Ameen Qudir

Published:
2018-02-28 17:57:09 BdST

বইমেলা এবং একজন ডা. মিম্ মি'র লেখক হয়ে ওঠার গল্পটা




ডা. নাসিমুন নাহার মিম্ মি


________________

নভেম্বর আমার কাছে সব সময়ই স্পেশ্যাল মাস।কারন আমার আহ্ নাফের জন্ম মাস।তো 2017 এর নভেম্বরে বিশ একুশ তারিখের দিকে ডা. রেজা ভাই একদিন মেসেজ দিলেন সার্জিল খান নামে একজন ফেসবুকে রিকোয়েস্ট দিবে আমি যেন একসেপ্ট করি।উনি একজন প্রকাশক।লেখালেখি নিয়ে কথা বলতে চান। ভালো মানুষ।আমি যেন কথা বলি।
ব্যাস এই ছিল শুরুটা।
এরপর সার্জিল ভাইয়ের সাথে কথা হলো।
ভাইয়া জানালেন তিনি ফেসবুকে আমার লেখা ( স্ট্যাটাস ) পড়েছেন। আমি কি তাকে একটা পান্ডুলিপি দিতে পারব ? উনি আসছে অমর একুশে বইমেলায় আমার বই প্রকাশ করতে আগ্রহী।

এ কথা শুনে সত্যি বলতে কি আমার মনে মোটেও লাড্ডু ফুটেনি।বরং হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে।কারন আমি লিখতে ভালোবাসি এটা যেমন সত্যি পাশাপাশি এটাও সত্যি আমি লোকজন, হৈচৈ সোজা কথায় সমাজ থেকে দূরে থাকতে আরো বেশি ভালোবাসি।আর সেজন্যই ঢাকা, বাসা, আব্বু আম্মু সবকিছু ছেড়ে বন জঙ্গলে বসবাস করি।বহু সাধ্য সাধনা আর ঝড় তুফান সমৃদ্ধ ভয়াবহতম অতীত পথ পাড়ি দিয়ে বর্তমান Sound জীবনটা ঠিক আমার স্বপ্নের মতো করেই গুছিয়ে নিয়েছি।

ঠিক এই মুহূর্তে জীবনে নতুন করে Step আমি নিব কিনা তা ছিল মূখ্য প্রশ্ন।বই লেখা, আলোচনা, সমালোচনা, পাঠক, শত্রু, বইমেলা, মানুষ, ভীড়, প্রচার, প্রসার ইত্যাদি নেবার মতো অবস্থায় আমি আছি কিনা ভাবছিলাম।মানুষ থেকে দূরে থাকতে ই এখন ভালোবাসি।

এরপর দশ ডিসেম্বরে ঢাকায় আসি winter vacationএ।ঐদিনই সার্জিল ভাইয়ের সাথে দেখা হলে ভাইয়া চুক্তিপত্র সাইন করিয়ে নেন।এই একটা ব্যাপার দারুন ভালো লেগে গেল আমার।কাজ হবে কাজের মতো।কাজের ভেতরে সিরিয়াসনেস, স্মার্টনেস এবং অবশ্যই প্রফেশনালিজম থাকতে হবে।তবেই না আউটকাম ঠিকঠাক মতো আসবে।ভাইয়াকে ঐদিন আমি একটা কথা বলেছিলাম--- আমি তো আসলে লেখক না।লেখালেখি করি নিজের ভালো লাগার জন্য, সময় কাটানোর জন্য।
মানুষ কি পড়বে আমার লেখা ?কারন আমি জানতাম ভাইয়া রিস্ক নিচ্ছেন আমার বইটা নিয়ে।একে নতুন প্রকাশনী তার উপরে হাতে সময় এত কম আর আমিও পেশাদার লেখক নই একেবারেই।সেই সাথে আমি শুনেছিলাম নতুন লেখকদেরকে নিজের টাকা ঢালতে হয় বই প্রকাশ করার জন্য।কিন্তু আমার আমি তো আবার ঘাড়ের একটা রগ ত্যাড়া। নিজের বই নিজের টাকায় আমি কিছুতেই ছাপাব না-- ধনুক ভাঙা পণ আমার।
সুতরাং সার্জিল ভাইয়ার বাজীটা আমার কাছে চিন্তার কারন হচ্ছিল।কিন্তু ভাইয়া বেশ কনফিডেন্ট ছিলেন তিনি হেরে যাবেন না।
বললেন--- আপু আপনি পান্ডুলিপি রেডি করেন।বইটা এই মেলাতেই আসবে এবং মানুষ পড়বেও।

বাসায় ফিরে বসে গেলাম মোবাইল ল্যাপটপ ডায়েরি নিয়ে।2014 থেকে বনবাসী জীবন আমার।তখন থেকেই বহু কথার আলাপন লিখে রেখেছি পাতার পর পাতা।শুরু হলো সবকিছু গুছিয়ে পান্ডুলিপি লেখার কাজ।ঐদিন রাতেই সার্জিল ভাইয়ের প্রথম পুত্র সন্তান তাসজীলের জন্ম হলো।আমি বরাবরই ভাগ্যে বিশ্বাসী মানুষ।কেন যেন মনে হলো-- তাসজীলের জন্মের আনন্দ আরো অনেক দূর প্রসারিত হবে সিউর।শব্দভূমি প্রকাশনীর সাথে সেই আমার পথচলা হলো শুরু।এরপর ঊনিশ তারিখ পর্যন্ত চলল লিখালেখি একটানা।
এরপর পান্ডুলিপি জমা দিয়ে অফিসের ছুটি শেষে আবার আমার ডাক্তারী জীবনে জঙ্গলে ফিরে আসা।

যাহোক এরপর চলে এল বহু প্রতীক্ষিত ফেব্রুয়ারি মাস।এক দুই করে দশ তারিখ চলে গেল।আনটোল্ড স্টোরি মেলায় এল না।
বেশ কিছু ছোট বড় জটিলতা হলো।আমি পান্ডুলিপি লিখেছিলাম এন্ড্রয়েড মোবাইলে।
ফলে অক্ষর, শব্দ গেছে ভেঙে।ইংরেজি শব্দ থাকায় সেখানেও গোলমাল লেগেছে।
রীতিমতো বেড়াছেড়া অবস্থা আরকি।এদিকে আমার কাশিমপুর জেলখানা টাইপ অফিসের চাপে প্রুফ আমি দেখতে পারছি না।অফিসের প্রতি কর্নারে চিপা চাপায় সিসি টিভি ক্যামেরা থাকায় ফোনেও যে কথা বলব সে উপায়ও নেই।এর মধ্যে অকূল স্হলে হিজির হলেন প্রিয় মুখ প্রকাশনীর ফারুক ভাই।মেলা থেকে ফিরে ভাইয়া সারাদিনের ক্লান্তি ফেলে বসলেন আমার বই নিয়ে।চলল প্রুফসহ অন্যান্য ( আমি এখনো সবগুলো টার্ম ভালো করে জানি না) কাজ।
এদিকে আমার তো অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে।না বই কেন আসছে না তা নিয়ে না।বরং বই এলে মানুষ পড়বে কিনা এই নীল আতঙ্কে আমি ভুগতে শুরু করলাম।এক সময় ধৈর্য ভেঙে গেল।
হঠাৎ করেই তেরো ফেব্রুয়ারি আমার নার্ভাস ব্রেক ডাউন টাইপ হলো।মনে হলো কেউ যদি বইটা না পড়ে তাতে সমস্যা নেই।কিন্তু প্রকাশকের এতগুলো টাকা সব নষ্ট হবে আমার জন্য।কি যে মন খারাপ হলো।সার্জিল ভাই ফারুক ভাই সবাইকে বললাম বই আনতে হবে না মেলায় প্লিজ।কেউ পড়বে না।কেউ কিনবে না।আমি কিন্তু নেই এই বইয়ের সাথে ! কি যে সেইসব মুহুর্তগুলো।
সার্জিল ভাই বললেন-- কেউ না কিনলে কোন সমস্যা নেই আপু।ফারুক ভাই হাসতে হাসতে বললেন -- আরে কি বলেন আপু কেউ না কিনলে আমরা কিনে নিব।আর একজনও সাহস দিল--- 'বলল তুমি তো কার্ড খেলনি কোনদিন তাই জানো না।বায়ান্ন তাসের বাজীটা তোমার প্রকাশক ঠিক জিতে নিবে দেখ;He choose the Right person & invested his money on the right place.
মিম্ মি আগেও কখনো হেরে যায়নি, ভবিষ্যতেও হেরে যাবে না।জাষ্ট মাথাটা একটু ঠাণ্ডা রাখ।নামাজ পড় আর চুপচাপ ডাক্তারী কর।বইয়ের দায়িত্ব সার্জিলকে দিয়ে ঝিম মেরে পড়ে থাক।'

এরপর 14,15,16,17 তারিখ চলে যেতে লাগলো।উইকেন্ড কাটিয়ে ঢাকা থেকে ফিরছিলাম।গাড়ি আবদুল্লাহ পুর পার হবার পরে সার্জিল ভাই ফোন দিলেন।জানালেন বইটা মাত্র মেলায় ঢুকেছে।তখন বাজে চারটা প্রায়।কোন মতে কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম-- আপনার জন্য শুভকামনা রইলো ভাইয়া।

এরপর তো ঝড়ের গতিতে কেটে গেল একটা সপ্তাহ।সবাই বলল--- এখনকার দিনে নতুন লেখক বইমেলায় না থাকলে, অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ না দিলে বই চলে না।আরো কত কথা।আমিও রোজ ফেবুতে দেখি লেখক পাঠক সবার একসাথে ছবি।একটু একটু মন খারাপ তো করিই।আর ভাবি আহারে আমি যদি মেলায় উপস্থিত থাকতে পারতাম তাহলে আমার বইও আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যেত।সম্ভবতঃ আমিই একমাত্র লেখক যে মেলায় নিজের বই নিয়ে একটা দিনও উপস্থিত হতে পারিনি।অফিস ছুটি দিল না।

একজন বলল -- 'শোন এমন একদিন আসবে এইসব অফিস হাসপাতাল ই তোমাকে বলবে যাও পুরা ফেব্রুয়ারি মাস তোমার ছুটি উইথ পে।'
অতি শোকে পাথর অবস্থা নিয়েও ফিক করে হেসে দিয়েছিলাম ভবিষ্যত বাণী শুনে।

যাহোক পেশাগত কারণে একটা দিনও মেলায় আসতে পারিনি আমি আমার বইটা নিয়ে।
এখন পর্যন্ত অটোগ্রাফ দেইনি একটা বইয়েও ! কিন্তু তাতে কি ? আমার আনটোল্ড স্টোরি ফ্রম এ স্ট্রাগলার এর সব কপি শেষ !

আমি মিম্ মি কখনোই এটা ভাবিনি।আমার প্রথম বই আমি ছুঁয়ে দেখবার আগেই শেষ হয়ে যাবে।আর সেই আনন্দের খবরটা প্রকাশক নিজে আমার বইটা নিয়ে আমার কর্মস্হলে হাজির হয়ে জানাবেন।বইটার নতুন মুদ্রন এবং শব্দভূমির সাথে নতুন পথচলা নিয়ে কথা দিয়ে ফেলব।সব কিছুই স্বপ্নের থেকেও বেশি স্বপ্নময় হয়ে গেল আমার জন্য।

যদিও এখনো নিজেকে লেখক ভাবতে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে বুকের ভেতরে।তবুও আমার পাঠকদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ফেসবুকে আমরা অনেকেই স্ট্যাটাস লিখি।
কিন্তু ছাপার অক্ষরের বিষয়টা একেবারেই ভিন্ন জিনিস।
বইমেলা শেষ হবার আগেই নতুন বইয়ের কথা আলোচনা হচ্ছে।বেশ কয়েজন প্রকাশক কথাও বলেছেন।এসব কিছুই ভীষন অপ্রত্যাশিত আমার কাছে।কিন্তু লেখালেখি তো আমার পেশা না।নেশা এবং প্যাশন।নিজের সাথে নিজের কথা বলা আমার।তাই সময় নিয়ে ভালোবাসা দিয়ে মুড়ে দিতে চাই বই।

প্রথম বইয়ে কিছু ভুল ত্রুটি ছিল।আমি জানি।চেষ্টা থাকবে সেগুলো পরবর্তীতে কাটিয়ে ওঠার।আপনাদেরকে হতাশ হতে দিতে চাই না।

বুক রিভিউ পাচ্ছি প্রচুর।পাঠকরদের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন নতুন লেখকের পথ চলার জন্য।ভুলগুলো শুধরে নিব ইনশাআল্লাহ।আমি জানতাম না একেবারেই অপরিচিত অজানা মানুষগুলোর আমার কাছে প্রত্যাশা এত আকাশ ছোঁয়া।আমি মুগ্ধ।
সৃষ্টিকর্তার কাছে একটা জিনিসই চেয়েছি নতুন জীবন শুরু করার পরে--- "মাথা উঁচু করে যেন চলতে পারি পৃথিবীতে।কারো উপকার করতে না পারি কষ্টের কারণ যেন আমি না হই।" বই উপলক্ষে যে সম্মান আমি পেয়েছি তাতে
দায়িত্ব বেড়ে গেল বহুগুণ।চেষ্টা করব পথ চলার শুরুতে না চাইতেই যে পরিমাণ ভালোবাসা, আশীর্বাদ পেলাম তা আজীবন ধরে রাখতে।
দোয়া করবেন সবাই আমার জন্য যেন সুস্থ থাকি, যে কদিন বেঁচে থাকব বাঁচার মতো করে যেন জীবন পার করি।

ভালোবাসা রইলো।

 

Image may contain: 2 people, including Nasimon Nahar, people smiling, outdoor

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়