Ameen Qudir

Published:
2018-03-02 16:35:47 BdST

মাকেনিয়ে লেখা : মায়ের চলে যাওয়ার দিনে


 

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

_________________________


আমার মা প্রয়াতা বেলারাণী ভট্টাচার্য্য।

দশ বছর আগে আজকের দিনে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

জন্মেছি – রাজশাহীতে, কিন্তু দেশভাগের কারণে চলে এসেছিলাম বেনারসে মা – বাবার সাথে ।

তখন অত জ্ঞান হয় নি , তাই বোঝার বয়সও ছিল না ।

অল্প মনে আছে ঠাকুমার ( কমলেকামিনী দেবী) কথা, যিনি অন্ধ ছিলেন। পরে জেনেছি –অন্ধ ছিলেন গ্লকমার কারণে ।

ঠাকুমা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবা মহিলা । খেতে বসলে – কথা বলা বা কারও ছোঁয়া বারণ । আমি নাকি ঘুরে ঘুরে তাঁকে ছুঁয়ে দিতাম আর তিনি খেতেন না ।

ফল ভুগতে হতো মাকে । বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে, তাঁর আর খিদে থাকতো না ।

ব্রাহ্মণ ঘরের এয়ো – তাকে না খেয়ে থাকতে নেই, তাই ঠাকুমার রাগ পড়ে গেলে আবার সাধাসাধি করে খেতে বলতেন মাকে ।

তখন সন্ধ্যে হব হব । চারিদিকে মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসছে- আর মা দুধ দিয়ে চিঁড়ে খাচ্ছেন । চোখের জলে মিটে যাচ্ছে তাঁর সব তৃষ্ণা ।
ইলেকট্রিক নেই তখন, তাই আবছা মনে পড়ে লণ্ঠনের আলোয়, মা আমাকে একদলা মুখে দিচ্ছেন আর আমি একটু একটু করে চুষে খাচ্ছি সেই অপার্থিব খাবার।

বাবা , ঠাকুমার জন্য রাবড়ি নিয়ে এসেছেন রাতে খাবেন । তার থেকে সস্নেহে তুলে ভাগ দিচ্ছেন মাকে ।

এই পর্যন্ত মনে করতে পারি ।

তারপর এক অজানা কারণে – মা আর আমি চলে গেলাম অধুনা ঝাড়খণ্ডের ওধুয়া গ্রামে, যেটা ভৌগলিক ভাবে মালদা আর রাজশাহীর কাছে ।

দাদু এখানেই চলে এসেছিলেন দেশভাগের পর । তাঁর ডাক্তারির পশার জমে উঠেছিল – আমার মেজোমামাকে কম্পাউন্ডার করে । বাকি চার মামা তখন কোলকাতা, বোম্বে এবং নলহাটিতে চাকরি বা পড়ার জন্য ।

দিনে রাতে মায়ের জন্য বরাদ্দ ছিল একসের + একসের করে দুধ । খেতে পারতেন না অত, তাও দাদু খাওয়াতেন জোর করে ।

আমি পেতাম চমচম ।
একদিন ভোরবেলা উঠে দেখি – মা বিছানায় নেই । কান্না শুরু হলো আমার ।
দিদিমা সাথে করে নিয়ে গেলেন বাড়ীর সামনের এক টিলার ওপর একটা বেড়ার ঘরে ।

দেখি, মা শুয়ে আছেন আর তার পাশে একটা গোলাপী রঙের বাচ্চা প্রাণপণে চিৎকার করছে ।
শুনলাম – সে আমার বোন ।
তারপরে যেটা মনে পড়ছে :- পারলাখেমুণ্ডির ( ওডিশা – আন্ধ্রার সীমান্তবর্তী শহর) রেকনা ইদির ( রেকনা ষ্ট্রিটের ) একটা লম্বা বারান্দায় আমার কোলে আমার সাড়ে তিন বছরের ছোট বোন – যূথিকা ।
এগারো মাস বয়সেও যার ঘাড় সোজা হয় নি – রিকেটের কারণে ।
অথচ ডাক্তার দাদু তখনকার নিয়মে যত রকম সম্ভব ওষুধ খাইয়েছিলেন বলে জেনেছি ।

তিন চার বোতল করে দুধ খেতো , তিন ঘন্টা পরপর । একদিন আমারই কোলে দুধ খেতে খেতে হেঁচকি তুলে এলিয়ে পড়লো ।

মা ছুটে এলেন । তখন সবে সন্ধে । পাশের বাড়ীর ছেলে চন্দ্রমৌলিকে দিয়ে খবর পাঠানো হলো বাবাকে । বাবা তখন ওখানকার সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার মালাকারের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেছেন ।

জিপ নিয়ে ছুটে এলেন – মালাকার ডাক্তার । ততক্ষণে সব শেষ ।

মায়ের পরিত্রাহী চিৎকার করে কান্না নাড়ীছেঁড়া ধনের জন্য আর বাবা শান্ত সমাহিত হয়ে বলেই যাচ্ছেন – আমাদের ঘরে মেয়ে টেঁকে না । কি যে অভিশাপ ।
সেই রাতেই স্থানীয় নদী মহেন্দ্র তনয়ার তিরে তাকে পুঁতে দেওয়া হয় । পোড়ানো যায় নি, কারণ ছিল যূথিকার দাঁত তখনও ওঠে নি ।

পরে, চাকরিসূত্রে অনেকবার গেছি পারলাখেমুণ্ডিতে আর বারবার খুঁজে বেড়িয়েছি আমার সেই গোলাপী বোনকে ।

কয়েকটা গাছপালা ছাড়া আর কিছু দেখি নি ।

যূথিকার যাওয়ার দিনটাও ছিল – আটই মার্চ, তারিখ একটু এদিক সেদিক হতে পারে – তবে মাসটা মার্চই ছিল ।যতদূর মনে আছে । মা দুই তারিখে চলে গেছিলেন ।

ওঁ শান্তিঃ

_____________________________

 


রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল । খ্যাতিমান কথাশিল্পী।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়