Ameen Qudir

Published:
2018-04-05 16:33:08 BdST

'এইয়ে না, বাক্কা অইছে: বাক্কা মজা অইছে। দানা ভাইঙছেনি? '


হালদা ছবির দৃশ্য। এখানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অনবদ্য ব্যবহার হয়েছে। ফাইল ছবি।


ডা. মোরশেদ হাসান
________________________

নোয়াখালিতে তরকারিকে বলে ‘ছালোন’। এরে, ছালোন বাক্কা মজা হইছে। আরেক্কানি দিবিনি আঁরে।
এই ‘বাক্কা’ শব্দের আরাম আপনি আর কোন ভাষায় পাবেন? ‘বাক্কা’ বলতে না পারলে তো নোয়াখালির মানুষের সর্বনাশ হবে।

বাক্কা মানে খুব ভালো বা সুন্দর।

কিশোরীকে জ্বালাতন করার পর মুহূর্তেই পিচ্ছিল কাদামাটিতে আছাড় খেয়ে মুখ বিকৃত করতে না করতেই কিশোর দেখল ছিপছিপে বেতের মতো তনুটি শুন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মুখের ভাঁজে ভাঁজে তৃপ্তি নিয়ে কিশোরী বলছে,
এইয়ে না, বাক্কা অইছে। বাক্কা মজা অইছে। দানা ভাইঙছেনি?

--চাটগাঁতে যেমন হিরা-জহরতের মূল্যেও তারা আপনাকে ‘কোয়াইশ’ শব্দ বলার আরাম থেকে এক বিন্দু ছাড় দেবে না, তেমনি নোয়াখালীতেও তা-ই। বস্তুত আঞ্চলিক ভাষার শব্দসম্ভার সেই অঞ্চলের অমূল্য সম্পদ।
‘বেচইন’ শব্দটি ফারসি। এর অর্থ অস্থির হওয়া। সাহিত্যে এর ব্যাপক ব্যবহার আছে।
জৈষ্ঠ্যের খরতাপে অস্থির হয়ে ঘরে ফিরে এলে আপনাকে এখানে যা দিয়ে হাওয়া দিয়ে স্থির করার চেষ্টা করা হবে তার নাম ‘বিচইন’ অর্থাৎ হাতপাখা।

এখানে মাথা হয়ে গেছে ‘কল্লা’, ঘাড় হয়েছে ঘেঁডি’, বিচি কলা >আঁইড্ডা কেলা, ভাপা পিঠা>ধুই হিডা, বাতাস>হা-বা।

ভোজ শব্দটি আরবি ‘দিয়াফত’ থেকে প্রমিত বাংলায় হয়েছে জেয়াফত। নোয়াখালিতে হয়েছে ‘জে-বত’। --এরে আইজকা তোর হুর (ফুফু) বাড়ি জেবত আছে। নোঁয়া শার্ট গাত দি যাইছ।
ফারসি ‘জেব’ হয়েছে পকেট। -- জেবে টেঁয়া-হইসা আছেনি, চাও না একবার। ওমা তুই আঁর দিকে রেনি রইছ কিল্লাই। জেবের দিকে না চাইবা।
‘রেনি’ মানে এক দৃষ্টিতে দেখা।
নোয়াখালীই একমাত্র বাংলা আঞ্চলিক ভাষা যার সর্বনামে জেন্ডার আছে। ছেলে হলে হ্যাতে, মেয়ে হলে হেতি। উচ্চারণে অর্ধস্ফুট ‘হ’ এর ছড়াছড়ি; প- বর্ণকে এখানে হ বলে এ তো সর্বজনবিদিত।

এটা ধরা হয় প্রায় এক কোটি মানুষ নোয়াখালির ভাষায় কথা বলে। বৃহত্তর নোয়াখালী ছাড়াও কুমিল্লার -- লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, চাঁদপুরের কিছু এলাকা, ভোলা, চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুন্ড ও সন্দ্বীপের মানুষ এ ভাষাটিকেই ব্যবহার করছে। সমুদ্র বন্দরের সুবাদে এ জেলার মানুষ ভাগ্যান্বেষণে হাজার বছর ধরে বিশ্বের নানান দেশে বিচরণ করেছে। আবার নানান দেশের মানুষও এ অঞ্চলে এসেছে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কোম্পানীগঞ্জের ‘যুগদীয়া’ আর সুধারামের ‘শান্তাসিতা’ বন্দর ছিল অন্যতম। জনযোগাযোগ ছিলো সারা বিশ্বের সাথে। লেনদেন হয়েছে নানান ভাষারও। এ অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে মিশে গেছে গ্রিক, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি, ল্যাটিন, পর্তুগিজসহ নানান ইউরোপীয় ভাষা। আর আরবি, ফারসি তো আছেই।

আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি উপভাষাকে ‘মূল ভাষা-দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মিলে যেমন দেহ, ভাষাও তেমনি কোনো দেশের জনসমষ্টির পূর্ণাঙ্গ দেহের সাথে তুলনীয়; আর উপভাষা হল দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদৃশ। প্রকৃত অর্থে উপভাষা ভাষা অপেক্ষা ভিন্ন নয়।
জার্মান পণ্ডিত ম্যাকসমুলারের মতে, ‘ভাষার স্বাভাবিক ও যথার্থ জীবন উপভাষায় পাওয়া যায়’। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষা এবং মাতৃভাষা এক কথা নয়। রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত রাষ্ট্রের প্রমিত বা সর্বজনবোধ্য ভাষা, আর মাতৃভাষা মায়ের মুখ থেকে শেখা ভাষা। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা পোশাকি এবং মাতৃভাষা আটপৌরে।

শেষ করে দিই একটি শ্লোক বলে,

আমে ভাতে মিলি গেলে
বারাগা ভেটকাই রইছে।
(আপনে আপনে মিল হয়। আর অপরের সাথে অমিল হয়।)
________________________________

লেখক ডা. মোরশেদ হাসান ।
Works at Medical College, Assistant Professor.
Past: Works at Ministry of Health, Maldives and ICDDR,B

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়