার ইয়ারমেট এখন এই ওয়ার্ডের আইএমও। আর তুমি ১১ বার প্রফ দিচ্ছ। আর ভাইভাবোর্ডে এসে আমাদের সময় নষ্ট করবে না। তুমি কিভাবে মেডিকেল এ চান্স পেলে সেটাই বুঝতে পারছি না।

অমিতের খুব ইচ্ছে হয় বলে, বিরাট ভুল হয়ে গেছে স্যার। চান্স না পেলেই ভাল হত। বলা হয় না।

ডাক্তারি করা ছাড়াও পৃথিবী তে হাজার, অযুত নিযুত মানুষ বেচে আছে। রাস্তায় গড়ানো হাত পা ছাড়া ভিক্ষুক ও আগ্রহ নিয়ে বেচে আছে, আছে বেশ্যার দালাল, পেশাদার খুনি, শিশু ধর্ষক । তবু অমিত মেডিকেলের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে দেখে না আসলে জীবন কেমন। দেখার আগ্রহ বা বেঁচে থাকতে চাওয়া টা ফি বছর দুইবার করে মেডিসিনের তিন পর্বের পরীক্ষার ভারে হারিয়ে গেছে।

পরীক্ষা শেষে, সবার মত অমিত ও বাড়ি ফেরে। মা ভয়েভয়ে জিগেস করে এবার কেমন হল পরীক্ষা?পাশ করবি ত?
অমিত হাসিমুখে বলে হ্যা মা, করব। মা চিন্তামুক্ত হন। বেডরুম এ সিলিং এ দড়ি টানায় অমিত। এই কাজ আরো ৩ বছর আগে করা উচিৎ ছিল।

( পত্রিকার খবর - প্রফে ফেল করায় মেডিকেল শিক্ষার্থীর আত্নহত্যা। তাকে এড়িয়ে চলা ৫ সেশন মেডিকেল স্টুডেন্ট আর দেশের আরো অনেকে প্রথম বারের মত অমিতের জন্য সত্যিকারের দুঃখিত হল। সায়রার খুব মন খারাপ, তার মেয়েটার গতকাল থেকে বমি, ডায়রিয়া। অমিতের জন্য একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ওরস্যালাইন চামচে নিয়ে মেয়ের পেছনে ছুটতে লাগল। )

__________________________________

ডা. অামেনা বেগম ছোটন
Studied at Sylhet M.A.G Osmani Medical College
Lives in Sydney, Australia

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়