Ameen Qudir

Published:
2017-09-07 18:53:23 BdST

এই পোস্ট কলোনিয়াল সময়ে নেটিভ মিস্টার স্কটদের লইয়া আমরা নেটিভ ডাক্তাররা কী করিব?


 

 

 

 


ডা. নাজিরুম মুবিন


_________________________________


অগ্নীশ্বর মুখোপাধ্যায়। ডাক্তার। আজ কালকের ডাক্তার নয়। তা ধরেন ৮০-৯০ বছর আগের কথা। ঔপনিবেশিক ভারতের ডাক্তার। সেই সময়ে ডাক্তারদের অবস্থা নিয়ে অগ্নীশ্বর বলেছিলেন-

“যখন ডাক্তারি পাশ করে বেরুলাম তখন মনে হয়েছিল এটা স্বাধীন ব্যবসা, এবার বোধহয় স্বাধীনতার আস্বাদ কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বুঝলুম, ও বাবা, এদেশে স্বাধীন ব্যবসা করা মানে সক্কলের মন রেখে চলা। পদি পিসি থেকে আরম্ভ করে গুরু ঠাকুর, দালাল, দোকানদার সক্কলের পায়ে তেল দিতে হবে। খোশামোদ করতে হবে গাঁয়ের কোয়াকদের, প্রতিযোগিতা করতে হবে কম্পাউন্ডার, হোমিওপ্যাথ আর কবরেজদের সঙ্গে। মাদুলি, কবচ, ওলাবিবি সক্কলের সঙ্গে আপোষ করে চলতে হবে। সামনে, পিছনে, ডানে, বাঁয়ে লোকে লাথাবে, অপমান করবে, তুমি টুঁ শব্দটি করতে পারবে না। দেখলাম এররকম স্বাধীন ব্যবসা করা আমার পোষাবে না। সুট সুট করে গিয়ে চাকরি নিলুম।”

অগ্নীশ্বর চাকরি নিলেন। সরকারি চাকরি। রেলের মেডিকেল অফিসার। দায়িত্ব বুঝে নিলেন ডাক্তার ঘোষালের কাছ থেকে।

ডাক্তার ঘোষাল ভালো লোক ছিলেন। বিনা পয়সায় সবাইকে দেখে দিতেন। সার্টিফিকেট দিতেন। যে যখন ডাকতো ছুটে যেতেন। কিন্তু সবাইকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে সবাইকেই তিনি অসন্তুষ্ট করে ফেললেন। মিথ্যা সার্টিফিকেট দেয়ার অভিযোগে রেলের বড়বাবুরা তাকে অপমান করে বদলি করে দেয়।

অগ্নীশ্বর তার আগের মেডিকেল অফিসারের মতো অতোটা নরম নন। নামের মতোই তিনি মূর্তিমান অগ্নিশিখা। এতোদিন যারা নিজেদের পদ পদবির বলে অন্যায় আবদার করে আসছিলেন তিনি সব আবদারে চাবুক হাঁকালেন। যা রেলের সব বাবুদের পিঠে জ্বালা ধরিয়ে দিল।

মিস্টার স্কট। রেলের ডিটিএস। তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। অগ্নীশ্বর গিয়ে তাকে দেখেও এসেছেন।

দিন দুই পর এক বেয়ারা মিস্টার স্কটের চিঠি নিয়ে আসলো।
“Doctor, come immediately. My wife is not feeling well.”
অগ্নীশ্বর তখন একটা জরুরি অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি স্কটের বাসায় গেলেন না। পাঠিয়ে দিলেন সাব এসিসটেন্ট সার্জন আবদুল লতিফকে।

আধাঘন্টা পর আবদুল লতিফ থমথমে মুখে ফিরে আসলেন। মিস্টার স্কট তাকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে আর ডাক্তার অগ্নীশ্বরকে এক্ষণই যেতে বলেছে।

ডাক্তার অগ্নীশ্বর এবারও গেলেন না। তিনি একটি চিঠিসহ একজন নার্স, চারজন বেয়ারা এবং একটি স্ট্রেচার পাঠিয়ে দিলেন। বলা বাহুল্য মিসেস স্কট স্ট্রেচার বাহিত হয়ে আসলেন না। তার পেটের একধারে সামান্য কুন কুন করছিল মাত্র। স্ট্রেচার যেতে যেতে সেটাও কমে গেল। কিন্তু রেলের ডিটিএস স্কট রেগে আগুন হয়ে গেলেন। তারা এই দেশের শাসক। সেখানে একজন নেটিভ মেডিকেল অফিসারের এতবড় স্পর্ধা হয় কী করে!

এক মিটিংয়ে ডিটিএস এবং অগ্নীশ্বরের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো। সবশেষে ডিটিএস বললেন, “দেখ ডাক্তার মুখার্জি, আমিই এই রেলওয়ের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা, আমি যদি ইচ্ছা করি, তোমাকে খুব বিপদে ফেলিতে পারি, এ কথাটি ভুলিও না।”
“না ভুলিব না, আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ নয়।” চোখে চোখ রেখে উত্তর দিয়েছিলেন অগ্নীশ্বর।

সাতদিন পরেই এক বিপর্যয় ঘটলো। ওই জংশনটি ছেড়ে প্রতিদিন কুড়িটি গাড়ি ছাড়তো। সেদিন একটা গাড়ি ছাড়ারও অবস্থা নেই। অগ্নীশ্বর সব ড্রাইভারদের সিক সার্টিফিকেট দিয়েছেন। একজনও বাড়তি ড্রাইভার নেই। ডিটিএস অফিসও বন্ধ হবার উপক্রম কারণ প্রায় সব কেরানি সিক সার্টিফিকেট পেয়েছে।

মিস্টার স্কট ছুটে আসলেন অগ্নীশ্বরের কাছে। এতজন লোক একসাথে অসুস্থ হওয়ার কারণ জানতে চাইলেন। ডাক্তার সাহেব চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছু পারাভাষিক শব্দ আওড়ালেন। ব্যতিবস্ত হয়ে স্কট বললেন-
“উহারা কি কাজ করিতে অক্ষম?”
“আমাদের শাস্ত্রানুসারে উহাদের শুইয়া থাকা উচিত। কিন্তু আপনি দণ্ড মুণ্ডের কর্তা, আপনি হুকুম করিলে হয়তো উহারা কাজে যোগ দিবে। তবে যদি কেহ মরিয়া যায় তাহার দায়িত্ব আপনার, আমার নয়। আমি উহাদের একজনকেও ফিট সার্টিফিকেট দিব না।”

মিস্টার স্কট অনন্যোপায় হয়ে অগ্নীশ্বরের চাকরির যিনি হর্তা কর্তা তাকে টেলিগ্রাম করলেন।
বড়কর্তা অগ্নীশ্বরের কাছে ব্যাপার কী তা জানতে চাইলেন। উত্তর এলো-
“ব্যাপার কিছুই নয়। আমি যাদের সিক মনে করেছি, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। এর জন্যই আমি মাইনে পাই। রেলগাড়ি চলবে কি না, ডিটিএস আপিস চলবে কি না, দ্যাট ইজ নট মাই কনসার্ন।”

ডাক্তার অগ্নীশ্বরের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিজের আত্মসম্মানের ব্যাপারে যতো টনটনে লোকই হন না কেন ডাক্তার হিসেবে তিনি ছিলেন অসামান্য। কিন্তু তার প্র্যাকটিস জমেনি কখনো। কখনো বদলির কারণে। কখনো রগচটা আচরণের কারণে। তিনি বলতেন, “ডাক্তারিও একটা আর্ট এবং তাকে আর্ট বলে কেউ কেউ হয়তো চিনতে পেরেছে। কিন্তু এদের কেউ পপুলার হবে না।”

ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে অগ্নীশ্বর চাকরি করেছেন। কুষ্ঠ হাসপাতালে কাজ করেছেন। হয়েছেন বিহারের সিভিল সার্জন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন অসহায় গরীব দুঃখীদের সাহায্য করেছেন। আবার নিজের পেশাজীবী পরিচয়ের উপর আঘাত আসলে পালটা আঘাত হেনেছেন।

ব্রিটিশ মিলিটারি ক্যাপ্টেনকে বোকা বানিয়ে এক স্বদেশীকে অপারেশন থিয়েটার থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। পতিতালয় থেকে সরস্বতীকে উদ্ধার করে সোহনলালের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। যক্ষ্মা রোগি সরমাকে নিয়ে যমদূতের সাথে টানাটানি করেছেন। সুছন্দা, রওশন আরার শেষ ইচ্ছা পূরণ করিয়েছেন। সাহিত্যিক সুবিমলের সাথে পুরাণের দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি শুধু ডাক্তার ছিলেন না। তার চেয়েও বেশি কিছু ছিলেন।

আমাদের এই সমাজ তো অগ্নীশ্বরের মতো ডাক্তার চায় না। তারা চায় ঘোষালের মতো ডাক্তার। চড়, থাপ্পড়, লাত্থি, গুঁতা যাই দেওয়া হোক না কেন সে যেন কোন প্রতিবাদ না করে। অগ্নীশ্বর তাই কোথাও মানিয়ে নিতে না পেরে ছেলেকে একটি চিঠি লিখে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন।

“আমি আর তোমাদের কাছে ফিরব না। চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখলুম তথাকথিত ভদ্রসমাজে কোথাও আমার স্থান নেই। কোথাও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলুম না। হতচ্ছাড়া দেশকে গালাগালি দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আবার হঠাৎ আবিষ্কার করেছি, এই দেশকেই ভালোবাসি শত দোষ সত্ত্বেও। এ দেশ ছেড়ে কোথা যাব। তাই ঠিক করেছি তোমরা যাদের অপাংক্তেয় করে রেখছো তাদের মধ্যে গিয়েই থাকবো।”

 

 

 

১৯৫৯ সালে প্রকাশিত বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) এর ‘অগ্নীশ্বর’ উপন্যাস পড়তে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম। ডাক্তার অগ্নীশ্বরের দৃষ্টি, চিন্তা ও কর্ম নিয়ে উপন্যাসের ব্যাপ্তি। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময়কার চিকিৎসা ব্যবস্থার কিছু চিত্র অনুষঙ্গ হিসেবে উপন্যাসে ঢুকে পড়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে আজ ২০১৭ সালে এসেও সেই চিত্রে কোন নরম তুলির আঁচড় পড়েনি বরং রঙগুলো চটে গিয়ে বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরো কদর্যরূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।

সরকারি ডাক্তার, বেসরকারি ডাক্তার, কর্পোরেট ডাক্তার, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার, বাংলাদেশের একজন ডাক্তারও কি ডাক্তারি পেশা নিয়ে অগ্নীশ্বরের জবানিকে, অগ্নীশ্বরের অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করতে পারবে? একজন? আমি নিশ্চিত পারবে না।

কিন্তু এতো ৩-৪ প্রজন্ম আগের কথা। বিগত ১০০ বছরেও আমরা আমাদের চারপাশের নোংরা আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করতে পারলাম না! উলটো অনেক ক্ষেত্রে আবর্জনাগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

কলোনিয়াল ইন্ডিয়া এদেশের মানুষকে দুইভাগে ভাগ করেছিল। এক, ব্রিটিশ সাহেব। দুই, নেটিভ ইন্ডিয়ান। সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবে ব্রিটিশরা। তারা চাওয়া মাত্র নেটিভরা তাদেরকে সার্ভ করতে বাধ্য থাকিবে। এটাই ছিল অলিখিত সংবিধান।

তাদের দুইশ বছরের শাসনকাল এই অঞ্চলের মানুষের মনস্তত্ত্বে আমূল পরিবর্তন আনে। এই অঞ্চলের অধিবাসীরাও এখন ব্রিটিশ সাহেব হতে চায়। বড় বড় পদে উঠে তারাও বাকি সবাইকে নেটিভ ইন্ডিয়ান জ্ঞান করে।

মিস্টার স্কট যেমন তার স্ত্রীর মামুলি সমস্যার জন্য ডাক্তার অগ্নীশ্বরকে আসতে বলেন। সে চিঠিতে একটা প্লিজ পর্যন্ত থাকে না। তেমনি আজকের পোস্ট কলোনিয়াল দিনে যেসব নেটিভ ইন্ডিয়ান স্কটের পদে অধিষ্ঠিত তারাও নেটিভ ডাক্তারদের ডেকে আনেন। একই আচরণ করেন।

আজ চারপাশে ডাক্তার ঘোষালরাই সংখ্যাই বেশি। আমার দৃষ্টিসীমায় আমি কোন অগ্নীশ্বর দেখি না। ওহ হ্যা। একজন অগ্নীশ্বরের গল্প শুনেছিলাম। উপজেলা হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসার (ইউএইচএফপিও) ছিলেন। সেখানকার উপজেলা নির্বাহি অফিসার (ইউএনও) ডাক্তারদের অকারণে বিরক্ত করতেন। মিস্টার স্কটের মতো।

সরকারি চাকরিজীবীদের অ্যানুয়াল কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট ( এসিআর) এ ডাক্তারদের কমেন্ট লাগে। সেই ইউএনও সাহেবের এসিআরে ডাক্তার সাহেব লিখেছিলেন, “He is a psychiatric patient. Unfit for his job.”
পরবর্তীতে সিভিল সার্জন এবং ডিসির মধ্যস্ততায় সেই এসিআর সংশোধন হয়।

দেশের মেরুদণ্ডহীন ডাক্তারদের কোমর-ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতে হলে অগ্নীশ্বর হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় অবশিষ্ট নেই। পঁচে গলে যাওয়া এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধুয়ে মুছে সাফ সুতরো করতে হলে আমাদের সবার একসাথে অগ্নীশ্বর হওয়া প্রয়োজন। এক দুইজন অগ্নীশ্বর হয়ে লাভ নেই। কারণ কারো সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে বন্ধু স্বজনহীন অগ্নীশ্বরদের জীবন কাটে বেশ কষ্টে। উপন্যাসের অগ্নীশ্বরের মতো।

[ইউএনও সাহেবরা আবার আমার উপর রেগে যাবেন না প্লিজ। আমার কর্মস্থলের ইউএনও সাহেব অতীব ভদ্র এবং ডাক্তারদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল]

[বোনাস-
প্রশ্নঃ অনারারি ডাক্তারদের অনাহারি ডাক্তার নামে কে, কবে, কোথায় অভিহিত করেছিলেন?
উত্তরঃ বলাই চাঁদ মুখোপাধায় (বনফুল) ১৯৫৯ সালে তার অগ্নীশ্বর উপন্যাসে।]

[এই উপন্যাস অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে। সেটার নামও ছিল অগ্নীশ্বর। নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার]

‘আমরা ডাক্তাররা কী করিব’ সিরিজের আজকের প্রশ্ন, এই পোস্ট কলোনিয়াল সময়ে নেটিভ মিস্টার স্কটদের লইয়া আমরা নেটিভ ডাক্তাররা কী করিব?

উৎসর্গঃ ৩৫তম বিসিএস হেলথ ক্যাডারের সহযোদ্ধারা।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়