Ameen Qudir

Published:
2017-10-12 22:07:41 BdST

" শুয়োরের বাচ্চা পয়দা করেছি "


 

 

 

রাজীব হোসাইন সরকার

________________________________

_____ শুয়োরের বাচ্চা পয়দা করেছি।
মোতালেব আলির গালির সর্বোচ্চ দৌড় ‘শুয়োরের বাচ্চা’ পর্যন্ত। এর বেশি আগাতে পারছেন না। স্ট্রোকের পর তার মস্তিষ্কের অনেকখানি অংশ বিকল হয়ে আছে। তার ধারণা, বিকল মস্তিষ্কের কোন এক অংশে তার সীমাহীন গালিভাণ্ডার জমে ছিল। মস্তিষ্ক বিকলের সাথেসাথে কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়া বামন গ্রহের মত গালিভাণ্ডারও হারিয়ে গেছে। বিপুল গালিভাণ্ডার এভাবে হারিয়ে যাওয়ায় তিনি বেশ অসহায় বোধ করলেন।
মোতালেব আলি দরিদ্র মানুষ। তিনমাস আগে পূর্বাভাস ছাড়াই হুট করে স্ট্রোক করেছেন। স্ট্রোকের প্রথম একমাস বেশ যত্নে ছিলেন। সার্বক্ষনিক স্ত্রী-সেবা ছিল। স্ত্রীর নাম হাজেরা বানু। হাজেরা বানু বেশ যত্ন করে দিনে দু’বার মাথায় তেল দিয়ে আচড়ে দিত। আয়না ধরে বলত,
‘বাপ্পীর বাপ, দেখেন কী সুন্দর লাগে। মাঝে সিঁথি কেটে দিছি। নবীজি মাঝে সিঁথি কাটতেন। ঠিক করছি না?’
একমাস লাগাতার সিঁথি কাটার পর একদিন ভোরে হাজেরা খাতুন মরে পড়ে রইল। মোতালেব আলি অনেক চেষ্টা করলেন স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ পুত্রকে জানাতে। একমাত্র পুত্রকে ক্রমাগত গলা ফাটিয়ে ডাকলেন।
‘বাপ্পী, ও বাপ্পী।’
কেউ শুনল না। সারারাত মৃত হাজেরা খাতুন বিছানায় তার মাথার পাশে পড়ে রইল। তার দুই চোখ খোলা।
মোতালেব সাহেব অসহায় হয়ে দেখলেন। শেষরাতে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছরের সাংসারিক সঙ্গীর লাশ পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।
স্ত্রীবিয়োগের পর এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ পিতা মোতালেব আলির দিনকাল ভোজবাজির মত বদলে গেল। অসুস্থতা আরো বাড়ল। গায়ের নিচে বড়বড় ঘা গজিয়ে গেল। বিছানায় পিশাপ করা শুরু করলেন। মাঝেমাঝে বড়টাও করে ফেলেন। নিজের মলমুত্র ও পাঁচিত ঘায়ের গন্ধে নিজেরই দম বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করল। তিনি মাঝেমাঝে বিষণ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে তার ছেলের বৌকেও ডাকেন। ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যান। ছেলের মত ছেলের বৌও আসে না।
চুড়ান্তরকম অবহেলাপ্রাপ্তির পর মোতালেব সাহেব পুত্রের নাম উচ্চারণ পুরোপুরি বন্ধ করলেন। বাপ্পী হয়ে গেল---- শুয়োরের বাচ্চা। নাম বদলের পর বিচ্ছিন্ন হাহাকারের মধ্যেও মোতালেব সাহেব নিরবিচ্ছিন্ন মানসিক প্রশান্তি বোধ করলেন।
শুক্রবার ভোরবেলা মোতালেব সাহেব ধারণা করলেন, আজ সম্ভবত বড়টা করে ফেলেছেন। গন্ধে থাকা যাচ্ছে না। কয়েকটা মাছি গায়ের উপর ওড়াউড়ি করছে। একটা বেশ পুরুষ্টু। পুরুষ্টু মাছির স্থানীয় নাম---- ডাঁশ মাছি। গরু ছাগলের গায়ে থাকে। মোতালেব সাহেব কয়েকবার উচ্চস্বরে বললেন ‘হুশ হুশ’।
ডাঁশ মাছি তাকে কোন পাত্তা দিল না। উড়তে উড়তে তার নাকের উপর বসে পড়ল। তিনি কয়েকবার সজোরে চিৎকার দিলেন।
‘শুয়োরের বাচ্চা। সবকটা শুয়োরের বাচ্চা পয়দা করেছি।’
বাপ্পী জবাব দেয় না।
মোতালেব আলি বুঝতে পারেন, বাপ্পী বাসায় আছে। রাত আটটা বাজে। এখন তার ছেলে বাসায় থাকে। নিশ্চয় তার বৌ তাকে আসতে দিচ্ছে না। তিনি একরাশ হতাশা নিয়ে বললেন,
‘শুয়োরের বাচ্চা।’
(২)
তার নাম মিজানুর রহমান।
বাবা তাকে বাপ্পী ডাকে। মিজান দীর্ঘদিন থেকে বাপ্পী নাম শুনতে পাচ্ছে না। বাবা অসুস্থ। হুট করে স্ট্রোক হবার পর জবান বন্ধ হয়ে গেছে। মিজান তার সীমিত সামর্থ্যে সর্বধরণের চিকিৎসা করছে। পিজিতে দেখিয়েছে। নাসিক্য বাক্যে ডাক্তার বলেছে,
‘বাঁচার আশা নেই। মাথার বিশাল অংশ পঁচে গেছে।’
মিজান বাবাকে তার চিরচেনা বাড়িতে ফিরিয়ে এনে কবিরাজ দেখাল। কয়েকজন জটাধারী ওঝা এসে হাত-পা টেপাটিপি করল। সারা গায়ে বেদম ঝাড়ু পেটা করে বড় অংকের টাকা নিয়ে চলে গেল। পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হল না। পিজির ডাক্তারের কথা অনুসরণ করে বাবার অবস্থা দিনদিন খারাপ হয়ে গেল।
মিজানের বাবা প্রথম থেকেই কথা বলতে পারত না। এখন নড়ানড়িও প্রায় বন্ধ। শুধু চোখ খোলা থাকে।
এক চৈত্রে বড়সড় ঝড় বয়ে গেল। চৈত্রের ঝড়কে কালচৈত্র বলে। কালচৈত্র মিজানের বাবার অসুস্থতার এক ফাঁকে হুট করে তার সুস্থ্য মাকে নিয়ে গেল। সারারাত অসুস্থ্য বাবার পাশে তার মৃত মা পড়ে রইল, সে জানতেই পারল না। তার জবানহীন বাবা শত চেষ্টা করেও মুখফুটে কোন শব্দ বের করে ডাকতে পারেনি।
দুপুরবেলা দরজা ভেঙ্গে দেখা গেল তার বাবার বিছানার একাংশে তার মা মাথা রেখে কী অদ্ভুত সুন্দর হয়ে ঘুমুচ্ছে। শীতল শরীর। ছড়ানো চুল। খোলা চোখ।
বাবার চিকিৎসা ব্যয় আকাশ ছুঁয়েছে। মিজান ছোট চাকুরি করে। স্থানীয় কোম্পানীর সেলসম্যান। সুর্যোদয়ের সময় ঘর ছাড়তে হয়, ফিরতে হয় রাত দুটোয়। ওভার টাইম ডিউটি। ঔষুধের চড়া দাম। কিনতে হবে। বাবার বিছানা পরিষ্কারের জন্য একটা কাজের মেয়ে রাখা হয়েছে। বেতনের অনেকটা অংশ চলে যায় মেয়েটার পেছনে। প্রতিদিন সকালে মেয়েটা সবকিছু ধুয়ে দেয়। আজকাল বাবা পায়খানা ধরে রাখতে পারেন না।
কয়েকদিন থেকে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তীক্ষ্ম যন্ত্রনায় বাবা দিনরাত ঘুমোয় না। গোঁগোঁ করে।
ডাক্তার ঔষুধ দিয়েছে। ঔষুধে যন্ত্রনার অস্থায়ী উপশম হয়। বিচিত্র ব্যাপার হল, ঔষুদের কল্যাণে তার বাবা ঘুমিয়ে যায় রাত বারোটায়, জেগে ওঠে সকাল দশটায়। এই নির্দিষ্ট সময়সীমায় মিজান নামক একটি উদভ্রান্ত চরিত্র সেলস ম্যানেজার নামক গালভরা পদবী নিয়ে মাঠে থাকে। এক মুদি দোকান থেকে আরেক মুদি দোকানে কক্ষপথহীন ধুমকেতুর মত ধুলো উড়িয়ে ছুটে বেড়ায়।
অতিব্যস্ততায় দীর্ঘদিন হল সে জাগ্রত বাবার সাথে দেখা করতে যেয়েও পারছে না। তার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক অসুস্থ্য বাবার সামনে বসে দু’চারটে ভালোমন্দ কথা বলে শীতল হবার সুতীব্র বাসনা নিয়ে জেগে থাকে। মিজানের ধারণা, তার অসুস্থ্য বাবা দিনকেদিন তার সন্তানে পরিণত হচ্ছে। দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর সে এখন তার অশীতিপর বাবার পিতার স্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। তার দায়িত্ব হল সন্তানের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলা,
‘ভয় পাচ্ছিস? পাশে আছি তো।’
মিজান রাতে ঘরে ফিরেও বাবার কাছে যেতে পারে না। বাবার ঘুম পাতলা। শব্দ পেলেই জেগে উঠবে। জেগে গেলে শুরু হবে কষ্ট। প্রবল যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাবে।
একমাস থেকে মিজান দুটোয় ঘরে ফেরার পর দূর্বল ও অক্ষম মানুষের মত বাবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। কিছুক্ষন অস্থির হয়ে ঘোরাঘুরি করে। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বাবার পাশে বসার সুতীব্র ইচ্ছা দমিয়ে রাখে। বাবার বিছানার এককোনে মায়ের মত মাথা রেখে ঘুমানোর ছোট্ট ইচ্ছায় অবচেতন মনে জল ঢেলে বড় করে। কোন একদিন সে ঘুমাবে। অবশ্যই ঘুমাবে।
রাত গভীর হলে মিজান শুতে যায়। ঘুম ধরে না। মোচড়ামুচড়ির এক পর্যায়ে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে চোখ ভরে ঘুম নামে। তখনই তার মনে হয় বাবা ডাকছে।--- এই বাপ্পী, এই... এদিকে আয়তো বাবা...
মিজানের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
শত চেষ্টাতেও ঘুম আসে না। বাবার ঘরের বন্ধ দরজার সামনে পায়চারী করে। দরজা ঠেলতে সাহস পায় না। অনাহুত উপদ্রবের মত যদি বাবা বিরক্ত হয়। ঘুম ভেঙ্গে অসহনীয় কষ্ট পায়?
একসময় সূর্য ওঠে। মিজান কাজে চলে যায়। বাবাকে তার দেখা হয় না। কথা বলা হয় না।
পরিশিষ্টঃ
ফেব্রুয়ারীর তেরো তারিখে তার বাবা প্রথম অসুস্থ হয়। এক মাসের মাথায় মার্চের পনের তারিখে মারা যায় মা। নিয়মিত বিরতির পর মে মাসের দশ তারিখে মোতালেব সাহেব মারা যান।
বাবার বিছানার এক কোণায় মাথা রেখে শুয়ে থাকার সুতীব্র ইচ্ছা অপুর্ণ থেকে যায় মিজানের। প্রকৃতির পরিকল্পনা বোঝা বড় মুশকিল। প্রকৃতির পরিকল্পনা রহস্য ভাবতে গিয়ে মিজানের মত অতি দরিদ্র ও অল্পশিক্ষিত মানুষের অনুর্বর মস্তিষ্ক মাঝেমাঝে উত্তপ্ত হয়।
প্রকৃতি জটিলতর পরিকল্পনাকারী। সেই পরিকল্পনায় মিজানের মাথা বা বাবার বিছানার ছোট্ট একটু অংশ নেই।

_______________________________________
.
রাজীব হোসাইন সরকার; ডাক্তার, সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়