Ameen Qudir

Published:
2017-08-12 18:29:59 BdST

"জিত কি বধাই হোতি হ্যায়, তো হার কা কিঁউ নহীঁ? "


 

 

 

কবি অরুণ চক্রবর্তী
___________________________

অনেক দিন আগের কথা। দিল্লিতে। মোটর বাইক চালিয়ে অফিস যাই। বাইকের নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। সে চালককে কিক মারতে দিয়েই তাকে পেশীবহুল করে ফেলে। তা চালক আমার মত হাড় সর্বস্ব হলেও। সম্ভবত এ জন্যেই আমি বাইক চালাতাম শিরদাঁড়া টান টান করে। মাথায় দামী শক্তপোক্ত হেলমেট। হাতে গ্লভস। এজন্য বাইকে চড়া-নামায় আমার একটা নিজস্ব স্টাইল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কলিগরা বলত, মনেই হয় না, তুই অফিসের টেবিলে ম্যানুস্ক্রিপ্ট আর লাল পেন হাতে এক কেরানী। তোকে বাইকে বেশ ডাকাবুকো লাগে। দেখলে ট্রাফিক পুলিশও নিশ্চয় ভয় পায়, কোন ভুলেই তোর চালান কাটার সাহস করবে না। আমিও জানতাম, ওদের অ্যাসেসমেন্টে এক ফোঁটা ভুল নেই। বাইক আরোহী আমার তাই কোনসময়েই শিরদাঁড়া বাঁকে না।

 

একদিন অফিসে রওনা হতে একটু দেরিই হয়ে গেল। তা ব’লে হুড়মুড়িয়ে বাইক দৌড়াচ্ছিলাম,তা নয়। তবে ৪০/৫০/৬০ স্পীডে স্টেডি। ডান বাঁ সোজা বাঁকা করে যাচ্ছিলাম। আউটার রিং রোডের ওপরে বামদিকের মালব্য নগরের টি পয়েন্ট। সেই বাঁ দিক থেকে একটা এম্ব্যাসাডার আউটার রিং রোড ধরে ডান দিকে বাঁকবে। আর আমি যাব সোজা। কিন্তু এম্বাসাডারের ড্রাইভার একবার তার গাড়ির চাকা থামাতেই আমি খানিকটা এগুই। এই সময় আবার চাকা ঘোরে, আবার থামে, আবার আমি এগুই, আবার চাকা ঘোরে… এই ভাবে বার কয়েক। এদিকে অফিস দেরি হয়ে যাচ্ছে।

 

মাথা গরম হয়ে গেল। আমার হাড়ে পেশী গজিয়ে গেল। ক্লিন্ট ইস্টউডের মত স্টাইলে বাইক থেকে নামি। বাইকটা একই স্টাইলে সাইড স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে ড্রাইভারের উইন্ডোর কাছে এগিয়ে যাই। অ্যাম্বাসাডের উইন্ডোর ছোট হয়। আমি গাড়ির পিছনের দিকে একটু সরে, জানলা দিয়ে ঠাস করে ড্রাইভারের গালে চড় কষাই, ‘এয়সে গাড়ি চালাতে হ্যায় ক্যা?’

 

সব্বোনাশ! দরজা খুলে যে ড্রাইভার বাইরে এলো, সে হরিয়ানভী। আমার থেকে ফুট খানেক লম্বা, দশাসই। বেরিয়েই ডানহাতের চেটো দিয়ে আমার হেলিমেটের কপালে ‘বাঞ্চোৎ!’ বলে এমন জোরে মারল, আমি মাথার ভারি হেলিমেট সমেত টাল সামলাতে সামলাতে তিন পাক খেয়ে ছিটকে ডিভাইডারের মাঝখানে চিৎপাত! মাথা ঝাঁকিয়ে তাকিয়ে দেখি, ড্রাইভারটা আমার দিকেই ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। অমনি আমি তড়িঘড়ি উঠে পাছার ধুলো ঝারতে ঝারতে বাইকে বসেই মারলাম কিক! কপাল ভালো, এক কিকেই স্টার্ট!
খুব লজ্জা পেলাম। মাটিতে মিশে যাবার জোগাড়। কানে বাজছে ড্রাইভারের ‘বাঞ্চোৎ!’ হুঙ্কার আর চোখের সামনে ভাসছে আমার তিন পাক খেয়ে চিৎপাত পড়ে যাওয়া। বাইকের গতি ধীর হয়ে গেল, আমার শিরদাঁড়া বেঁকে গেল, হাড় থেকে পেশীরা উধাও, কটাকট আওয়াজ শুনছিলাম যেন।

 

এইভাবে খানিকটা যেতেই মনে এলো, আচ্ছা আমি কি এই লজ্জার কথা কাউকে বলতে পারব? লোকে তো বুক ফুলিয়ে সাহসীকতার কথা গল্প করে, কিন্তু এক তরফা মার খেয়ে হেরো ডরপুক লজ্জার কথা বলা যায়? বলা যায় না।
অফিসে এসে টেবিলে বসি। চা আসে। কলিগরা হ্যালো হায় করে, রোজকার মত হা হা হি হিও। কিন্তু আমার কুন্ঠা কাটে না। শ্যুড আই অর শ্যুড আই নট?

 

পাশের ঘরে বসে হিন্দি এডিটর, নামী ছোটগল্পকার, পৃথ্বীরাজ মোঙ্গা। মজাদার ছেলে। ডেকে পাঠালাম। বললাম, লোকে নিজের সাহসিকতার কথা বলে, আজ তোমাকে শোনাব আমার লজ্জার কথা!
সব শুনে চুপ করে থাকল খানিক! পরক্ষণেই হাসির হুল্লোড় শুরু করে দিল।

 

ধীরে ধীরে দিনভর আমার লজ্জার কথা ছড়াতে লাগল এডিটোরিয়াল থেকে অ্যাকাউন্টস, সেখান থেকে সেলস, প্রোডাকশন সর্বত্র। কেউ কেউ এসে সরসে বধাইও দিতে লাগল। মোঙ্গা আমাকে বলল, জিত কি বধাই হোতি হ্যায়, তো হার কা কিঁউ নহীঁ?

____________________________

অন্তর্জাল থেকে কবির সৌজন্যে।

___________________________


অরুণ চক্রবর্তী । বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়