Ameen Qudir

Published:
2018-04-05 03:46:10 BdST

ক্ষমা করবেন রুকসানা


 

"ডাক্তাররা অদ্ভুত উন্নাসিক হয়(সবাই এমন,তা নয়),ইংরেজিতে বাংলা পোষ্টে কমেন্ট করে।নিজেদের জীবিকা-বৃত্তির বাইরে এরা ভাবতেও পারে না।মানে মানুষ হিসাবে এরা 'লিমিটেড এডিশন'।" 

অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস
___________________________________

ফেসবুকে এত বন্ধু ! পৃথিবীতে কতরকম মানুষ।বেশ কিছু ফেক আছে,বুঝতে পারি। হাসি পায়।কেন এই লুকো ছাপা বুঝি না।আমার, ডাক্তার নয়,এমন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভাল লাগে।ডাক্তাররা অদ্ভুত উন্নাসিক হয়(সবাই এমন,তা নয়),ইংরেজিতে বাংলা পোষ্টে কমেন্ট করে।নিজেদের জীবিকা-বৃত্তির বাইরে এরা ভাবতেও পারে না।মানে মানুষ হিসাবে এরা 'লিমিটেড এডিশন'।

এক বন্ধু,ঠিক বন্ধু নন,বান্ধবী বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি নিজের গাওয়া গান পোষ্ট করলেন। চকচকে শাড়ি পরে গান গেয়ে, মোবাইলে রেকর্ড করে আপ করেছিলেন। সেই গান তখন ঘুরছে এর তার দেয়ালে। গানের গুণে নয়। শিল্পী এখানে মূল লক্ষ্য। মজা হচ্ছে সেটা নিয়ে। মিনিটখানেক শুনে নিজেও হাসতে লাগলাম । আমার এক বন্ধু তার ‘প্রেন্ড’ হবার আগ্রহ জানিয়ে ঐ গানের নিচে স্টেটাস দিল। শব্দটা দেখে বুঝলাম এরকম কিছু একটা উচ্চারণ করেছেন তিনি।আরও কিছু বিকৃত কমেন্টও পড়ল।এইভাবে এক মহিলাকে তার ফেস বুকের বন্ধুরা হাসির খোরাক করতে লাগল।
মনটা খারাপ লাগল।আমি কারও প্রোফাইল দেখতে উৎসাহ পাই না। কিন্তু তার ফেসবুক প্রোফাইল দেখলাম। তারপর হু হু করে উঠলো ভেতরটা...

রুকসানা(নাম পরিবর্তিত) তার স্বামী পরিবারের সঙ্গে মুম্বাই থাকেন।আমি মেসেঞ্জারে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটি জানানোর চেষ্টা করলাম।আমার এই কুৎসিত ঠাট্টা বিনোদন অসহ্য লাগছিল।রুকসানা বললেন, তার গান গাওয়ার বড় শখ ছিলো। পরিবার সামলাতে গিয়ে সেই শখ শেষ হয়েছে।বাড়ির কাজ করে অবসর সময়ে তাই গান গেয়ে ফেসবুকে দেন। আট বছর ধরে তিনি পশ্চিমবঙ্গে আসেন নি। মন খারাপ হলে গান করেন। যারা তার গান শোনেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানান... তাঁদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়,আল্লার কাছে সেই আবেদন করেন।গানে সহজসরল তার বাক্যগঠন। শহুরেদের জন্য একটু ভদ্রস্থ করতে গিয়ে সেই ভাষা হয়ত কিছুটা হাস্যকর হয়ে ওঠে।

রুকসানা অবাক হন। কেন তাঁর গান নিয়ে মানুষ মজা করবে ঠিক বুঝতে পারেন না। তাঁর স্বামী দিনে এক ঠিকাদারের কাছে কাজ করেন,রাতে 'পাও-ভাজি' ঠেলা গাড়িতে বিক্রি করেন।অনেক রাতে উনি ঘরে ফেরেন। স্ত্রীর গান স্বামীই মোবাইলে রেকর্ড করে দেন।
খুব কাছে থেকে আমি এইসব মানুষদের দেখেছি। কঠিন, কঠোর পরিশ্রম করা একেকটা প্রিয় মুখ আমার। তাঁদের ভেতরের দীর্ঘশ্বাস, তাঁদের বাড়ি ফেরার আকুতি, দীর্ঘ বছর কষ্টের কাজ করে বিধ্বস্ত শরীর এবং মন নিয়ে থাকা মানুষদেরই আমার আপন মনে হয়। রুকসানার এই অবাক হওয়ায় বেদনায় নীল হয়েছি, আক্রান্ত হয়েছি তীব্র লজ্জায়।

আমার মনে হয়,যে মানসিকতায়, রিকশা নামের পাশবিক একটা যানবাহনে চড়ে আমরা অভ্যস্ত,হেঁটেচলা মানুষের মুখে ধুলো উড়িয়ে দামি গাড়ি হাঁকিয়ে অভ্যস্ত,তিনশটাকার টিকিট কেটে আইনক্সে সিনেমা দেখায় অভ্যস্ত,সেই মানসিকতায় আমরা রুকসানাদের পরিহাস করি।

সব মানুষের কিছু অক্ষমতা থাকে। বেদনাকে বোনের মতো যদিও ভালোবাসি, সাথে রাখি বন্ধুর মতো। কিন্তু সবকিছু বলার ইচ্ছে আমার নেই। রুকসানাকে বলি এমন ভিডিও আর না পোষ্ট করতে। কিছুক্ষন মেসেঞ্জারে চুপ থাকেন।তারপর বলেন, '' আচ্ছা দাদা,আমি এই গানের ভিডিও আপনাকে মেসেজে পাঠাবো।আপনি হাসবেন না তো ?" ও একটা হাসির ইমোজি দেয়।

কাল রুকসানা একটি ভিডিও পাঠিয়েছে।

নীল সামিয়ানার নিচে বসে গাইছে, কথা বলছে। খেয়াল করে দেখি সেটা সামিয়ানা নয়, শাড়ি। খাটের রেলিংয়ে শাড়ি বেঁধে তার নিচে বসে গাইছে। এ কোনো আয়োজন নয়। খাটের পাশে পলেস্তরা খসা দেওয়াল জমে থাকা পুঁটলি, মেলে দেয়া কাপড়টা আড়াল করেছেন এই শাড়ি দিয়ে। আমি তার আগের ভিডিওতেও দেখেছি তার ঘরে এই খাট ছাড়া, খাটের মাপের বাইরে আর কোনো নিজের জায়গা নেই নিজের জন্য। সেখানে মূল্যবান যা কিছু, হয়ত কিছু টাকা, কিছু মেকি গহনা, সেসবের পোঁটলা। গাট্টি বানিয়ে কাপড়চোপড় রেখেছেন পায়ের কাছে... সবই আমার দেখা...

আপনি ভালো থাকবেন রুকসানা। ক্ষমা করবেন আমাদের,ফেসবুকের বন্ধুদের।
_______________________________

 অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস । কলকাতার প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। কবি ও চিন্তক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়