Ameen Qudir

Published:
2018-04-05 16:58:41 BdST

সুখী দম্পতি : চিকিৎসক গল্পকারের লেখা অসাধারণ গল্প



চিকিৎসকরা অনেকেই লেখেন বিশ্বমানের সাহিত্য। অনবদ্য গল্প। তেমনই এক মনোগ্রাহী গল্প লিখেছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

____________________________

পরাণচাঁদের ছেলে মরণচাঁদ জন্মের সময়েই মা কে হারায়। ভোলা কবরেজ এর এক ফোঁটা সিদ্ধারিষ্ট মুখে পড়তেই কঁকিয়ে কেঁদে উঠে সদ্যজাত মরণ জানায় যে সে মরেনি।
অকালে পত্নীবিয়োগের তুমুল অসহ্য যন্ত্রণা অসহায় পরাণ সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঘনঘোর অনিচ্ছা র সঙ্গে সে আবার বিবাহ করে ফেলে। তার মাতৃহারা শিশুসন্তান কে মানুষ করার জন্যে সে সোনামুখী কেই বিবাহ করে ফেলে।
দুর্ভাগ্য বশত সোনামুখী পরাণচাঁদের বদলে ভালোবেসে ফেললো মরণচাঁদ কেই। পরাণচাঁদ কে তার তেমন পছন্দ হয়নি। আসলে গদাই বলে তার এক মনের মানুষ ছিলো। আদরে, প্রেমে সে ছিল সোনামুখীর গদু। ( নাহ্, লোদু নয়)। তা সোনামুখী র বাবা মা গদুর সঙ্গেই বিয়ের পাকা কথা সেরে ফেলে। কিন্তু কালোমেঘে বজ্রপাতের মতো এক ডাকাতি ও খুনের মামলায় সে ফেঁসে যায়, আর ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ৫ মাস হলে সোনামুখী নির্ঘাত অপেক্ষা করতো কিন্তু ৫ বছরের নাতিদীর্ঘ সময়ে নাতি জন্মালেও দীর্ঘ হয়ে যেত, আর সোনামুখীর প্রেম ও গ্রীষ্মকালে বাঁকুড়া জেলার সোনানুখীর মতোই শুকিয়ে গেল। তা ছাড়া পরাণচাঁদ পয়সাওয়ালা লোক,রেশন দোকানের মালিক আর বয়স ও বেশী নয়কো। ৩৫ মোটে।পুরুষমানুষের কিবা বয়েস। পরাণেরো সোনামুখী কে দেখেই উদোম পছন্দ হয়ে গেল। অবশ্যি গদুর কথা জানতো না।
বিয়েটা যে তাকে করতে হয়েছিল শুধুমাত্র সদ্য মা হারা সন্তানের জন্যে, এ কথা কোথাও বলতে সে ত্রুটি রাখেনি। তবে কিনা, সোনামুখী যে সেটি আক্ষরিক অর্থে নেবে, পরাণ কল্পনাও করতে পারে নি।
বিয়ের পাট চুকতে চুকতেই সোনামুখী ৩ মাসে মরণচাঁদ কে বুকে তুলে নিলে। রান্না আর খাওয়া বিনে বাকি সব সময়েই সোনামুখীর কোলে মরণচাঁদ। বাড়িতে এখন শুধুই ২+ ১/৪ জন লোক। পরাণের পিতামাতা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হবে।
দিনেরবেলায় বেশিটা সময় পরাণকে পরাণ দিয়ে কাজ না করলেও ব্যস্ত থাকতে হতো। মনটা মাঝে মাঝেই হা হা করে উঠতো নতুন বৌ এর জন্যে। বাড়ি তে থাকাকালীন সে চাইতো নতুন বৌ এর সঙ্গে একটু আমোদ আহ্লাদ করতে। কিন্তু সে সুযোগ তার আর মিলত কৈ? গদগদ হয়ে গদার মতোন কাছে এলেই সুন্দর মুখের মুখ ঝামটা শুনতো। ' সে কি দেকচো না ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছি '। যখনি পরাণের প্রাণ ছটফট করে উঠতো -- সেই একই সিন। হটাত করে বাড়ি চলে এলেও সেই এক কতা, ভদ্রমহিলার। ' তুমি কি গো, একটা শিশুর কতা তোমার মনেই থাকে না!ওকে আমি দুধ খাওয়াচ্চি আর এখন তুমি এসেছো আমাকে আদর করতে। বেহায়া আর কাকে বলে '। রাতে শোওয়ার সময় ও দুজনের মাঝে শুত ছেলে। আন্তর্জাতিক সীমা লঙ্ঘন করতে গেলেই জুটতো কখনো কখনোকখনো জুতসই খোঁচা আর খিমচানো, কতোবার নুনছাল উঠে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।
এ ভাবেই কাটছিলো দিন আর মাস।বছরখানেকের মাথায় সোনামুখীর মনে একটা পরিবর্তন এলো-- সে আর পরাণকে দূরে সরিয়ে দেয়না। পরাণের ভীষণ মনোকষ্ট আর রইলো না। মরণ ও মায়ের কোল ছেড়ে রীতিমত হামা আর টলটলানি হাঁটা শুরু করলে।
পরাণের প্রেমে সোনামুখীর শরীরে পুলকের শিহরণ বইতে শুরু হলো। পরাণ নিজেও ফিরে পেলে জীবনের মানে।
বেশ চলছিলো পরাণের ব্যবসা এবং দাম্পত্যজীবন। পুত্র মরণচাঁদ এখন রীতিমতো হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট পরে স্কুলে যায়।
নিরবচ্ছিন্ন সুখ খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এটাই বুঝি কালের ধর্ম। দু এক পিস ব্যতিক্রম হয়তো বা হয়। পরাণচাঁদ একদিন বসেছিল তার রেশন দোকানে। নিশ্চিন্ত। গত সপ্তায় ৩০ কিলো চাল আর ২৫ কিলো গম সে পাচার করতে পেরেছিল। মন টাও তাই ছিলো ফুরফুরে। হটাৎ ফোন এলো তার মোবাইলে। ভারি পুরুষালি গলা। -- ' রেশনের দোকান নাকি? আর মালিক পরণচাঁদ?, ২১০ নম্বর কালিকৃষ্ণ রোড, কলকাতা ১১২। ' পরাণচাঁদ হ্যাঁ বলতেই, --- হারামজাদা পরাণচাঁদ -- তোর যম গদাই ঢালি বলছি।
তারপরে একটানা --' জেলেতেই খবর পেলাম, তুই আমার পরাণেশ্বরী সোনা কে জোর করে বিয়ে করেছিস। তোর সাহস দেখে আমি শুধু না, আমার সাথী এমনকি জেলের পুলিশ রাও প্রায়ই প্যান্ট -- ট্যান্টে ইয়ে করে ফেলে, আর তুই পরাণচাঁদ। জেল থেকে বেরিয়েই সব হিসেব বরাবর করে নেব। পরে বলবিনা আমাকে জানায়নি।
ফোন টা আসা এস্তক, কেমন গা গুলিয়ে উঠে ঘেমে নেয়ে পরাণ একশা। মুখে কতাটি নেই। দোকানের কর্মচারী ফণি মন্ডল ও আতংকিত হলো খুব। সে দোকান বন্ধ করে, একটা রিকশা ডেকে,সঙ্গে করে বাড়ী পৌঁছে দিলে। দেরি না করে পরাণ বিছানাতে ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে শুয়ে পড়লে। আর তাকে দেখে শুরু হলো সোনামুখীর উদ্বেগ।
পরাণ শুধোলে --- তোমার ইয়ে গদাই জেল থেকে আমায় ফোনে শাসালো। তুমি তো কখনো বলোনি গদাই এর কথা।
সোনামুখী সঙ্গে সঙ্গে বললে, তুমি ভাবলে কি করে এগুনো সত্যি। খোকার কিরে, আমি আজ ই এই নাম প্রথমবার শুনছি। একটা জেলের আসামী আর আমি? তুমি বিশ্বাস করতে পারো। উফফ!!
সোনামুখীর কথা শুনে পরাণের বুক থেকে যেন একটা ভারি পাথর নেমে গেলো। উঠে বসে, এক গেলাস জল খেয়ে সে সোনামুখী কে বেশ একপ্রস্থ আদর টাদর করলে। সংসারে আবার শান্তি ফিরে এলো।
একদিন খবর কাগজে একটা খবর পড়ে, উল্লাসিত হয়ে পরাণ হাঁক পাড়লে, কৈ গো, একবার এদিকে এসো। আসতেই কাগজ টা মেলে ধরে বললে -- পড়ো তো। জেলেই কয়েদী দের মারপিট সামলাতে পুলিসের গুলিতে গদাধর ঢালি শেষ।
সোনামুখী কাগজ টা নিয়ে বাইরে বারান্দায় চলে গিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে অশ্রু বিসর্জন করলে, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে বললে ---, কি, এবারে খুশী আর নিশ্চিন্ত হয়েছ তো!
_______________________________

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
সুলেখক । কবি।
Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC)

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়