Ameen Qudir

Published:
2017-12-09 17:21:10 BdST

ডাক্তার, সমাজ আর মনগড়া কিছু গল্প


 




ডা: ক্রান্তিক রঞ্জন দত্ত
অর্থপেডিক হাউস-সার্জেন,
নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
কোলকাতা

_________________________________

 

 

ডাক্তার, নেগলিজেন্স আর মারধর - দ্য রিসেন্ট ট্রেন্ড আর ফ্যাশন |
এর জন্য কতটা দায়ী একজন ডাক্তার আর কতটা সমাজ ?
আর কতটা দায়ী মিডিয়া ?
নাকি সবাই দায়ী ?

ফার্স্ট ইয়ার এ প্রথম দিন শুনেছিলাম , আমরা নাকি ক্রিম অফ দ্য সোসাইটি , আমরা বাকি এভারেজ স্টুডেন্টদের থেকে উচ্চমেধার | হয়তো বা তাই | একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন উচ্চমেধাটা কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া না | জয়েন্ট দেওয়ার আগের বছরগুলো যখন আমরা দরজা বন্ধ করে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রস্তুতি নিয়েছি , তখন পাড়ার যে ছেলেটা রকে আড্ডা মেরে পাড়ার দাদা হওয়ার দিকে এক কদম এগিয়ে গেছে তার কি সত্যি অধিকার আছে আমার কলার ধরার ? নেই মনে হয় | কারণ ওই যে আমি ক্রীম আর ও সমাজের জঞ্জাল |

 


আমার কাছে বেশ আত্মমর্যাদার ব্যাপার মানছি , কিন্তু এই মানসিকতার একটা খারাপ দিক ও আছে |

এইভাবে আমরা নিজেদেরকে সমাজ থেকে একটু একটু করে আলাদা করে ফেলেছি | তখন মাটিতে পা রেখে চলতে অসুবিধে হয় |

ভাবুন শাহরুখ খান একটা মার্সিডিজ কিনলেন,লোকে বলবে কত স্ট্রাগল করে উঠে এসেছে লোকটা |সত্যি কথা নিঃসন্দেহে |কিন্তু একটা কম বয়সী ডাক্তার একটা দামি গাড়ি কিনলে তাকে টাকালোভী ঘুষখোর কমিশনভোগী এইসব শুনতে হয় |

আসলে এটাই হলো কমুনিকেশন গ্যাপটার ফল ,যেটা আমরা তৈরী করেছি |

 


এই দূরত্বটা আমাদের কমাতে হবে |আমাকে পাশের বাড়ির কাকুকে বোঝাতে হবে যে ডাক্তার মাত্রেই বায়োলজি পড়া ব্যবসায়ী নয়,প্যাথলজি ল্যাবের জামাই না | সেখানে আমাদের উচ্চমেধার ট্যাগ টা ছেঁটে ফেলতে হবে |

 

কিন্তু এটা একদিককার সল্যুশন |পাবলিক কেও বুঝতে হবে , একটা ছেলে বা মেয়ে ডাক্তার হওয়ার জন্য সমাজ থেকে ঠিক ততটাই সুযোগ সুবিধে পায় যতটা আর বাকি পাঁচটা সাধারণ ছেলেমেয়ে পায় | এফোর্ট আর স্ট্রাগল তাকে অসাধারণ বানায় , তাকে ডাক্তার বানায় |


একসময়ের নোবেল প্রফেশন আজ বিপন্ন |কোথাও গিয়ে মনে হয় এই হিংসা র পিছনে ঈর্ষা লুকিয়ে আছে |
ঈর্ষা খুব স্বাভাবিক জৈবিক ধর্ম |কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে এর প্রকাশটা অস্বাভাবিক হয়ে যায় |হিংসে আমরা তাদেরকেই করি , যাদের মান নাম যশ ঐশ্বর্য আমাদের চোখ টাটায়, যেমন ইন্ডিয়া ক্রিকেট টিমের ওই এগারোটা প্লেয়ার |স্বীকার করুন বা না করুন , আপনি বা আপনার ছেলে ওই নীল জার্সি পরে ছক্কা হাঁকাবেন , মনে মনে সেই স্বপ্ন দেখেন বৈকি |আর পূর্ণ না হওয়া স্বপ্নের বৃথা আস্ফালনটা চায়ের টেবিলে দেখান কোহলি যুবরাজদের শিরোচ্ছেদ করে |ভুলে যান যে, ওই এগারোজন নিজের নিজের কৃতিত্বে আজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে | হ্যাঁ আপনি সমালোচনা করতে পারেন , পুতুল পোড়াতে পারেন ,একশোবার পারেন |যেটা পারেননা সেটা হলো তার বাড়ি ভাঙচুর করতে |নেহাত প্লেয়ারটাকে হাতের কাছে পাননি ,না হলে তার হালটাও কোনোএক
হতভাগ্য ডাক্তারের মতোই হতো ।


|কি করে ভুলে যান মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে |কোনো নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূরণ না করলে তাকে থাপ্পড় মারেন ? আপনার ছেলে পরীক্ষায় ফেল করলে টিচারকে গালিগালাজ করেন ? পুলিশ চোর না ধরলে , শালা চোরের কাছে কমিশন খায় এই অপবাদে চড়াও হয়েছেন ? না আপনার কেস জিততে না পারা উকিলকে খিস্তি মেরেছেন ?
তবে ডাক্তারের জন্য পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেওয়ার আলাদা ব্যবস্থা কেন?

 

প্রশ্নটা কমন পড়ে গেছে না ! উত্তরটা তো আপনার মুখস্থ |আপনার ট্যাক্সের টাকায় কলেজে পড়ে আমরা ডাক্তার হয়েছি , সমাজ ইনভেস্ট করছে তো সমাজের প্রতি দায়িত্ব আছে বৈকি !
হক কথা |সমাজকে সার্ভিস দিতে আমাদের আপত্তি থাকার জায়গা নেই |কিন্তু প্রশ্নটা হলো বাকিদের দায়িত্ব নেই ?
স্কুলশিক্ষা তো অবৈতনিক, তবে প্রত্যেক টা শিক্ষিত লোকের উচিত সেই সামাজিক দায়িত্ব নেওয়া |আসুন তবে নতুন নিয়ম শুরু করি | পেশেন্ট দেখার জন্য ডাক্তার টাকা নেবে না , কেস লড়ার জন্য উকিল টাকা নেবেনা, টিচাররা বিনিপয়সায় ছাত্র পড়াবে, আর ইঞ্জিনিয়াররা কোটি টাকার বিদেশী অফার ছেড়ে দেশে থেকে সমাজসেবা করবে |শুধু তাই না , সমাজের ডিমান্ড ফুলফিল না হলে তাকে বাকিরা মিলে পিটিয়ে সিধে করে দেবে |তবে না একটা গণতান্ত্রিক সামঞ্জস্য আসবে |

 


দোষ দুতরফেই আছে | বাস্তবিক ভাবেই অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ব্যবহার অত্যন্ত মরমান্তিক | সবক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত না হলেও, এই ব্যবহার কখনওই কাম্য না;সে যতই কাজের চাপ থাকুক না কেন | মানুষ মানুষ আত্মিক যোগাযোগ ছাড়ুন, ব্যাড বিহেভিয়ার ইজ ব্যাড ফর বিজনেস | বিজনেস বলতে মনে পড়লো, কসাই ছাড়াও যে প্রেফিক্সটা আজকাল ডাক্তারদের নামের সাথে খুব চলছে সেটা হলো এই ব্যবসায়ী তকমাটা |
ডাক্তার টেস্ট ল্যাবের থেকে টাকা নিয়ে জামাকাপড় কেনে,ওষুধ দোকানের টাকায় বাড়িগাড়ি কেনে এমন দাবি লিফলেটে বিক্রি হয়, দাবির নৈতিকতা অবশ্য-ই বিচারয্য, কিন্তু অবিশ্বাসের ঘেরাটোপে চিকিৎসার মূল লক্ষ্যই গৌণ হয়ে যাচ্ছে|
ডাক্তার একটা জরুরী টেস্ট দেওয়ার আগে দশবার ভাবছে, রোগী ওষুধ খাওয়ার আগে চারটে জায়গায় কন্সাল্ট করছে, মাঝখান থেকে বিনাইন টিউমার ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যাচ্ছে |
আর এই জায়গায় যাদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেওয়ার কথা সেই মিডিয়া পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত|।

 

আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি খুব কম ডাক্তারকেই দেখবেন মিডিয়া নিয়ে ভালো কথা বলতে | আবার উলটোটাও সত্য, ডাক্তার দের ভুলটা যতোটা হাইলাইটেড হয়, সাফল্যগুলো নিয়ে লেখালেখি ততোটা হয়না - একথা খুব-ই সত্যি, আপনি মানুন বা না মানুন | আবার-ও বলবো দোষ কারোর একার নয়, সেই খবর -ই বেশি করে পরিবেশিত হয় যা পাব্লিক ডিমান্ড করে, কারন টা আগেই বলেছি কাস্টমার চটিয়ে বিজনেস হয় না | আর সমাজ চায় রোজ নতুন নতুন কেচ্ছা স্ক্যাম আর গল্পের কেন্দ্রে তাদেরকেই রাখতে চায় যারা কিছুটা হলেও আউট অফ দ্য লিগ, সে যে মাপকাঠিতেই হোক| আর আমরা সেই পাব্লিক ডিমান্ড - এর শিকার হয়ে পড়েছি নিজেদের তৈরি করা সোসাল স্ট্যাটাসের গ্যাঁড়াকলে |

 

স্পষ্টত-ই একটা গ্যাপ - ডিসবিলিফ থেকে তৈরি হওয়া ডিসরেস্পেক্ট একটা দূষিত পরিবেশ তৈরি করছে| তার উপর যোগ হচ্ছে প্রাইভেট হাস্পাতালের জোরজুলুমের গল্প, ভুয়ো ডাক্তারের জাল সার্টিফিকেটের এপিসোড | এই সবের মাঝে ভিলেন হয়ে রয়ে যাচ্ছে সেই ডাক্তাররাই |
আমরা কেনো ভুলে যাচ্ছি 'ডাক্তার' কোনো ভিনগ্রহের প্রানি না, আপনার পাশের বাড়ির মেয়েটা বা আপনার নিজের ছেলেটাও এই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া প্রফেশনটার সাথে যুক্ত কেউ হতেই পারে| আর এই বিশ্বাস টা ফিরিয়ে আনতে সবচেয়ে দরকারি ভুমিকা নিতে হবে কিন্তু মিডিয়াকেই | ব্রেইনওয়াশ করার কথা বলছি না, বলছি একটা সুস্থ পরিবেশ তৈরির কথা যেখানে আর কিছু না হোক দুপক্ষ র মধ্যে বিশ্বাসটা বজায় থাকবে, আর তাতে আখেরে লাভ সবার -ই | না হলে কে বলতে পারে অদূর ভবিষ্যৎ -এ এই জীবিকাটাই অবলুপ্ত হয়ে গেলো আর কোনো এক মুমূর্ষু রোগীর ডাক্তার দ্বারা সুস্থ হওয়ার গল্প নিছক মন গড়া ছেলেভোলানো গল্প হয়েই থেকে গেলো |

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়