Ameen Qudir

Published:
2016-11-08 16:28:00 BdST

নারীস্বাধীনতা নিয়ে নানা তর্ক


 


কবির আহমেদ

আদিতে নারী-পুরুষ ছিলনা, ছিল মানুষ। পরবর্তীতে সেই অখণ্ড মানবসত্তা নারী-পুরুষে বিভাজিত হয়।

ভাষা, লিঙ্গায়েত নির্মানে একটি শক্তিশালী প্রপঞ্চ:
ভাষা শুধুমাত্র একের সাথে অপরের যোগাযোগের মাধ্যমই নয়। ভাষা প্রতিনিয়ত সমাজ-বাস্তবতাকে নির্মাণ ও উপস্থাপনও করে বটে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভাষার বিন্যাসও হয়ে ওঠে পুরুষতান্ত্রিক। তাই ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে পুরুষ পক্ষপাত পুরুষকে ক্ষমতাবান আর নারীকে অধস্তনরূপে চিত্রিত করে। তাই ভাষা হয়ে ওঠে নারী-পুরুষের লিঙ্গায়েত নির্মানে বিশেষ একটি উপাদান। আর এই সাংস্কৃতিক ধারা নির্মানে নারী-পুরুষের ক্ষমতা-সম্পর্ক বিশেষ ভুমিকা রাখে। পুরুষ থাকে এই ক্ষমতা-সম্পর্কের কেন্দ্রে, নারীর অবস্থান প্রান্তে। অর্থাৎ ভাষার ব্যবহারে নারী-পুরুষের লিঙ্গায়েত পরিচয় নির্মাণে পুরুষতন্ত্র প্রচণ্ডভাবেই ক্রিয়াশীল।

প্রগৌতিহাসিক যুগে যখন মানুষ লজ্জা নিবারনের জন্য কোন আচ্ছাদন ব্যবহার করতোনা, শীত নিবারনের জন্য হয়তো পশুর চামড়া বা গাছের বাকল ব্যবহার করতো। যখন মানুষের ক্ষুধা ও যৌনতা ভিন্ন অন্য কোন ধারনা ছিলোনা। তখনও নিশ্চয় মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ধ্বনির ব্যবহার এবং ক্ষেত্র বিশেষে আকার ইঙ্গিতের প্রচলন ছিল বোধহয়। তখনকার সময়ে, মানুষ্য প্রজাতির যে শ্রেণী সন্তান প্রসব করতো তাদের কি কোন বিশেষ অর্থপূর্ণ শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা হতো?

ডারউইনীয় বিবর্তনের মতবাদ অনুসারে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হোমোস্যাপিয়েন্স শ্রেণীর মানুষের শরীর, মস্তিস্ক, বাকযন্ত্র, শ্রবণযন্ত্র ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয়েছে ধ্বনির উচ্চারণ ও শ্রবণের সামর্থ অর্জনের জন্য।
লুইস হেনরী মর্গান, তাঁর 'Ancient Society' বইতে, মানব সমাজের বিবর্তনকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন, ১) প্রাগরাজনৈতিক পর্ব, ২) রাজনৈতিক পর্ব। তিনি আবার প্রাগরাজনৈতিক স্তরকে বন্য ও বর্বর এই দুটি যুগে ভাগ করেছেন। বন্য যুগকে তিনি আবার তিন ভাগে ভাগ করেছেন; নিম্ন, মধ্য এবং উচ্চ অবস্থা। যাহোক সে অন্য আলোচনার বিষয়। আমাদের নির্দিষ্ট বিষয়ে আসা যাক।

এরকম কল্পানুমান (hypothesis) অযৌক্তিক নয় যে হোমোস্যাপিয়ান্স মানুষের বিবর্তনের প্রাগরাজনৈতিক স্তরে কোন এক সময়ে ধীরে ধীরে ভাষার উদ্ভব হয়েছে। লুইস হেনরী মর্গান এবং ফেডরিক এঙ্গেলস, দুজনেই মনে করেন যে, মানুষ স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে শিখেছিলো বন্য যুগের নিম্ন পর্যায়ে। অবশ্য এঙ্গেলসের মতে বন্য যুগের নিম্ন পর্যায় বহু হাজার বছর স্থায়ী হয়েছে। ধারনা করা যেতে পারে যে, এই পর্যায়ে মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করতো অর্থাৎ সমাজ গঠনের প্রাকপ্রস্তুতি পর্ব তখন শুরু হয়েছে। এই পর্যায়ে সমাজ গঠনে ভাষা নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে নাকি সমাজ গঠিত হবার কারণে ভাষার উদ্ভব হয়েছে, সে বিচার বড় দুরূহ।

নারী নিজের কাঠামোতে বাস করেনা, নারী বাস করে পুরুষের নির্মাণ করে দেওয়া কাঠামোর মধ্যে:

আমাদের ভাষা নির্মানের আদিকাল থেকেই শব্দের অর্থভেদে তার লিঙ্গায়েত পরিচয় নির্মিত হয়ে যায়। এই যেমন, শিশু জন্মের সময় লিঙ্গবান হলে অর্থাৎ তার শরীরে পুং-জনন চিহ্নটি থাকলে সে পুরুষ হিসাবে পরিচিতি পেয়ে যায়। নাম হয়, রাম, রহিম ইত্যাদি জাতিয়। আর শিশু জন্মের সময় তার পুং-জনন চিহ্নটির অনুপস্থতিতে তার শরীরে স্ত্রীজনন চিহ্ন থাকার কারণে সে যোনিবতী বা স্ত্রীজাতি, এবং তার নাম হয়, সীতা বা রহিমা। যেমন 'জন' নাম শুনলেই আমরা পুরুষ বুঝি আর 'মেরী' স্ত্রীলোক। সেই সুবাদে মলয় পুরুষ আর আয়নামতি নারী। আবার সুমন আর সাদিয়াও তাই বটে! মানুষের নাম দিয়ে যে ব্যক্তি পরিচয় সেখানেও ঐ নামের সাহায্যেই নারী-পুরুষের লিঙ্গায়েত চিহ্নিত হয়ে যায়।

মানব ভাষা একটা মুদ্রার মতো। যার দুটি দিক রয়েছে। একদিকে রয়েছে রূপ আর অপরদিকে অর্থ। রূপকের পোশাকী নাম দ্যোতক আর অর্থ হচ্ছে দ্যোতিত।
*(দ্যোতি বা দ্যোত: প্রকাশ, দীপ্তিশীল। দ্যোতক: প্রকাশক, ব্যঞ্জক, বাচক। দ্যোতিত: দীপিত, উদ্ভাসিত। বঙ্গীয় শব্দকোষ- হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়)
ব্যক্তি হিসাবে 'রাম', 'রহিম', 'সীতা', রহিমা', 'জন', 'মেরী', 'মলয়', 'আয়নামতি', 'সুমন', 'সাদিয়া' সবই হচ্ছে দ্যোতিত বা নির্দেশিত। পুরুষত্ব এবং নারীত্ব এঁদের সহজাত বা স্বকীয় বৈশিষ্ট। আর নামশব্দ হিসাবে এগুলো হচ্ছে দ্যোতক। দ্যোতিত বা নির্দেশিত একটি জাগতিক বাস্তবতা, দ্যোতক একটি ভাষিক বাস্তবতা। দ্যোতিতে যা দৈহিক চিহ্ন বা জনন চিহ্ন (sex) দ্যোতকে তা বৈয়াকরণিক চিহ্ন বা লিঙ্গ (gender)। একে অর্থনির্ভর লিঙ্গবিভাগও বলা হচ্ছে কারণ নামশব্দগুলো যেমন রাম, রহিম, সীতা, রহিমা, জন, মেরী, মলয়, আয়নামতি, সুমন, সাদিয়া এগুলোতে এমন চিহ্ন নেই যা দেখে এগুলোকে পুরুষ বা স্ত্রী নামশব্দ হিসাবে চেনা যায়। এগুলো পুরুষ বা স্ত্রী নামশব্দ কারণ এদের দ্যোতক/নির্দেশিত ব্যক্তিটি পুরুষ বা নারী।
এখানে শব্দের দ্যোতনা বা অর্থ অনুসারে শব্দটির লিঙ্গ নির্ধারিত হচ্ছে। আবার ভাষার বিশেষণের ব্যবহারেও মানুষের লিঙ্গায়েত পরিচয় চিহ্নিত হচ্ছে, যেমন, সুন্দর এবং সুন্দরী। আবার এমন কিছু জীব আছে যাদের যৌনচিহ্ন প্রকটিত নয়। এসব জীবের লিঙ্গিয় পরিচয় শব্দ দ্বারা চিহ্নিত নয়। যেমন, সাপ, তিমি, মাছ, মৌমাছি, মাছি, তেলাপোকা ইত্যাদি।

জীবনসঙ্গী হিসেবে স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়ে থাকে তবে পুরুষকে সেই অর্থে অর্ধাঙ্গি বলার রেওয়াজ নেই। পুরুষ সর্বদাই পূর্ণাঙ্গ। আরেকটি শব্দ 'সতী'। শব্দটি স্ত্রীবোধক। এর অর্থে বলা হয়, যে নারী বিয়ের আগে তার কুমারীত্ব রক্ষা করে এবং বিবাহ পরবর্তীকালে স্বামীর প্রতি সকল অর্থে বিশ্বস্ত থাকে। আদর্শ নারী হচ্ছে সতীসাধ্বী পতিব্রতা স্ত্রী। আর সৎ হচ্ছে পুরুষবাচক শব্দ। সৎ হতে হলে একজন পুরুষের যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একগামীতা বিষয়টা মুখ্য নয়। এখানে সততার পরিসর ব্যপক বিস্তৃত।

 

এখানে প্রধান বিষয়টি হলো সমাজে নারী ও পুরুষের লিঙ্গীয় ভুমিকা ভিন্নভাবে নির্মিত। নারীর সুন্দরী, আদুরে, হিংসুটে, মমতাময়ী, সহিষ্ণু, কোমল, ত্যাগী, অযৌক্তিক, বোকাসোকা, এইসব গৎবাঁধা ভূমিকার বিপরীতে পুরুষ হলো কঠোর, বুদ্ধিমান, সবজান্তা, সাহসী, শক্তিশালী, ব্যবস্থাপক প্রভৃতি বৈশিষ্টের অধিকারী যা অবশ্যই নারীর ভুমিকা হতে মর্যাদাসম্পন্ন, গুরুত্বপূর্ণ।

আবার সামাজীক স্তর ভেদে ভাষার ব্যবহারে ভিন্নতা দেখা যায়। নিম্নবর্গীয় মানুষের ভাষা আর উচ্চবর্গীয় মানুষের ভাষার ব্যবহারে বিস্তর ফারাক। এই উচ্চবর্গীয় শ্রেণীরই ভাষা বিনির্মানে কার্যকরী অংশীদারীত্ব। উচ্চবর্গীয় শ্রেণীর ব্যবহারিক ভাষা অনেকাংশে অলঙ্কারসম্বৃদ্ধ। নিম্নবর্গীয় জনসমষ্টির ভাষা ব্যবহারে সচরাচর তেমনটি দেখা যায়না। এই যেমন, মাগী, মিনসে আর ম্যাডাম, জনাবে যেমনটি পার্থক্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার লৌকিক ছড়াগুলি নিয়ে প্রবন্ধ রচনায় ছড়াগুলিকে আখ্যায়িত করলেন, 'ছেলেভুলানো ছড়া' শিশুভুলানো কিন্তু বলেননি। এই ছড়াগুলি এক ধরণের ঘুমপাড়ানি ছড়াই বটে, যা কিনা ছেলে-মেয়ে উভয় শ্রেণীর জন্যই প্রযোজ্য। এই ফোকলোর নিয়ে যাঁরা লেখেন, গবেষণা করেন তাঁদেরও ব্যক্তিক চিন্তা-চেতনের গহীনেও সেই পিতৃতান্ত্রিক ভাবধারার মানসিকতাই বিদ্যমান থাকে।

নারী সম্পর্কে বিশেষ কিছু উদ্ধৃতি:

"সাধ্বী স্ত্রী, পতিকে দেবতার তুল্য জ্ঞান করিবেন, ও দেবতাজ্ঞানে পূজা করিবেন।" (নারীধর্ম ও বিবাহ > নীলকন্ঠ মজুমদার এম, এ)

'আমরা যেমন বলে শ্রেষ্ঠ, মেয়েরা তেমনই রূপে শ্রেষ্ঠ; অন্তঃকরণের বিষয়ে আমরা যেমন বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ, মেয়েরা তেমনই হৃদয়ে শ্রেষ্ঠ; তাই স্ত্রী পুরুষ দুই জাতি পরস্পর পরস্পরকে অবলম্বন করতে পারছে। স্ত্রীলোকের বুদ্ধি পুরুষের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম বলে ... স্ত্রীশিক্ষা অত্যাবশ্যক এটা প্রমান করবার সময় স্ত্রীলোকের বুদ্ধি পুরুষের ঠিক সমান একথা গায়ের জোরে তোলবার কোন দরকার নেই।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

"যখন শারিরীক দুর্বলতা ও অলঙ্ঘনীয় অবস্থাভেদে মেয়েদের সেই গৃহের মধ্যে থাকতেই হবে তখন কাজে-কাজেই প্রাণধারণের জন্য পুরুষদের উপর তার নির্ভর করতেই হবে।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
"প্রকৃতিই রমনীকে বিশেষ কার্য্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া গৃহবাসিনী করিয়াছন-- পুরুষের সার্ব্বভৌমিক স্বার্থপরতা ও উৎপীড়ন নহে -- অতএব বাহিরের কর্ম দিলে তিনি সুখীও হইবেন না, সফলও হইবেন না।" (অনন্যা > রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

"নারী কিছু গুণের অভাববশতই নারী; আমরা মনে করি নারীস্বভাব স্বাভাবিকভাবেই বিকারগস্ত।" বলেছেন, বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্তোতল।

হুমায়ুন আহমদের 'এইসব দিনরাত্রি নাটকের সংলাপ, 'পুরুষ মানুষকে রান্নঘরে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়' অথবা, 'কাপড় মেলা মেয়েদের কাজ'।

'বলবীর্যশালী পুরুষ ভিন্ন অবলা নারীর গত্যন্তর নাই।'
যাক বাবা, বাঁচা গেল (এখানে 'বাবা' শব্দটির ব্যবহার দেখুন)
পুরুষ জননেন্দ্রিয়কে কেন 'সোনা' 'ধন' ইতাদি বলা হয়েছে! এ শব্দগুলি কি নারীগণের দ্বারা উদ্ভুত নাকি পুরুষেরাই তাদের জননেন্দ্রিয়টিকে মাহাত্ম্যপূর্ণ করতে এ ধরণের নামকরন করেছে!

এওতো সেই ভাষারই খেলা!

লেখক কবির আহমেদ বিশিষ্ট তাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদ।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়