Ameen Qudir

Published:
2018-02-25 18:01:03 BdST

চির শান্তিতে থেকো মামুন!


 

 


ডা. খায়রুল ইসলাম

___________________________

 

২০০৭ সালের কথা। আমি তখন দক্ষিন আফ্রিকার জোহানসবার্গের বাসিন্দা। অফিসের কাজে যাবো সাউথ সুদানে; জুবায়। সে সময় জুবা, দারফুর – এ সব জায়গায় যাওয়া খুব সুখকর অভিজ্ঞতার বিষয় ছিল না যদিও রোমাঞ্চকর ছিল। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে অনেক কিছুই করতে হয়; তারপরও নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়।

এর আগে বার দুয়েক জুবা সফর অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি। এবার আর এড়ানো ঠিক হবেনা। তবে হঠাত বিপদ আপদ এলে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলামনা। খোঁজ খবর করে জানতে পেলাম জুবায় শান্তিরক্ষার দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। খুশীতে মন ঝলমল করে উঠলো। দেশে মেইল করলাম ক্যাডেট কলেজের ব্যাচমেট গোলামকে। ও তখন সেনাবাহিনীতে ব্রিগ্রেডিয়ার; শান্তিরক্ষী বাহিনীর দায়িত্বে। ও মেইলে জানিয়ে দিল সাউথ সুদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্নেল এলাহীকে। কর্নেল এলাহীর অফিস থেকে আমাকে আশ্বস্ত করা হলো যে জুবা এয়ারপোর্টে নামার পর থেকে ফেরত যাওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা নিয়ে আমাকে কোন চিন্তা করতে হবেনা। আমি আশ্বস্ত হলাম।


২০০৭ সালের ২৬শে মার্চ নাইরোবী থেকে সকাল বেলা এলাম জুবায়। ঐদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশাল সংবর্ধনা অনুষ্ঠান; জুবার সকল সরকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাজির থাকবেন; আমার দাওয়াত সেখানে। সেনাবাহিনীর গাড়ি এলো আমাকে নিতে আমার ক্যাম্প হোটেল থেকে। বিমান বন্দরের রানওয়ে ছাড়া শহরে তখনো কোন পাকা রাস্তা তৈরী হয়নি; পাকা রাস্তার কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। শহর খুব ছোট্ট; ১০-১৫ মিনিটের মাথায় পৌছে গেলাম অনুষ্ঠানের জায়গায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা কর্নেল এলাহী দাঁড়িয়ে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আমি নেমে অবাক। যার সাথে এতদিন ইমেইলে আলাপ হচ্ছিল সে কর্নেল এলাহী আর কেউ নয় – আমাদের মামুন! ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের; আমার ভাবির ছোট ভাই কবিরের বন্ধু এবং সকল পারিবারিক অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে থাকি; সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমাদের দীর্ঘ গাঢ় আলিঙ্গনে; অন্যান্য অফিসারদের বুঝতে সময় লেগে যায়। এর মধ্যে নানা ভিআইপি অতিথি আসতে শুরু করে। আমি অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পেছনের দিকে বসে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নানা পদ পদবীর লোকজনের আনন্দ অভিব্যক্তি দেখতে থাকি। বাংলাদেশের বাইরে স্বাধীনতা দিবস আর কখনো উদযাপন করিনি। অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক বিভিন্ন পরিবেশনায় কয়েক’শ মানুষের মধ্যে বসে থেকেও নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ উচাটন লাগতে থাকে।

রাতের বিশাল ভোজের পর সেনাবাহিনীর গাড়ি আমাকে আমার ক্যাম্পে নামিয়ে দেয়। সে সময় সাউথ আফ্রিকান কয়েকটি প্রাইভেট সেনা কোম্পানী ক্যাম্প হোটেলের রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছিল। নীলনদের পাড়ে আম বাগানের ভেতর এসব ক্যাম্প হোটেলে এক রাতের জন্য একটি তাবুর ভাড়া তিনশত ডলার। তাবুর ভেতর একটি ক্যাম্প খাট, মশারী, একটি বাতি, একটি ফ্যান। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য সারারাত জেনারেটর চলে; দিনে বন্ধ। জেনারেটরের তেল আর খাবার দাবার আসে উগান্ডা বা কেনিয়া থেকে। খাবার দাবার বেশ তরতাজা; সকালের প্লেনে সব সরবরাহ আসে নাইরোবী থেকে; একবেলা খাবারের জন্য ৩০ থেকে ৫০ ডলার গুনতে হয়। প্রায় ৫০-৬০ টি তাবুর জন্য মাঠের এক প্রান্তে সার বাঁধা গোসলখানা, পায়খানা; ছেলে মেয়েদের জন্য পাশাপাশি তবে আলাদা চেম্বার।


প্রতিটি তাবুর চারপাশে এক দেড় ফুট গভীর গর্ত করা; সাপ যাতে তাবুতে না ঢুকে। তারপরও তাবুতে ঢোকার আগে টর্চ জ্বেলে দেখে নিতে হয় সাপখোপ আছে কিনা। গোখরার বিশ্বাস নেই। এ জাতীয় হোটেল বেশ কয়েকটি; সবগুলোই নীলনদের পাড় দিয়ে। নদীর কিনারায় রেস্তোরা জায়গা। নদীর মৃদুমন্দ হাওয়া বড় রুচিবর্ধক; সাথে অনুপান থাকলে কথা নেই। নীল নদে প্রচুর মাছ; মাছেদের ঘাই দেখে নদীতে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে; লোভ সামলাতে হয়; কারন নদীতে কুমিরও ঘাই মারে। স্থানীয়রা তাজা মাছের খোঁজে বাজারে যায়; কাম্পালা থেকে লেক ভিক্টোরিয়ার ‘তাজা মাছ’ আসে রেফ্রিজারেটেড ভ্যানে করে। নদী থেকে কেউ মাছ ধরেনা; কারন কেউ মাছ ধরতে জানেনা! এই বিস্ময়্কর তথ্য জেনেও আমি বিশ্বাস করতে পারিনা। এমনি আরো নানা তথ্য পাই কর্নেল এলাহি তথা মামুনের কাছ থেকে। পরপর দুইদিন মামুন আমার ক্যাম্পে আসে। অনেকদিন পর একজন স্বজন পেয়েছে; যে তাঁকে তুমি করে বলে; বকা দিতে পারে; ওইটুকু শোনার জন্য ও বারবার আসে। আমরা নদীর পারে বসে থাকি; ভারতীয়দের ব্যবসায়িক বুদ্ধির তারিফ করি আর বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে আফসোস করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠানের খাওয়া দাওয়া – বেগুন ভাজা, রুই মাছ ভাজা, চিকেন রোস্ট, খাসির রেজালা, দই – সমুদয় খাবার ভারতীয় সরবরাহকারীর দেয়া! এই তথ্যে আমি বিস্মিত হইনা। এরচেয়েও বিচ্ছিন্ন জায়গায় আমি ওদের ব্যবসা করতে দেখেছি।


নানা আলাপে তিনদিন কেটে যায়। আমার কাজের জায়গায় আসা যাওয়ার পথে আমি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর নানামুখী এবং বিচিত্র কর্মকাণ্ড দেখতে পাই যার সাথে টিপিক্যাল জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের কোন মিল নেই; কিন্তু সাধারণ মানুষ খুব খুশী । যেমন – সেনাবাহিনীর ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ হচ্ছে; ডিজেল পাম্প দিয়ে জল সেচ হচ্ছে; জমিতে বীজ থেকে গাছ হচ্ছে; শাক হচ্ছে, ফল হচ্ছে, ফুল হচ্ছে; সাউথ সুদানের মানুষ অবাক হয়ে তা দেখছে। সাউথ সুদানের একটি প্রজন্ম যুদ্ধ করতে করতে তার কৃষি পদ্ধতি প্রায় ভুলে গেছে; কৃষিকাজ তাঁদের কাছে বিস্ময়। রাজধানী জুবার প্রধান হাসপাতাল আমাদের যে কোন ছোট্ট জেলা হাসপাতালের সমমানের। সেখানে বাংলাদেশের মেডিক্যাল কোরের ডাক্তাররা বিশেষত অর্থপেডিকেক্স ও গাইনীর নারী ডাক্তাররা অপারেশন করে জুয়েল আইচের চাইতেও বড় জাদুকর বনে গেছেন; সবার মন জয় করে নিয়েছেন। যারা সুদান এবং সাউথ সুদানের বিরোধের ইতিহাস জানেন তাঁরা চটজলদি বুঝবেন – খ্রিস্টান অধ্যুষিত জুবায় মুসলমানরা খুব একটা জনপ্রিয় নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং সাউথ সুদান সরকারের আস্থা অর্জন করা খুব সহজ কাজ ছিলনা। মামুন এবং তার অগ্রজরা এই দুরূহ কাজটা খুব ভালোভাবেই করেছে। ছাত্রজীবনে কোনদিন মামুন বলেনি সে প্রেসিডেন্ট এরশাদের আপন ভাগ্নে; কোনদিন এই আত্মীয়তার এক বিন্দু ফায়দা সে নেয়নি। এসব দেখতে দেখতে ছাত্রজীবন থেকে দেখা মামুন আমার কাছে কর্নেল এলাহীতে পরিনত হতে থাকে যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জুবায় সুনামে সুপ্রতিষ্ঠিত। লিংক ধরে মামুনের বাবার লেখা পড়লে বোঝা যাবে তাঁর মেধার পরিচয়।

আমার নাইরোবী ফেরত যাবার দিন ঘনিয়ে আসে। মামুন তথা কর্নেল এলাহী আমাকে জুবা এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে আসে; প্লেনের সিড়ি পর্যন্ত ও আমার সাথে থাকে। আমি বিদায় বেলায় চোখ ফিরিয়ে নেই; ঝাপসা চোখে আমার কাউকে দেখতে ভালো লাগেনা।

আমি দেশে ফিরে আসি ২০০৮ সালে; মামুনের সাথে আর দেখা হয়নি। ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী আমি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের উপর একটি কর্মশালায় ব্যস্ত ছিলাম। পিলখানার খবর ধীরে ধীরে আসতে শুরু করলো। আমরা কর্মশালা বন্ধ করে চলে আসলাম। এরপর বাকী কথা সবার জানা। দুদিন পর জানলাম – নিহত অফিসারদের মধ্যে মামুনও ছিল। পুরোন এয়ারপোর্টের রানওয়েতে ওর জানাজায় অংশ নিয়েছিলাম। মানুষের ঢলে ঠিক করে বুঝতে পারিনি ঠিক কোন কফিনটি মামুনের। তাতে কি এসে যায়। লাখো মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর অশ্রুধারায় সিক্ত কফিনে সেদিন কোন ভেদাভেদ ছিলনা; এখনো নেই। জানাজার নামাজের শেষভাগে এসে আমার উদ্গত কান্না চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টায় অবাক হয়ে আমার পাশে দাঁড়ানো সদ্য মন্ত্রী হওয়া দিলীপ বড়ুয়া আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝতে চান আমি কে। নিরুত্তর থাকি আমি। সারাদেশ যাদের স্বজন আমিতো তাঁদেরই একজন। চির শান্তিতে থেকো মামুন!


_________________________

Image may contain: 1 person

 

ডা. খায়রুল ইসলাম
Country Director at WaterAid Bangladesh
Former Regional Program Support Manager at Plan International, Region of Eastern and Southern Africa (RESA)
Former Country Director for Bangladesh and Pakistan at Orbis International


Studied Medical Science at Sir Salimullah Medical College,Dhaka

 

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়