Ameen Qudir

Published:
2018-02-02 15:35:33 BdST

লাল চাঁদ বা নীল চাঁদ এবং আমাদের কিছু অর্বাচীন কুসংস্কার




আজিজুল শাহজী
কলকাতা
________________________________

এই লেখাটি আপনাদের কাছে পৌছানোর এক দিন আগে আমাদের কেন্দ্রীয় বাজেট লোকসভাতে পরিবেশন করা হয়ে গিয়েছে। তার উপরে চলছে বইমেলা , অনেক আগেই প্রবাদ প্রতিম এক পথপ্রদর্শক হুতোম পেঁচা (কালী প্রসন্ন সিংহ ) বলেছিলেন হুজুকে বাঙালি ,আমরা সেই কথার সম্মান রেখেই চলেছি। ভেবেছিলাম ,কয়েকটা দিন একটু বইমেলা ইত্যাদি নিয়ে নিজেও ব্যস্ত থাকবো কিন্তু ওই যে বলে ,তুমি যাও বঙ্গে তো কপাল যায় সঙ্গে ! উত্তর পূর্ব থেকে ফিরে এক মুহূর্ত একটু ফাঁকা পাচ্ছি না যে আড্ডা দেবো। বোঝার উপর শাঁকের আটি হয়েছিল গতকালকের চন্দ্র গ্রহণ। আগের কালী পুজোর মতো আমার কিছু অধস্থন (নামেই,আসলে আমাকেই জবাব দিতে হয় !) এই গ্রহণে কে কত নিয়ম পালন করবে তার এক আলোচনা শুরু করেছিল সকাল থেকেই।

 

এর সঙ্গে জুটেছিল ধার্মিক+বিজ্ঞান জ্ঞান সম্পন্ন অতীব কিছু মিশ্র প্রজাতির মানুষ। কি বলবো, ফেরার সময় নানান জায়গায় মানুষের ওই চাঁদের হ্যাংলামি এবং একেবারে শেষ পর্যায়ে বাড়ি ঢোকার আগে গলির মুখে একটি পুকুরের পারে দুই বঙ্গললনা মোবাইলে এই চাঁদের ছবি ফ্ল্যাশ সহযোগে তোলা দেখে ভাবলাম না একটু লেখাই যাক।

হায় চাঁদ তুমি জানো হুজুকের যত কথা :

বাজারে তিনটি কথা বেশ প্রচার পেয়েছে,প্রথমটা হলো চাঁদ কে দারুন কিছু বিশেষণে সম্মানিত করা হয়েছে যেমন BLOOD MOON অথবা SUPERMOON এবং BLUE MOON,দ্বিতীয় হলো পৃথিবীর সব চেয়ে কাছে আসার ফলে নানান ভূকম্পের বা বিপর্যয়ের কাহিনী আর সব শেষে এই চন্দ্র গ্রহণ আর চাঁদের রূপ ১৫০ বছরের পর এসেছে তাই ইহা এক বিশেষ বিষয়। আসুন একটু এই জিনিসগুলো বিশ্লেষণ করি।

Related image

 


১. শেষ থেকেই শুরু করি , ব্লু মুন হলো মাসে যখন দুটো পূর্ণিমা পরে তখন ওই দ্বিতীয় পূর্ণিমা বা চাঁদের পূর্ণরূপ কে ওই বিশেষণ দেওয়া হয়। ওটির সাথে কোনো রং এর সম্পর্ক নেই তবে গড়পড়তা এই ঘটনা প্রতি বছর হয় না ,গড়পড়তা দেড় দু বছর পরে হয় ,যেমন পরের ব্লু মুন হবে ২০১৯ এর মে মাসের একুশ তারিখে। কোনো দুর্লভ কিছুর উপর তুলনা দিতে ইংরেজিতে বলা হয় " once in a blue moon " এটি হলো সেই অর্থে। পাঠক এবং পাঠিকাগণ তাই যদি কালকে চাঁদ না দেখে থাকেন তা হলে দুঃখ পাবেন না আর পত্রপত্রিকাতে বা টিভিতে নীল চাঁদ দেখলে শিহরিত হওয়ার ঘটনা ভুলে যান ওটা আপনাকে 'খাওয়ানো ' হয়েছিল অনেকটা যে রকম বাজরানন্দ আমাদের খাওয়ায় ওই রকম ভাবতে পারেন।

 

Image may contain: night and sky

BLOOD MOON বা রক্তমুখী চাঁদ :

২. যে মানুষগণ নীল রঙে মন মজায় নি তাদের জন্য বাজারে এসেছে এই রক্তমুখী চাদ বা blood moon ..বেশ একটা আকর্ষণীয় নাম কি বলেন ? মজার কথা হলো এটি বাজারে এসেছে অনেকদিন মানে বাইবেল ইত্যাদিতে এর উল্লেখ আছে তবে মানুষ ওটা ভুলে গিয়েছিল। আবার নতুন করে নিয়ে এসেছিল এক জ্যোতিষী (জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভাববেন না আবার !) তার নাম Richard Nollelle ,এই নলে দাদার নামটির কিছু কারন অবশ্য আছে। আসুন ছবি নম্বর দুই এর দিকে একটু নজর দিন , দেখবেন ওই চন্দ্র গ্রহণ এর একটি রূপ। এই বিষয়ে বলা ভালো , চন্দ্রগ্রহণ হলো আমাদের পৃথিবী যখন সূর্য আর চাঁদের মাঝে চলে আসে মানে একই লাইনে ভাবতে পারেন ঠিক সেই সময়ে চাঁদ ঢাকা পরে যাওয়ার ঘটনা। এখন সূর্য একটি বিশাল আগুনের গোলক আর আমাদের পৃথিবী কি আর পুরো ঢেকে দিতে পারে ? না , তাই এর চার পাশ দিয়ে সূর্যের আলো উঁকি ঝুঁকি মারবেই। যেমন ধরুন আমাদের কিছু রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রী ইত্যাদি মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির ঝলক সাধারণ মানুষ মাঝে মাঝে পেয়ে পুলকিত হয়ে ওঠেন অনেকটা সেই রকম। না ,বেলাইনে যাওয়া ঠিক না , আবার বিজ্ঞানে ফিরে যাই। যা বলছিলাম,ওই সূর্যের আলো অনেকগুলো রঙের সংমিশ্রণ ওটা তো জানেন কিন্তু এই গ্রহণের সময় ওই চারিধার থেকে ঠিকরে আসা আলোর মধ্যে যে রংটি প্রকাশ বেশি পায় তা হলো লাল বা কমলা। আরো সহজ করি ?

 

Image may contain: food

ওই ধরুন আমরা যখন সূর্য অস্ত যেতে দেখি তখন লালচে আলোর সূর্য কেন দেখি ? কারন সেই সময় আমাদের বায়ুমন্ডল বা আরো সোজা কথায় ধূলিকণা ভেদ করে সব আলো ঢোকে না সূর্য আমাদের সেই অঞ্চলের পাশ দিয়ে যে আলো ফেলতে থাকে তার লাল রং এর প্রবেশ ঘটে কিন্তু নীল কণিকা ফিরে যায়। চাঁদের বা পৃথিবীর যেহেতু ওই আলো সূর্যের থেকেই প্রতিফলিত হওয়া আলো তাই আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের যে আলো দেখি তাতে ওই লাল বা কমলা রঙের পরিমান এই গ্রহণের সময় বেশি আসে। চাদ একটু (যৎসামান্য ) লালচে লাগে তাই। এক কথায় আরো একটি চন্দ্রগ্রহণের সময় একই ভাবে চাঁদ কে লাল দেখবেন ,পূর্ণ চন্দ্রগ্রহন হলে পুরো লাল চাঁদ এর প্রতিফলন। কাব্যের জগতে চাঁদ দেখে লাল সেলাম দিতে পারেন কিন্তু ১৫০ বছরে একবার এই রক্তিম চাঁদ দেখছেন বলে শিহরিত হবেন না ,অনেক পুলাপান হাসতে পারে !

No automatic alt text available.

 

২. SUPER MOON মানেই পাৎলুনের উপর চাড্ডি পরিধান করা কোনো বিশেষ কিছু নহে !

আরো একটি অপবিজ্ঞান চলেছে যে ১৫০ বছরে এই চাঁদ পৃথিবীর এতো কাছে আসে মানে ওই আমাদের রাষ্ট্র ভাষা অনুযায়ী 'লগ যা গলে ! ' গোছের কিছু হয়েছে। একেবারে বাজে কথা ! চাঁদ ,পৃথিবী এবং অন্য গ্রহ এমনকি সূর্য (হ্যা ওটা ও ! এর উপর পরে কিছ বিরক্তিকর লেখা উৎপাদন করার ইচ্ছা আছে ) নিজের অক্ষে বিরাজমান এবং ধাবমান। এতে এই কাছাকাছি আসার বিষয়টা ১৫০ বছরে একবার মানে এই চাঁদ আর পৃথিবীর এই গলাগলি করার কিছু নেই। কাছে আসা নিত্য হয়, মানে চাঁদ ২৩ দিনের মতো সময় নেয় আমাদের এই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে আর একই সময় নেয় নিজের কক্ষে ঘুরতে। এই ভাবে একটু ঝুকে আমাদের এই ধরার দিকে মুখ করে ঘুরতে থাকে। বছরে একটি সময় কাছে আসে আবার এক সময় সরে যায়। মানে ওই ১৫০ বছরে কাছে এসেছে একটি নিছক হওয়া গরম করার খেলা। গুজবে কান দিবেন না !

Image may contain: sky, outdoor and nature

 

শেষ কথার আগের কথা মানে এই ১৫০ বছরে একবার তা হলে কি ?

ওটা হলো সেই মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের 'ইতি গজ ',বুঝলেন না ? ওটা আসলে সত্যি কথা তবে আমার আপনার মতো এই ম্যাঙ্গো পাবলিক মানে আম জনতার শিহরিত হওয়ার কিছু না। ওই চন্দ্রগ্রহণ যদি কোনো ব্লু মুন হওয়ার সময় হয় তা হলেই ওটা হয় একটি দুর্লভ বস্তু। মানে আরো সোজা কথায় আপনি একই মাসে দুটো পূর্ণিমার শেষ পূর্ণিমার সময়ে যদি চন্দ্রগ্রহণ পান তা হলে ওটা সেই জিনিস। আগের একই ঘটনা হয়েছে ৩১শে মার্চ,১৮৬৬ সালে। লেখার নিচের তথ্যসূত্র অথবা নিজেই গুগল করে দেখে নিতে পারেন।

 

মানে ? দেখালো মুরগি আর খাওয়ালো ডাল ?

হ্যা ,অনেকটাই তাই তবে এই সূত্রে মানুষ যদি একটু মহাকাশের দিকে চোখ দেয় মানে এই পৃথিবীর প্রতিনিয়ত ক্যাচাল ফেলে একটু আকাশের মতো মনটা বড় করে ক্ষতি কি ? না,ক্ষতি কিছুই নেই যদি না এই সূত্রে কিছু ধান্দাবাজের ব্যবসার প্রকোপ না বাড়ে। শেষে ওই কথাগুলো বলে আপনাদের কাছে এই একঘেয়ে প্যানপ্যানানি বন্ধ করবো।

এই লাল নীল গ্রহণ ইত্যাদি এবং আমাদের বা আরো সোজাসুজি বললে এই যুগে দাঁড়িয়েও মানুষের অন্ধ সংস্কার

উপরে যা বলে শুরু করেছিলাম,আবার বলছি ,প্রবল আলোচনা হয়েছে যা বাধ্য হয়ে শুনতে শুনতে এক সময় প্রতিবাদ করেছি। হয়তো উর্দ্ধতন পদাধিকারের জন্য গালাগাল সামনে করে নি তবু বলছি কি অসহ্য সেই আলোচনা :
১. কোনো এক মহিলার গ্রহণের সময় তার নড়াচড়া করার কারণে তার মেয়ের কানে একটু খুঁত -এর উপর কিছুই বলতে পারি নি স্রেফ মনে মনে গালাগাল দিয়েছি।

 

Image may contain: night


২. গ্রহণ নিয়ে কিছু বিজ্ঞানমনস্ক (!! ) মানুষের বক্তব্য ওই সময় বিকিরণ বেড়ে যায় তাই গঙ্গাতে চান বা অভাবে বাড়ি গিয়ে চান করে নেওয়া অতীব বিজ্ঞান সম্মত ! কি আর কইতাম এই ইয়ের পুলাগো ! আরে বিকিরণ ধুবি গঙ্গার জলে চান করে ? বিকিরণ কিছুই বাড়ে না ,কি ভাবে এদের বুঝাই !


৩. খাবারে জীবাণুর উৎপাত বেড়ে যায় তাই এই গ্রহণ চলার সময়ে না খাওয়াই ভালো -বলে রাখা ভালো এই দিনটি আমার অফিসে এই মাসের যাদের জন্মদিন তাদের একটি গণজন্মদিন পালনের বিষয় ছিল। এই না খাওয়ার লোক গুলো নিজেদের ভাগের কেক খেয়েছে ,চা খেয়েছে ,কিছু অবশ্য কেকের মায়া ত্যাগ করেও চা এবং খৈনি খেয়েছে। কেন ? জিজ্ঞাসা করবেন না। ভণ্ডম স্মরণম গচ্ছামি !
৪. এদের একজন অফিস থেকে বাড়ি যাওয়ার আগে গঙ্গায় ডুব দিয়ে যাবে বলে তাড়াতাড়ি পালিয়েছে ,জিজ্ঞাসা করায় বলেছে ,কি করবে বৌ এর হুকুম ,তার উপর ধর্মের বিধিনিষেধ !

No automatic alt text available.

 

যাইহোক , আমি কাউকে তাচ্ছিল্য করতে কলম ধরি নি ,অন্তত এই লেখায় তো না। সবিনয়ে অনুরোধ করছি এই সংস্কারের উপরে উঠুন মানে নিজেকে প্রশ্ন করুন। উদারমনা /মুক্তমনা ইত্যাদি হতে বলছি না তবে প্রশ্ন করুন কেন এইগুলো মানবেন। যদি যুক্তি দিতে পারেন তবে আমাকে ও একটু আলোকিত করুন আর না হলে এই ভাবে নিজেকে আর পরবর্তী প্রজন্মকে বিনাশ করার ভণ্ডামি করবেন না।

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ !
তথ্যসূত্র :
১. https://www.express.co.uk/…/Super-moon-2018-when-next-full-…
২. https://www.space.com/39208-super-blue-blood-moon-guide.html
৩. https://www.space.com/34515-supermoon-guide.html
৪. https://www.wired.com/…/dont-call-it-a-blood-moon-or-super…/
৫. https://edition.cnn.com/…/super-blue-blood-moon-…/index.html
৬. https://www.firstpost.com/…/the-lunar-eclipse-of-31-january-…
৭. পাশ্চাত্যের সংস্কারের ১২টী নমুনা মানে এই লাল নিল চাদের উপর https://www.bustle.com/p/12-super-blue-blood-moon-superstit…
Image may contain: night and sky
Image may contain: food


_____________________________

লেখক আজিজুল শাহজী। খ্যাতিমান লেখক ও চিন্তক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়