Ameen Qudir
Published:2017-03-13 16:58:41 BdST
খেয়োখেয়ি করে ইহকাল পরকাল ফর্সা করে ফেল
ডা. রেজাউল করীম
_______________________________
আসানসোল থেকে আসছি। পানাগডে এখন যে নতুন ব্রিজ হয়েছে সেখানে এসে বাস গেল থেমে। ভলভো বাসে বসার ব্যবস্থা ভালো, কিন্তু তবু বসে বসে আর সময় কাটছে না। ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। কিন্তু পাশের যাত্রীর চিৎকারে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। লোকটা অনেকক্ষন থেকে কারো সাথে সমানে কথা বলে যাচ্ছে। ২৮-৩০ বয়সের লোক, নিশ্চয় কোন মহিলার সাথে বাদানুবাদে জডিয়ে পড়েছে, দুএকবার যেন কাকুতিমিনতি করতেও শুনলাম। বাস থেকে প্রায় সবাই নেমে গেছে, আমরা দুজন যজ্ঞির প্রনামী সামলাচ্ছি। এবার ওর কথা আমি বেশ শুনতে পারছি। এতক্ষনে ও ফোনটা রাখল। আমি বললাম- এতক্ষন ফোনে কথা বলা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। ও বোধহয় কারো সাথে কথা বলে মনটা হাল্কা করতে চাইছিল, তাই আমার কথা শুনে যা বলল আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। ও হিন্দি বাঙলা মিশিয়ে যা বলল-
আমি ইস্কোতে মাল সাপ্লাই দিই। আগে একট্রাক মাল কারখানায় ঢুকলে পাঁচ হাজার টাকা প্রনামী দিতে হত। ও আমাদের অলিখিত নিয়ম, সবাই দেয়, আমিও দিই। এবার কি হয়েছে জানেন- দাদার লোক এসে বলল, পাঁচ হাজার দিন। দিয়ে দিয়েছি, কোন প্রশ্ন না করে। এখন আর একটা দল এসেছে, ওরা আরো টাকা চাইছে। দিতে চায় নি। মাল আনলোড করার জন্য লোক লাগিয়েছিলাম- সবাই পালিয়ে গেছে। টাকা না দিলে মাল আনলোড বন্ধ। আমি বললাম- দুদিন বন্ধই নাহয় থাকল। "কি যে বলেন দাদা, একদিন মাল আনলোড না করলে ট্রান্সপোর্টকে ১৫০০০ টাকা ফাইন দিতে হবে। আমি তো বরবাদ হয়ে যাব।"
-ওরা কত চাইছে?
-এখন ২০০০০ হাজারে রফা করলাম। এভাবে চললে, ব্যবসা লাটে উঠবে।
এর মধ্যে কোন পার্টি ফার্টির ব্যাপার আছে নাকি?
- পার্টি তো এখানে একটাই- মাফিয়া পার্টি। যে দল ক্ষমতায় তার সাথেই ওদের দোস্তি।
বাস আবার চলতে শুরু করেছে। আধো অন্ধকার ফুঁডে দ্রুত কলকাতার দিকে ছুটে যাচ্ছে বাস। আমি ভাবছিলাম- কি দুর্ভাগা দেশে আমরা বাস করি, একটা মানুষ যদি সৎভাবে রোজগার করতে চায়। তাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা না ব্যবসায়ীর জাত। চাঁদ সদাগর সপ্তডিঙা নিয়ে ব্যবসা করতে যেতেন। এই কি সেই বাংলা যেখানে প্রকৃতির অকৃপণ সম্পদে আমরা সমৃদ্ধ হতাম!
মহাভারতের সভাপর্বে মহামতি নারদ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যশাসন নিয়ে নানারকম উপদেশ দিয়েছিলেন। তার প্রত্যেকটিই আধুনিকতার বিচারেও আদৃত হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে, সন্দেহ নেই। তাঁর একটি বাক্যমাত্র আমি উদ্ধৃত করতে চাই-" হে মহারাজ, আপনি ত আভ্যন্তরিক ও বাহ্য জনগন থেকে আপনাকে, আত্মীয় লোক হইতে থেকে তাহাদিগকে এবং পরস্পর হইতে পরস্পরকে রক্ষা করিয়া থাকেন"। রাজ্য শাসনের প্রাথমিক পাঠ তো এখান থেকেই শুরু হওয়া উচিত।
বঙ্কিমচন্দ্র মহাশয় বঙ্গদেশের কৃষক প্রবন্ধে খাজনার একটি তালিকা দিয়েছিলেন (বঙ্গাব্দ ১২৭৮)তা এখানে উল্লেখ করতে চাই এটা বোঝানোর জন্য যে দেশীয় সংস্কৃতির বিকার কালে কালে আমাদের কোন অতল পাতালে নিয়ে যাচ্ছে। এ হিসাবের সাথে মাল আনলোড-সেলামী তুলনা করলেই বোঝা যাবে- কেন আমরা কাঁকডার জাত, জগত-পৃথিবী এগোবে কিন্তু আমাদের যে তিমির সেই তিমির। আমরা ফেসবুকে তিমির বিনাশী কিন্তু আদতে তিমির আমাদের প্রিয়তম সখা, বন্ধু, সুহৃদ। ১২৭৮ র সেই হিসেব
নায়েবের পুণ্যাহের নজর। ৬,
জমিদারগনের পাঁচশরিকের নজর ৫,
গোমস্তাদিগের নজর। ২,
পুন্যহের পেয়াদার তলবানা। ১,
গোপালনগরে বাঁশ ঢালাইয়ের খরচ। ১,
আষাঢ় কিস্তির পেয়াদার তলবানা। ১।।০
ভাদ্রের কিস্তির পেয়াদার তলবানা। ১।।০
নৌকো ভাড়া। ১।।০
সদর আমলার পূজার পার্বণী। ৬।।০
কাছারির জমাদার। ১,
কাছারির হালশাহানা। ১,
পাঁচ শরিকের পার্বণী। ৫,
শ্রীরাম সেন, হেড মহুরি। ১,
জমিদারের পুরোহিতের ভিক্ষে। ১২,
গোমস্তাদের ভিক্ষে। ৩,
মুহুরিদের ভিক্ষে। ৩,
রককান্দজদের দোলের পার্বণী। ১,
জমিদারের কন্যার বিবাহ। ৪০,
মোট ৯৪ টাকা। হাতে রইল ৬ টাকা। তা নিয়েই যত খুশি পায়রা ওড়াও, খেয়োখেয়ি করে ইহকাল পরকাল ফর্সা করে ফেল। এখনো সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। নামগুলোর আর পদবীগুলি পাল্টে গেছে- বাকি সব এক। " বুঝহ বাঙালী কেন কাঙালীর জাত"।
_______________________________
ডা. রেজাউল করীম । বাংলা র প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক। সুপন্ডিত।
আপনার মতামত দিন: