Ameen Qudir

Published:
2017-12-09 18:35:39 BdST

রোগী কথননারী যেখানে জেনেটিক পুরুষ অথবা নারীরুপি পুরুষঃ প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল


 

 

 

 

 

 

 

 


ডা.ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
______________________________

আপনি মনেপ্রানে একজন পরিপূর্ণ নারী। আজন্ম তাই জানেন, বিশ্বাস করেন। সমবয়সী আর দশটা মেয়ের সাথে একই ভাবে বেড়ে ওঠেছেন। আচ্ছা কোন একদিন, হঠাৎ যদি শোনেন আপনি মেয়েই না, পুরুষ! কেমন হবে আপনার অনুভূতি? চোখ কপালে ওঠে গেলো তো! আচ্ছা আপনার অথবা আপনাদের প্রতিক্রিয়া শুনব তার আগে চলুন একটা গল্প শুনে আসি:

 

বহতা। বন্ধুরা মজা করে বলে, মিস ইউনিভার্স। সুইট সিক্সটিন পেরুল বছর দুয়েক হলো। গল্প উপন্যাসের নায়িকাদের মতো রুপবতী। উচ্চতা পাঁচ পাঁচ। শরীরের বাঁকে চোখ আঁটকে যায়। জ্যামিতিক সব কোনই এখানে নিঁখুত ঝকঝকে। চুল তার কবেকার অন্ধকার বেদিশার নিশা। জীবনানন্দ এমন কাউকে দেখেই লিখেছিলেন হয়তো। ত্বক মোলায়েম সফট। এতটাই শাইনি মনেহয় এইমাত্র ওয়াক্সিং করে এসেছে! হাত পা নিটোল, ফালি ফালি। লম্বা লম্বা পা মেলে যখন হাটে, ছন্দের ঢেউ খেলে যায় চারদিকে। বাতাসেরা করে কানাকানি।

 

অমন সৌন্দর্যে যুগে যুগে ট্রয় ধ্বংস হয়। এটা হয়েই যায়। হওয়াটা বোধহয় জায়েজ। ট্রয় ধ্বংসে হেলেনের ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আদির ভবিষ্যৎ বাচ্চাকাচ্চার মা বহতার সম্পর্ক কতটুকু আমরা এখনো বলতে পারি না। ওহ্হ! আদির পরিচয়টা একটু দিয়ে নেই। ও বহতার সাথেই পড়ে। একই ডিপার্টমেন্ট। দুজনেরই এখন উড়ার বয়স। ইউনিভার্সিটির দিন কয়েকের মাঝে বহতাকে লেখা আদির চিরকুট-

' বহতা, তুই নদীর মতোই বয়ে চল নিরবধি । কখনো যদি ক্লান্তি লাগে আমাকে বলিস। আমি তোর ঘাটে নোঙ্গর ফেলব। একপাল ছেলেমেয়ে সামলাতে আমার দারুণ লাগবে। কনসিডার মি। প্লিজ!...
আদি, যে নামে চিনিস।'

 

যে ছেলে প্রপোজের প্রথম চিঠিতেই বাচ্চাকাচ্চার প্রসঙ্গ নিয়ে আসতে পারে, সে যে সে চিজ না! এর সাথে জীবন বরবাদ করা যেতে পারে। বহতার ভালো লেগে যায়। সেই থেকে ওরা একসাথে। ক্লাশ, লাইব্রেরী, এসাইনমেন্ট। কোজাগরী পূর্নিমায় নিরুদ্দেশ হওয়া। জোছনার জলে ভাসতে ভাসতে ডুবে যাওয়া অথবা ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠা। সময়ের পরতে জমা হয় অগণণ পল অনুপল। কিন্তু বহতা আদির চোখ জুড়ে যে স্বপ্ন, সে স্বপ্নরা বেড়ে ওঠার আগেই ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে এক দমকা হাওয়ায়।

 


ঢাকার নামকরা এক হাসপাতাল। ডাক্তার ম্যাডামের ব্যাখ্যা মনোযোগ সহকারে শুনছিল ওরা। খুব মায়া আর সহমর্মিতা নিয়ে ম্যাডাম বুঝাচ্ছেন। কেনো হলো, কারণ কি, কি চিকিৎসা এসব। বহতা কিছুই শুনছে না যেনো। সে কেবল কেঁদেই যাচ্ছে। অজোরে। আর আদি বহতার দুটো হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে। ওদের চোখের সামনে ভাসছে ডুবছে এক ঝাঁক শিশুর মুখ। আদি বহতার ভবিষ্যত শিশু। ভাসতে ভাসতে ডুবেই গেলো অবশেষে। আহারে!

 

আসুন আমরাও শুনি সেসব কথোপকথন-

- আরাম করে বসো। বহতা আমার দিকে তাকাও। আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দাও কেমন। তুমি বলছ তোমার মাসিক হয় না, কখনো হয় নি। এটা ঠিক?

- জ্বি ম্যাম ঠিক।

- তুমি আগে আসোনি কেন? পিরিয়ড তো ১৩/১৪ বছরেই হয়ে যায়। তারপরও এতটা দেরী করলে তুমি!

- ম্যাম, ভেবেছিলাম হয়ে যাবে। আমার সব তো ঠিকঠাক শুধু ওই ব্যাপারটা ছাড়া। আর কোন সমস্যা নেই। তাই....

- তোমার পরিবারে আর কারো এমন আছে?

- জ্বি এক আন্টির ছিলো বলে শুনেছি।

কথোপকথনের এই পর্যায়ে ম্যামকে একটু চিন্তিত মনে হলো। পরক্ষনে আবার সামলে নিলেন। খুব যত্ন করে বহতার শারীরিক পরীক্ষা করলেন। এত সুন্দর শারীরিক গঠন এবং ত্বকের পেলবতা যে মায়া লাগে। আহারে! ডাক্তার ভেবে পায় না কিভাবে বলবে যে,

"বহতা তুমি মেয়ে না, ছেলে!"

তার নিজেরই তো কষ্ট লাগছে। কারা যে বলে, ডাক্তারদের ইমোশন নেই। তারা ভুল বলে। না হলে তার এমন দমবন্ধ লাগছে কেনো? বহতার কেমন লাগবে! আহারে মেয়ে! এতদিন যা জেনে বড়ো হয়েছো, এখন কিভাবে সম্ভব অন্য কিছু বিশ্বাস করা!

* এই রোগটার নাম কি ম্যাম? আদি জানতে চায়
- এন্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিন্ড্রোম বা টেস্টিকুলার ফেমিনাইজেশান সিন্ড্রোম। এটা মূলত পুরুষের একটা রোগ। যেখানে পৌরুষত্বের বৈশিষ্ট রক্ষাকারী হরমোন এন্ড্রোজেন মানে টেস্টোসটেরন কাজ করতে পারে না। ফলে পুরুষের শরীর নারী শরীরে রুপান্তরিত হয় পরোক্ষ ভাবে। হরমোনের অভাবে।

* কেনো এমন হয়?
জেনেটিক্স কারনে। অথবা রিসেপ্টর মিউটেশনের কারনে। এই টেস্টোসটেরন পুরুষের বাহ্যিক শারীরিক গঠনকারী হরমোন। এটার অভাবে পুরুষ দেখতে মেয়েদের মতো, আমি আবার বলছি একটু বেশি মাত্রায় মেয়েদের মতো হয়। আমি আগেই বহতার শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছি। মিলিয়ে নিন।

* কেমন করে বুঝবা? বলছি। বহতার সাথে মিলিয়ে দেখো মিলে কিনা?

- এরা অনেক লম্বা হয়,
- এক্সিলারী এবং এবং পিউবিক হেয়ার স্পার্স অর্থাৎ একটু পাতলা হয়,
- ব্রেষ্ট খুব সুগঠিত হয় তবে নিপল ছোট এবং
- এরিওলা সাদাটে হয়,
- ক্লাইটোরিস একটু এনলার্জড হয়। এটা মুলত অগঠিত পুরুষাঙ্গের পরিবর্তিত রুপ, নন ফাংশনিং আর
- অন্ডকোষ থাকে কুঁচকির গোড়ায়। কখনো কখনো তলপেটের ভিতরে। এটাকে বলে এক্টোপিক গোনাড।

* কত জনের হয়?
- প্রতি পাঁচ হাজারে একজনের হয়। পরিবারপরিজনদের মধ্যে অন্য কারো থাকতে পারে

* এদের চিকিৎসা কি?
- কাউন্সিলিং হচ্ছে সবচেয়ে বড় চিকিৎসা। কারন এরা ভেংগে পড়ে। মানতে পারে না। আসলে মানার কথাও না। শারীরিক বৃদ্ধি সম্পন্ন হলে এক্টোপিক গোনাড (টেস্টিস) ফেলে দিতে হয়। না হলে ক্যান্সার হওয়ার চান্স থাকে। সারা জীবন হরমোন দিতে হয় শরীরবৃত্তীয় কাজের জন্য না হলে অস্টিওপোরোসিস হওয়ার চান্স থাকে।

* বিয়ে করতে পারবে?
- হুম বিয়ে করতে পারবে। তবে এদের জননাঙ্গ অগঠিত থাকে। ভ্যাজাইনোপ্লাষ্টি নামক অপারেশনের মাধ্যমে যোনীপথ তৈরী করে দেয়া যায়। ফলে সেক্সুয়াল ফাংশন মেইনটেইন করতে পারে।

* বাচ্চা হবে?
- না। এদের জরায়ু থাকে না, ফলে পিরিয়ড/ মাসিক হয় না। বাচ্চাকাচ্চাও হয় না। বাচ্চাকাচ্চার কথা ওঠতেই বহতা ডুকরে কেঁদে ওঠল, আমার বাচ্চা... আদি আমাদের বাচ্চা... আদি...

আদি বহতার মাথা বুকে চেপে ফিসফিস করে বলছে, আমার কিছু লাগবে না, কিচ্ছু না, তুই ছাড়া...!

বহতারা আসলে সমাজে খুব একটা সমাদৃত হয় না। না অন্দরে না বাইরে অথচ এরা সমাজেরই একটি অংশ।

 

___________________________________________

 

Image may contain: 1 person

 

ডা.ছাবিকুন নাহার

 

____________________

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়