Ameen Qudir

Published:
2018-02-09 19:07:15 BdST

রোগী কথনবাল্যবিবাহ ও নন্দিনী সমাচার


 

ফাইল ছবি। এই শিশুর বিয়ে পরে নিরোধ হয়।

 

 

 

ডা.ছাবিকুন নাহার

__________________________


গ্রামের নাম নদীপুর। নিটোল পরিপাটি একটি গ্রাম। রাজধানীর খুব কাছে। প্রযুক্তির সব দ্বার এখানে উম্মুক্ত কিন্তু গ্রামীণ আবহটি ঠিকঠাক বজায় আছে ষোলআনা। ছবির মতো গ্রাম বলতে আমরা এমন একটি গ্রামকেই বুঝি। গ্রাম চিরে বয়ে চলা মেঠাপথটি সাপের লেজের মতো আঁকাবাকা। সম্প্রতি ধূলোমাটির বদলে পিচ বসেছে এটাতে। এতে মেঠোপথের বৈশিষ্ট একটুও ক্ষুন্ন হয়নি। বরং অনভ্যস্থ কিশোরীর গালের মেকাপের মতো, নতুন পিচের পেলব মসৃণ আভায় ঝলমল যেনো। নতুন বউ নিজের মুখটা যেমন করে ঢেকে রাখে লম্বা ঘোমটায়, তেমন করে বড়বড় গাছগুলো পুরো পথটাকেই ছায়া দিয়ে রাখে দিনমান। দুইপাশে অবারিত আরিয়ল বিল। বিস্তীর্ণ। দৃষ্টি দিগন্তে মিলিয়ে যায়। কোথাও বাঁধা প্রাপ্ত হয়না একটুও। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়। ক্লান্তি লাগেনা বরং চোখের দারুণ আরাম হয়।

 

আমি মেহেরুবা। ডাক্তার। প্রতি শুক্রবার আসি এই গ্রামে। আউটডোর রোগী দেখি ছোট একটা ডায়াগনস্টিকে। মায়াময় এই রাস্তা দিয়ে যখনি আমি যাই, আমার নাগরিক সব ক্লান্তি ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে। আমি বুক ভরে শ্বাস নেই। কচুরি পানার গন্ধ, পাট পঁচা মিষ্টি গন্ধ কিংবা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ দামী সুগন্ধি থেকে কোন অংশে কম মনে হয়না আমার কাছে। গোবরের মাতাল গন্ধ কিংবা পাঁকা ধানের মনমাতানো গন্ধ সবটাই আমি আমার আঁচলে বাঁধি সমান মমতায়। এরা আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমার শৈশব। আমার কৈশোর। আমার পাড়া গাঁ'র নিটোল সন্ধ্যা। আমার অস্তিত্ব, আমার শিকড়।

 

ছুটির দিনটা গ্রামে এত কষ্ট করে যাওয়ার কী দরকার? কয়টা রোগীই বা পাও?

এসবের প্রশ্নে আমি গা করিনা। আমি অন্যের কথায় গা করা টাইপ না। যতটা আমি নাগরিক, আধুনিক, ঠিক তারচেয়ে দু আনা বেশি প্রাকৃতিক, গ্রামীণ, ভেষজ। আর সেটা জিইয়ে রাখতেই আমি ভালোবাসি। গ্রাম আমার শিকড়। আমার শিকড়ে ফিরতে আমি দায়বদ্ধ। অস্তিত্বের প্রশ্নে আমি কোন ছাড় দেইনা। চাইনা কোনো হিসাব কষতে

যা বলছিলাম, গ্রামটি ছবির মতো সুন্দর। স্বচ্ছল। বউ ঝিদের স্বাচ্ছন্দ্য চোখে পড়ার মতো। এত কিছুর মাঝেও কী যেনো একটা হাহাকার বিরাজ করে ওদের অবয়ব জুড়ে। ঝকঝকে ড্রেস আপ, অলংকারাদি ওদের সেই ম্লানতা ঢাকতে পারেনা। বেশিরভাগ কর্মক্ষম ছেলে বিদেশে কাজ করে। ছুটিতে আসে বছর দুতিনেক পর পর। মাস দুতিনেকের জন্য। তখন এদের বউদের মুখে চাপা একটা আলো খেলা করে। ম্লানাভ ভাবটা আর থাকেনা।

 

সব সুন্দরে কিছুনা কিছু ঝামেলা থাকে। তেমনি বাল্যবিবাহ এই গ্রামের একমাত্র ঝামেলা। এখানে এখনো ঋতুস্রাব কে মেয়ের বিয়ের উপযুক্ততার মাপকাঠি ধরা হয়। আর যদি মেয়ে একটু সুশ্রী হয় তাহলে আর রক্ষা নেই। পাত্রপক্ষ পিছ ছাড়বেনা।

এত্ত ছোট্ট মেয়ে বিয়ে দিলেন যে?

আর বলবেন না ম্যাডাম, ভালো ছেলে পাইছি। দেখতে শুনতে ভালা। সৌদি আরবে থাকে। পয়সাওয়ালা। মাইয়া খাইয়া পইড়া শান্তিতে থাকব। ছোট সংসার। শুধু শশুড় শাশুড়ি। রানব বাড়ব খাইব। আরকি!

আপনারা তো স্বচ্ছল, পড়াশোনাটা করাতে পারতেন না?

এত পড়াশোনা কইরা কী হইব? বয়স হয়ে গেলে ভালো পাত্র পাওয়া যায়না। এমন কইরা ধরল, না করতে পারলাম না।

তাই বলে এত কম বয়সে... কথা শেষ করতে দেয়না। ম্যাডাম যে কী কন! আমার বিয়া অইছে বারো বছরে। মাইয়ার তো তাও চৌদ্দ বছর শেষ হইল।

গত সপ্তাহে চেম্বারে যেতে বেশ খানিকটা দেরী হয়ে যায়। অপেক্ষমান রোগীদের মাঝে একজন রোগীর দিকে চোখ আঁটকে গেলো। মেয়েটাকে দেখেই মনেহলো ওর সব জীবনীশক্তি ব্লটিংপেপার দিয়ে কেউ শুষে নিয়েছে যেনো। নির্লিপ্ত চোখে জাগতিক সকল কিছুর উপর বিবমিষা যেনো উপচে পরছে। সাথে তাগড়া এক যুবক। বছর ত্রিশের। স্বামী। কিছুটা অসংবেদনশীল মনেহলো।

কি নাম তোমার?

নন্দিনী।

বয়স?

চৌদ্দ পনেরো হইব, যদিও কয় তেরো।

কোন ক্লাসে পড়ে?

এইটে পড়ত, এখন আর পড়াই না। পড়াইনা কথাটা শাই করে মাথায় আঘাত করল!

শুনলাম বিয়ে হয়েছে দেড় মাস হয়। কনসিভও করেছে। কিছুই খেতে পারেনা। সারাক্ষণ বমি করে। এরই মধ্যে ঔষধ খেয়েছে নাকি বিশটা। একসাথে! মরে যাওয়ার জন্য! হাসপাতালে ভর্তিও ছিলো নাকি দুতিন দিন।

কিছুতেই মিলাতে পারছি না। বিয়ের এক দুইবছর এমনিতেই চলে যাওয়ার কথা পরস্পরকে মুগ্ধ করতে করতে। আর দেড় দুই মাসের মধ্যে মরে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসে কিভাবে?

'আর বলবেন না ম্যাডাম, একদম কথা শুনতে চায়না। খালি জিদ করে। এক মায়ের এক মেয়ে তো! কখনো না শুনে বড় হয় নাই। সবসময় রাইট শুনতে চায়। আমি এসব দানাই পানাই পছন্দ করিনা।' স্বামী মহাশয় কথাগুলি একদমে বলে থামল।

আপনি কি করেন?

আমি বিদেশ থাকি। আমার মা বাবা দেশে থাকে। সব দায়িত্ব তো ওর, না? একটু সেবা যত্ন করবে। রান্না বান্না করবে। আর বোঝেনই তো আমি চলে যাবো...। অথচ ও বুঝতেই চায়না। বিরক্তি লোকটার চোখে মুখে ফেঁটে বেরুচ্ছে!

এত অল্প বয়সে বাচ্চাকাচ্চা নিতে গেলে কেনো?

কথা শেষ করার আগেই, 'আমিই কইছি নিতে। কবে আসি না আসি। একটা ব্যাপার আছে না?' তড়িৎ উত্তর ছেলেটার। যেনো বড়শিতে শক্ত করে মেয়েটাকে গাঁথতে পেরে তৃপ্ত। মেয়েটা একটি কথাও বলেনি এ পর্যন্ত। সব কথা ছেলেটিই বলল। মেয়েটির নাম ধাম থেকে শুরু করে সব। যেনো সব ছেলেটির ইচ্ছাতেই হবে। বিয়ে করেছে মানে কিনে নিয়েছে আরকি! ছেলেটির ডমেনেটিং আচরণ খুব চোখে লাগছিল।

মিষ্টার ডমেনিষ্টকে বাহিরে যেতে বল্লাম। খুব সহমর্মিতার সাথে নন্দিনীর কাছে জানতে চাইলাম,

ব্যাপার কি, বলো তো? মরে যেতে কেনো চাচ্ছো?

নত মুখটি আরো নত করে একেবারে বুকের সাথে মিলিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, আর বলবেন না ম্যাডাম। রাত নাই দিন নাই। চার বার পাঁচ বার। যখন তখন। আমার শরীরে কুলায় না। মানা করলে শোনে না। জোর করে। কাহাতক আর ভাল্লাগে? এমনিতেই কিছু খাইতে পারিনা। সারাক্ষণ বমি বমি লাগে। নড়তে চড়তেও কষ্ট। অথচ... ওদিকে হের মায় কয় আমি আইলসা। কোনো কাজ কাম করিনা। আমিতো ওঠে দাঁড়াতেই পারিনা ঠিকমতো, কাজকর্ম ক্যামনে করমু? অশান্তি আর ভাল্লাগেনা ম্যাডাম।

বাবা মা'র বাড়িতে যাওনা কেনো এই সময়ে?

এখন যেতে দিবেনা। কয়দিন পর বিদেশ চইলা যাইব। তাই জন্মের যন্ত্রণা করছে যত পারছে তত। হেয় আমার মোবাইলে কি কি যেনো সেট করে রাখছে। দেখে আমি কারো সাথে কিছু কই কিনা। আমার মায়ের সাথে কথা কইলেও লাউড স্পিকারে কইতে হয়। সব সময় বলে, এটা করবা না, ওটা ধরবা না। কারো সাথে মিশবানা। আমার বাড়ির কারো সাথে কথা বলাও পছন্দ করেনা।
বিয়ের আগে বলছে পড়াবে। অথচ এখন পড়াবে তো দূরে থাক পড়ার নামও শুনতে পারেনা।

আহারে মেয়ে, কিসের মধ্যে যে পরেছো! যে সময়টা হতে পারতো প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানোর সে সময়টায় তুমি মরে যাওয়ার জন্য মুঠোকরে ঔষধ গেলো। যে সময়টায় অনাগত সন্তানের সুস্থতার চিন্তায় সংযমী হওয়ার কথা, সে সময়টায় অবিবেচক স্বামী নামক মালিক মালিকত্ব ফলায় তোমার দেহে। এরা রেপিষ্ট থেকে কোনো অংশে কম না। সমস্যা হচ্ছে, গতানুগতিক রেপিষ্টদের মতো এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। বাবা মা'রা বলেন, 'মানিয়ে নে। সব ঠিক হয়ে যাবে।'

আসলে সব ঠিক হয়ে যায় না। নন্দিনীরা অনেক সময় ঝরে যায় নিরবে। হয় স্বেচ্ছায় নাহয় পরের ইচ্ছায়।

শোন নন্দিনী, মরে যাওয়া কোনো কাজের কথা না। বেঁচে থাকাটা দরকার সবার আগে। বুঝলে তোমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করবে তুমি। অন্য কেউ না। কেউ অবিবেচক হতেই পারে। তার অবিবেচক আচরণে তুমি কেনো মরে যাবে? বাবা মা' র মুখের দিকে একটু তাকাও। তোমাকে বড় করতে তাদেরকে কত কষ্ট করতে হয়েছে, একবার ভাবো। কোমল অথচ দৃঢ় কন্ঠে প্রতিবাদ করো। একেবারই কাজ না হলে নিজের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলো। মানুষের কথায় কিছু আসে যায় না। নিজেকে নিজে ভালো না বাসলে অন্য কেউ কেনো বাসবে বলো? মনেরেখো জীবন একটাই। সে জীবনের মূল্য অনেক। দুঃখ ভুলো। নতুনরুপে নিজেকে দেখো, কেমন।

বাই দা রাস্তা। মেহেরুবা ম্যাডাম দারুন খুশি! খুশির কারণ? শুনুন তার ভাষায়, কাউন্সিলিং মনেহয় ভালোই পারি। নন্দিনী যাওয়ার সময় একটা কথাই জানতে চেয়েছে, ম্যাডাম আমার বাচ্চাটা ভালো আছে তো? আশ্চর্য মেয়ে তো! এত কিছুর পরও সন্তানের কথা চিন্তা করে!

মা মনেহয় এমনি হয়। আর কে না জানে, যে মা সন্তানের কথা চিন্তা করে, সে কখনো নিজেকে মারতে পারেনা। মারতে দিতেও পারেনা। জয়তু মা...

___________________________

 

Image may contain: 1 person

 

ডা.ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়