Ameen Qudir
Published:2017-03-14 15:21:40 BdST
লেখক যোগেশ মাস্টারের মুখে কেন কালো তেল মাখালো ওরা !
তসলিমা নাসরিন
_________________________
কন্নড় ভাষার লেখক যোগেশ মাস্টারের মুখে কালো তেল মাখিয়ে দিয়েছে একদল কট্টর হিন্দু। ভারতে, কাউকে পছন্দ না হলে, তার মুখে কালি বা চুন -কালি মাখিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার ঐতিহ্য আছে। কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমামও একবার আমার মুখে চুন-কালি মাখানোর ফতোয়া দিয়েছিল, বলেছিল যে মাখাতে পারবে তাকে কুড়ি হাজার টাকা দেবে সে। মুসলিমরা অসহিষ্ণু। আল্লাহ রসুল নিয়ে কথা বললে এমন উন্মাদ হয়ে ওঠে যে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়, এমনকী প্রাণেও মেরে ফেলে। কিন্তু হিন্দুদের তিরিশ কোটি দেবতার সমালোচনা তো হিন্দুরাই করে। যোগেশ মাস্টার কোনও হিন্দু দেবতা নিয়ে তাঁর উপন্যাস 'দুন্ধি'তে কিছু লিখেছেন বলে তাঁকে এইভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে কেন? হিন্দুরা কি মুসলমান হয়ে যাচ্ছে? আই মীন কট্টর হিন্দুদের চরিত্র কট্টর মুসলমানের চরিত্রের মতো হয়ে যাচ্ছে কি? হিন্দুরা একশ একটা কুসংস্কার মানে ঠিক। এইভাবে অন্যের মুখে কালি ছিটিয়ে আকাশের দেবতাদের রক্ষা করতে কোনও হিন্দুকে আগে দেখিনি।
ভারত নিয়ে কত গর্ব করেছি এক সময়। এখন দেখছি, না উদারনৈতিক বামপন্থীরা পারফেক্ট, না ডানপন্থীরা পারফেক্ট। হিপোক্রেসি থিকথিক করছে চারদিকে। বাক স্বাধীনতার জন্য লড়বে সবাই। তবে যার যার পেয়ারের লোকের বাক স্বাধীনতার জন্য লড়বে। যোগেশ মাস্টারের মুখে যেহেতু কট্টর হিন্দুরা কালি লাগিয়েছে, কট্টর হিন্দু বিরোধী উদারনৈতিক বামপন্থীরা দিনভর চিৎকার করবে। ডানপন্থীরা যোগেশের বাক স্বাধীনতা নিয়ে রা-শব্দ করবে না। আর কারও মুখে যদি কোনও কট্টর মুসলিম কালি লেপে দিয়ে যায়, ধরা যাক আমার মুখেই, বামপন্থীগুলো দেখেও না দেখার ভান করবে, প্রতিবাদ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি সাধারন হিন্দুর পক্ষে দাঁড়ালেও, যেহেতু ডানপন্থী এবং কট্টর হিন্দুর সমালোচনা করি, আমাকে সমর্থন করতে ডানপন্থীরও দ্বিধা হবে। বাক স্বাধীনতা আসলে কোনও পক্ষই মানে না। মানলে শত্রু মিত্র সবার বাক স্বাধীনতাকে মানতো।
যাই হোক, যোগেশ মাস্টার নাকি হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন। আমার কথা হচ্ছে, দি্ন আঘাত, তাতে হয়েছেটা কী? অনুভূতির আঘাত পাওয়া চলবে না, এই দিব্যিটা কে দিয়েছে শুনি? অনুভূতি থাকলে আঘাত পাবেই। দিনে শতবার করে পাচ্ছে। আঘাত না পেলে সংবিত ফেরে না। আঘাত পেতে পেতেই আঘাত পাওয়াটা সহনীয় হয়ে ওঠে। আঘাত যত বেশি পায়, অনুভূতি তত শক্তপোক্ত হয়। 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যাবে না' -- এই অজুহাতে আজকাল অনুভূতির রাজনীতি চলে। এই রাজনীতি ব্যবহার করে মানুষকে বোবা বানিয়ে রাখা হচ্ছে, জরুরি বিষয় নিয়ে জরুরি তর্ক বিতর্ক করা যাচ্ছে না।
কারও অনুভূতিকে অক্ষত রাখা, অস্পৃশ্য রাখার দায়িত্ব কারওর নেই। তোমার অনুভূতির সমস্যা থাকলে তুমি সেটা সামলাও, তোমার সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব আমার নয়। তুমি শিশু নও ভায়া, তুমি প্রাপ্তবয়স্ক।
___________________________
তসলিমা নাসরিন । বিশ্ব বরেণ্য লেখক চিন্তক। ডাক্তারও। বিশ্বের প্রধান সকল ভাষায় তার লেখা প্রকাশ হয় নিয়মিত। প্রাক্তন: ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ।
আপনার মতামত দিন: