Ameen Qudir
Published:2018-02-01 20:21:16 BdST
ডাকসুর ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ছাত্র সংগঠনকে জাতীয় রাজনীতির লেজুড়মুক্ত হতে হবে
ডা. বাহারুল আলম
পেশাজীবী নেতা ।
___________________________
ডাকসু তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মলাভের পরবর্তী কিছুসময় পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্রদের ভূমিকার প্রতিনিধিত্ব করে আসছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টির আন্দোলনে, বিশেষ করে ৬৮/৬৯ এ গণঅভ্যুত্থান ও ৭০’এর নির্বাচনে জনমত সৃষ্টিতে এ সংগঠন ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল । ৭১’এ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এ সংগঠনের ভূমিকা ছিল অগ্রণী । এটাই ডাকসুর ঐতিহ্য।
তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের শেষের দিকে ডাকসুর সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক অঘোষিত গভর্নর হিসাবে পরিচিত ছিল। তখন ডাকসু নেতাদের সভায় কেবল ছাত্র নয়, ছাত্র- জনতার ঢল নামত। যেখানেই সভা হত , মাঠ কানায় কানায় ভরে যেত । স্বাধীনতার পর এ জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে স্তিমিত হতে থাকল। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের মানসে/লোভে আত্মকলহ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব এর প্রধান কারণ। যেভাবে মানুষের আস্থা ভালবাসা নিয়ে রাজনীতির শীর্ষে উঠেছিল, একইভাবে পতন ও পচন শুরু হল ডাকসুর নেতৃত্বে। নির্মোহ এ ছাত্র সংগঠন মোহগ্রস্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে লাগল। অবশেষে ৯০’ এর পর ডাকসু নির্বাচন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।
প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। অস্ত্রের ঝনঝনানি , রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ , ছাত্র হত্যা , ছাত্রী হলে শ্লীলতাহানির ঘটনায় ক্রমান্বয়ে মানুষের আস্থা ও ভালবাসা হারাতে থাকল ডাকসু ।
দীর্ঘ পরিক্রমার পর অনেক আলোচনা, সমালোচনা , ভালবাসা , সম্ভাবনা ও নিন্দা অতিক্রম করে রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ডাকসু নির্বাচনের রায় দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের প্রতি । এর কিছুদিন পূর্বে জনৈক প্রাক্তন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ডাকসু নির্বাচনের দাবীতে আমরণ অনশন শুরু করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। জনমত সৃষ্টি হতে থাকে ঐতিহ্যবাহী ডাকসু যেন তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে।
যে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ডাকসুর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল , সে ছাত্রদের মধ্যে আজকের জাতীয় রাজনীতির প্রভাব ভিন্নতর । স্বকীয় সত্ত্বায় , আত্ম-উপলব্ধিতে ছাত্র বা ছাত্র-নেতৃত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। দলীয় লেজুড়বৃত্তি , ক্ষমতা ও আধিপত্য সৃষ্টির লোভে ছাত্র সংগঠনগুলো দিশেহারা , অল্প কিছু সংগঠন বাদে। এরই প্রতিফলন ঘটবে ডাকসু নির্বাচনে ।
পারস্পরিক অশ্রদ্ধা , অবিশ্বাস ও অসহিষ্ণুতা ডাকসু নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা না হয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে এবং ডাকসু নির্বাচন আবারো বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। যে ভূমিকা ও নেতৃত্বের প্রয়োজনে ডাকসু নির্বাচন প্রত্যাশিত- তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা আবারো মুছে যাবে। কেবল জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা নয় , শিক্ষার্থী ও শিক্ষার সমস্যা নিয়ে কথা বলার শক্তিশালী সংগঠন থাকবে না। এ মুহূর্তেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষার বিষয়ে কথা বলার তেমন কোন শক্তিশালী সংগঠন নাই ।
জাতীয় নির্বাচনের প্রতিফলন ঘটবে ডাকসু নির্বাচনে। ছাত্র সংগঠনগুলোর জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতা এর প্রধানতম কারণ। রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান শ্রেণি চরিত্র ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ডাকসু নির্বাচনের উপর প্রভাব ফেলবে। ডাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারায় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের প্রতিফলন ঘটলে অতীত ঐতিহ্য পুনর্জন্ম নিতে পারে। যদিও সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। জাতীয় রাজনীতির ধারক হয়েও ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে ঐক্যমত্য হলে – ডাকসু ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হিসাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এরূপ ঐক্য হওয়া কঠিন, কেননা সংগঠনগুলো কোন না কোন রাজনৈতিক সংগঠনের আদর্শের ধারায় বহমান। যদিও ছাত্র সংগঠন , তবুও শিক্ষার্থী ও শিক্ষার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সংস্কৃতি নাই। তারা জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে আধিপত্য বিস্তারের ইচ্ছায় নিমজ্জিত থাকে।
এখানে শক্তিশালী ডাকসু হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে । তারা যদি ডাকসু গঠনে নিজ ছাত্র সংগঠনগুলোকে দখলদারি ও আধিপত্য বিস্তারে লেলিয়ে দেয় তাহলে আবারো মনে হবে ডাকসু না থাকাই ভাল ছিল।
তারপরেও প্রয়োজনের তাগিদে বলতে হয় , রাজনৈতিক দলের লেজুড়মুক্ত ছাত্র সংগঠনের বড়ই প্রয়োজন, যারা শিক্ষার্থী ও শিক্ষার জন্য দলমত নিরপেক্ষ হয়ে কথা বলবে , প্রতিবাদ করবে। ডাকসুই কেবল পারে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন ও গবেষণামুখী করে তুলতে।
আপনার মতামত দিন: