Ameen Qudir

Published:
2017-06-08 19:02:02 BdST

ভূয়ো ডাক্তার প্রথম পর্ব


 

 


রুপঙ্কর সরকার
____________________________

একটি ডিসক্লেমার – ব্যতিক্রম কখনই ‘নিয়ম’ হতে পারেনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিশ্চিতভাবে ওরিয়ে্নটাল সেমিনারি ও সম্ভবত সেন্ট ক্সেভিয়ার্স থেকে নাম কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। তবে তিনি যা রচনা করেছেন, তাই এখন মাস্টার্স বা পোস্ট ডক এর পাঠ্য অথবা গবেষণার বিষয়। তাই যাঁরা যাঁরা এই দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, তাঁরা সকলেই এমন লেখা লিখে নোবেল টোবেল এনেছেন, এমন সংবাদ নেই।

শয়ে শয়ে ভূয়ো ডাক্তারের মধ্যে আজ একজন আয়ুর্বেদ ডাক্তার কেন মেনস্ট্রীম ওষুধ লিখেছেন তাই নিয়ে টিভি সরগরম। সাংবাদিক মশাই জানেন কিনা জানিনা, এঁরা মেন্সট্রীম ডাক্তাদের পাশাপাশি ডাক্তারির পাঠ নেন মেডিক্যাল কলেজে। শুধু ফার্মাকোলজিটা বোধহয় আলাদা। আরও অনেক কিছুই আলাদা, তবে মলিকিউল লিখতে গেলে কি আর পুরনো বিদ্যে মনে থাকে? সবই তো ‘এম আর’ দের কিরিপা। তার মানে এই নয় যে সব মেনস্ট্রীম ডাক্তার এম আর নির্ভর। কিন্তু সার্টিফিকেটটা কি একেবারেই নির্ণায়ক?

দুটো উদাহরণ দিই। দেওয়ার আগে আবার সেই রবীন্দ্রনাথ ও ওরিয়েন্টাল সেমিনারি আউড়ে নিই।

আমি একজন কোয়্যাক ডাক্তারকে চিনি। তিনি কোয়্যাক ঠিক নন, সম্ভবত হোমিওপ্যাথ, মানে সেই বিষয়ে ডিগ্রীধারী। আমি তাঁর কাছে প্রায়ই যাই প্রেসার মাপাতে। তাঁর কাছে গেলে কুড়ি টাকা লাগে, আর একজন এমবিবিএস আছেন কাছাকাছি, তিনি নেন দেড়শ। মানে প্রেসার মাপা বলে নয়, ওটা চেম্বার ফী। এবার এই কোয়্যাক বা হোমিওপ্যাথ এর কাছে যখন যাই, তখন দেখি বিরাট ভিড়, আমাকে বসতেও হয় বেশ কিছুক্ষণ। তখন বিভিন্ন রোগির ‘ডায়াগনোসিস’, ক্লিনিকাল রিপোর্ট দেখা, এসব খুঁটিয়ে নজর করি। গত তিরিশ বছর ধরে কয়েকশো ‘স্পেশালিস্ট’ ডাক্তার ঘেঁটে ঘেঁটে (কেন তা আর লিখছিনা, যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন) আমি মোটামুটি বুঝতে পারি চিকিৎসা ঠিক দিকে যাচ্ছে কিনা। বহু, বহু ক্ষেত্রে আমার ও আমার পরিবারের ক্ষেত্রে কিছু ডাক্তারদের কাছে প্রথম ভিজিটটাই ‘শেষ’ ভিজিট হয়েছে এই কারণে। আমি অবাক হয়ে দেখি এই ২০/৩০ টাকার ডাক্তার ডায়াগনোজ করছেন যথাসম্ভব ঠিক। আর সামান্য হিসেবের বাইরে হলেই কোনও সরকারি হাসপাতালের নাম লিখে দিচ্ছেন। একদম রিস্ক নেওয়া নেই।

ইনি ‘প্র্যাকটিস’ করছেন বহুকাল। আমার ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল, পাড়ার লোকের উপদেশ মেনে এঁর কাছেই পাঠাতাম। তবে বলে দিতাম, যেন হোমিওপ্যাথিক ওষুধই দেন শুধু। আমার ছেলেমেয়েদের যে কোনও অসুখই ইনি সারিয়েছেন চুটকি বাজিয়ে। তবে অন্য লোকদের তিনি মেনস্ট্রীম মলিকিউলই লেখেন। যেহেতু পরিচিত এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর আছে, চাকরির সময়ে লীভ অ্যাপ্লিকেশন যখন তখন এনডর্স করিয়ে এনেছি।

এবার অন্য কথায় আসি। অনেককাল আগে একজন ‘পাশকরা ডাক্তার’ এ এলাকায় বসতেন। এখন তিনি আর চেম্বারে বসবার অবস্থায় নেই। তা যাই হোক, তিনিই তখন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। তাঁর ফী বেড়ে যায় বৎসরান্তে। কিছু বলার নেই, কারণ তিনি একজন প্রোফেশনাল মানুষ। তবে সেই যে কী একটা নিয়ম আছে না, সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার নিয়ম নাকি নেই, আমি অবশ্য সিওর নই। তখন উপায়ও ছিলনা, কারণ আগের গৃহচিকিৎসক নৃপেন চক্কোত্তি মশাই আর নেই ইহলোকে।

একবার পাড়ার ওষুধের দোকানে দাঁড়িয়ে আছি, তিনি এলেন, হেঁ হেঁ, কী খবর? আমি বললাম, ভাল। তা আপনার ইস্ত্রীর কী খবর? ওঁর উচ্চারণ এমনই। আমি বললাম, ক্রমাগত স্টেরয়েড খেয়ে নেক্রসিস হচ্ছে। উনি বললেন, হেঁ হেঁ, একটা ওষুধ বলে দিসসি, আপনার ডাক্তারকে বলবেন ডক্টর অমুক দিয়েসেন। আমি বললাম কীভাবে খাবে? উনি বললেন, টোয়াইস এ ডে, আফটার ফুড। আমার খানিক সন্দেহ হওয়াতে উনি চলে যাবার পর দোকানদারের কাছে ওষুধের ফ্ল্যাপটা চেয়ে পড়ে দেখলাম, সপ্তাহে একদিন খেতে হবে, একদম খালি পেটে। ওষুধ খেয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকতে হবে আধঘন্টা। আমার ডাক্তার বন্ধুরা নিশ্চয় বুঝছেন কী ওষুধ সেটা।

এর পরের গল্প, আমার মেয়ে এখন এমন হয়ে গেছে, আগে কিন্তু অসম্ভব মেধাবি ছিল, পড়াশোনা ছাড়াও বিভিন্ন এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাকটিভিটি, খেলাধূলো, ক্যারাটে, ছবি আঁকা, আবৃত্তি, প্রতিটি বিষয়ে না হলেও অনেক বিষয়েই স্টেট লেভেল উইনার। খালি গান গাইতে পারেনা।
তা সে মেয়ে এনসিসি করতে গেছে, ওয়েস্ট বেঙ্গল, সিকিম আর আন্দামানস এ চ্যাম্পিয়ন। এর পর ন্যাশনাল খেলতে যাবে। অনেক পরীক্ষা, লিখিত, মৌখিক, হর্স রাইডিং, শূটিং, ম্যাপ পয়েন্টিং, এছাড়া প্যারেড তো আছেই। তা সে পরীক্ষার একটা ফর্মে স্কুলের প্রিন্সিপালের সই লাগে, ফ্যামিলি ফিজিশয়ানের সই লাগে, এমন বেশ কিছু সই লাগে। বাকিগুলো করিয়ে নিয়ে গেছি তাঁর কাছে –
কী ব্যাপার? আমি বললাম, এই কলামে একটা সই করে দিন, আপনি ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান তো।
তিনি বললেন, আবার সই ঠই – বলে একখানা দিলেন আঁক কেটে।
আমি ফর্মটা নিয়ে চলে আসছি, তিনি বললেন, একী, আমার ফিস দিয়ে যান –
আমি বললাম, কিসের ফী? অ্যাজ পার মেডিকাল কাউন্সিল গাইডলাইনস, আপনি তো ফিজিকালি পেশেন্ট ইন্সপেক্ট না করে ফী নিতে পারেন না। তাছাড়া এটাতো ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের সিগনেচার, যিনি বাড়ির সবাইকে দেখেন -
তিনি হাত্টা সেই যে বাড়িয়েছেন, বাড়িয়েই আছেন – দিন দিন
আমি একটা একশটাকার নোট বাড়িয়ে ধরলাম, ভাবলাম গোটা চল্লিশ নিয়ে হয়ত বাকিটা ফেরত দেবে ( আর ‘দেবেন’ লেখা যাচ্ছেনা)
লোকটা বলল, কী দিচ্ছেন, আমার ফিস এখন দুশো, আমি এখন এস্পেশিয়ালিস্ট।
আমি বললাম, আপনার স্পেশালাইজেশন কী কাজে লাগল একটা সই তে?
লোকটা বলল, দিন দিন –
আমি বাঁ হাতে দুটো একশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়ে এসেছিলাম মেঝেতে। কুড়িয়েও নিল। সালটা ২০০০ । সতের বছর আগে দুশো টাকার ভ্যাল্যু কত ছিল যেন?

ভদ্রলোক(?) এর ফেভারে অনেক যুক্তি দেবেন হয়ত কেউ কেউ। আমি নিজের যুক্তি দিয়ে বিচার করব। অপরের ধার করে নয়। আমার মনে হয়েছে এটা অন্যায়, অযৌক্তিক।

সব মানছি, ভূয়ো চিকিৎসক ফিকিৎসক, কিন্তু যে সপ্তাহে একদিন খালিপেটে খাওয়ার ওষুধকে টোয়াইস ডেইলি আফটার ফুড বলতে পারে, (মানে এম আর কী বলেছেন একজন অর্থোপেডিককে, তাও ওভারহিয়ার করেছেন হাসপাতালে।) তার ডিগ্রীর মূল্য কী? আর তার ‘এস্পেশিয়ালাইজেশন’ এর?

অনেক কিছু লেখার আছে। যাঁরা যাঁরা রাগ করছেন, আমি নিতান্তই অনুতপ্ত তাঁদের কাছে। কিন্তু লেখাটা পোস্ট করবই।

______________________

 

 

রুপঙ্কর সরকার । বাংলার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়