Ameen Qudir

Published:
2017-02-25 15:01:14 BdST

ডাক্তার বনাম সংবাদপত্র


ডা. আবু হেনা

________________________________

এক সময় সংবাদপত্র সাংবাদিকদের মাধ্যমেই পরিচালিত হতো । আমার জন্মের আগে মরহুম তোফাজ্জল হোসেন ( মানিক মিয়া নামে পরিচিত ছিলেন ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইত্তেফাক , আমার জানা মতে সত্তর দশকে সবচেয়ে বেশী প্রচারিত সংবাদ পত্র ছিলো ।


ঐ সময়ে ভয়েস অব আমেরিকায় খবর পড়তেন কাফী খান , মাসুমা খাতুন , দাউদ খান মজলিস , সরকার কবীর উদ্দিন প্রমুখ । ঐ সময় খুব সামান্য সংখ্যক সংবাদ মাধ্যম ছিলো এবং যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষিত মানুষরাই এই পেশায় ছিলেন । বিবিসির মার্কটালীর কথা নিশ্চয় মনে আছে সবার । আশির দশকের শেষের দিকে মানুষ কিন্তু বিবিসির বাংলার খবরই বিশ্বাস করতো ।


গেলো ২৫ বছরে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশে অনেক কর্পোরেট হাউজের জন্ম হয়েছে । এবং এরা মিডিয়া নামের শক্তিশালী মাধ্যমটা দখলে নিয়ে গেছে । এখন তাদের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট থাকতে পারে । ভারতীয় / ব্যাংকক/সিংগাপুরের ডাক্তারদের ব্যাবসা প্রসারে তারা আগ্রহী হতে পারে ।

সেই তর্কে আমি যাবো না । আমি আমার দেশ এবং বিদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পর্যবেক্ষণ লিখলাম । এটার সাথে আপনারা এক মত হতেও পারেন আবার নাও হতে পারেন ।

 

আমি ডাক্তার প্রসংগে আসার আগে একটি কথা বলি । সাংবাদিকরা পেপারে লিখবেনই । ওটাই তাদের কাজ । সংবাদের পিছনের সংবাদ খুঁজে বের করা সাংবাদিকতার একটি মেরিটরিয়াস দিক । সাংবাদিকরা অবশ্য অনেক সময় নিউজ ম্যানুফেকচার করেন । যেমন ইরাক আক্রমনের আগে সিএনএন ,” উইপন অব মাস্ ডেসট্রাকশানের “ গল্প ফেঁদেছিলো এবং যে সংবাদ ধরে মার্কিনীরা ইরাক দখল করেছিলো , এতো বছর পরে প্রমানিত হয়েছে যে ঐ খবরটা ভূয়া ছিলো ।

কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে । ইরাক আক্রমন করে মার্কিনীরা বোলতার চাঁকে হাত দিয়ে বোলতাগুলোকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে । পুরো এলাকাটাই এখন অস্থিতিশীল হয়ে গেছে ।


যাক ওসব , ওটা আমার লিখার বিষয় না ।
সৌদি আরবে কর্মরত বিদেশী / সৌদি ,ডাক্তার /নার্স/ মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট / ফার্মাসিষ্ট সবাইকে প্রতি দুবছর অন্তর অন্তর তার বেসিক লাইফ সাপোর্ট ( বিএলএস) ট্রেনীং আপডেট করতে হয় । আর যারা জরুরী বিভাগে কাজ করেন ,তাদেরকে এসিএলএস মানে এডভান্স লাইফ সাপোর্ট সিষ্টেম লাইসেন্স দুবছর পর পর নবায়ন করতে হয় ।


এটা না থাকলে সে চাকুরী বা প্রাকটিস কিছুই করতে পারবে না । এখানে ডাক্তার/ নার্সদেরও ভুল/অবহেলার জন্য শাস্তি হয় । সেটা অর্থ দন্ড থেকে লাইসেন্স ক্যানসেল পর্যন্ত হতে পারে । তবে সবারই ম্যাল প্র্যাকটিস ইন্সুরেন্স করা থাকে এবং অর্থ দন্ড হলে সংস্লিষ্ট ইন্সুরেন্স কোম্পানী টাকাটা পরিশোধ করে দেয় । তবে গ্রস ন্যাগলিজেন্স প্রমানিত হলে লাইসেন্সই ক্যানসেল হয়ে যায় । তবে কোনো চিকিৎসাকর্মীকেই কেউ শারিরীক নিগ্রহ করে না । আইন দ্বারা সুরক্ষা দেয়া আছে চিকিৎসা কর্মীদের ।


আর এ বিষয়গুলো তদন্ত করার জন্য কমিটি আছে , যার সদস্য হলো ডাক্তার ( সৌদি+ বিদেশী ) এবং বিচার বিভাগের(সৌদি) জনশক্তি । যাদের রিপোর্টের উপরই রিপোর্ট নির্ভর করে ।
বাংলাদেশে ক্লিনিক/ প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে বিনা কারনে শুধু টাকার জন্য তারা রোগীদেরকে আটকিয়ে রাখে , আইসিইউ তে ঢুকায় , প্রয়োজন ছাড়া সিজারিয়ান সেকশান করে থাকে । এগুলোর সত্যতা কতটুকু সেটা কি ডাক্তাররা খুঁজে দেখেছেন কখনো ?

আইসিইউ থেকে ফিরে আসা রোগীর সংখ্যা খুবই কম । এবং সর্বোপরি এর চিকিৎসা খরচ অকল্পনীয় । দেখা যায় যে রোগী তো মারা গেলই , পরিবারটিও পথে বসে গেলো আইসিইউ এর খরচ শোধ করতে যেয়ে ।আইসিইউ তে তখনই ঢোকানো হয় যখন রোগীর মাল্টিপল অরগান ফেইল করে , ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয় , কৃত্রিমভাবে যন্ত্রের সাহায্যে তার শ্বাসপ্রশ্বাসক্রিয়া চালিয়ে রাখা হয় ।

যেহেতু রোগীর বাঁচার সম্ভবনা খুবই কম থাকে , এক্ষত্রে কি রোগীর আত্মীয়দের ধারনা দেওয়া হয় ? যে দেখুন এটা খুবই ব্যায়বহুল চিকিৎসা এবং তারপরেও সাফল্যের সম্ভবনা ক্ষীন । আপনারা কি পারবেন এই খরচ বহন করতে এবং চান্স নিবেন ? না , এ কথা শতকরা নব্বই ভাই ক্ষেত্রেই বলা হয় না ।এবং শেষে রোগীর পরিবারের আম আর ছালা দুটোই যায় । ফলে পাবলিকের মধ্যে ক্ষোভ তৈরী হবেই । কারন মানুষ আর শেষ সম্বল সবই গেলো ।
আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে সৌদি আরবে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সমস্ত চিকিৎসা ব্যাবস্থা সম্পূর্ন ফ্রী এবং এমন কি জেলা হাসপাতালগুলোও আইসিইউ ইউনিট সজ্জিত । রিয়াদের আল শামোসি হাসপাতালে শুধু মাত্র আইসিইউতে ২৫০ বেড আছে । এছাড়া পুরো রিয়াদ শহরের অন্যান্য হাসপাতাল ধরলে এই সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি হবে । অথচ রিয়াদ শহরের জনসংখ্যার চাইতে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা অন্তত পক্ষে বিশগুন বেশী ।


বাংলাদেশে যতগুলো সিজারিয়ান সেকশান করা হয় বছরে , সেগুলোর সম্পর্কে কি কোনো স্টাডি হয়েছে ? যে ,কত পার্সেন্ট অপারেশান যৌক্তিকভাবে করা হয় ? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবেন না । বাংলাদেশের ডাক্তাররা নিয়মিত ঔষধ কোম্পানীগুলোর কাছে থেকে প্রকাশ্য / অপ্রকাশ্য উপঢৌকন নিয়ে থাকেন বলে জন মনে পারসেপশান আছে ।এটা বিদেশে সেমিনার / সপরিবারে বিদেশ ভ্রমন থেকে শুরু করে মেয়ের বিয়ের গয়নাগাটি /উপহার পর্যন্ত হয়ে থাকে ।

আর ক্লিনিক / ডায়েগনষ্টিক ল্যাব থেকে পারসেন্টেজ খাওয়া এগুলোও এখন অপেন সিক্রেট । সাংবাদিকরা এগুলো তো রসালো করে ছাপবেনই ।
একটা কথা মনে রাখবেন যে ট্রূথ আর ফ্যাক্টস্ কিন্তু এক জিনিষ নয় । আর মানুষ ফ্যাক্টস্ জিনিসটাই বিশ্বাস করে , তারা ট্রুথ খুঁজতে যায় না ।


তরুন ডাক্তারদের অনুযোগ হলো যে বিশেষজ্ঞ তৈরীর কারখানা বিসিপিএস হলো ফেল করানোর কারখানা । কারন এখানে বছরের পর বছর তরুন ডাক্তাররা শুধু পরীক্ষাই দিয়ে যায় ,মোটা অংকের টাকা পরীক্ষা ফী দিয়ে কিন্তু পাশ আর হয় না ।

অথচ এমনও ঘটনা আছে যে ঢাকায় পাশ করতে না পেরে লন্ডনে যেয়ে এমআরসিপি/ এফআরসিএস পাশ করে গেছে সেই একই পরীক্ষার্থী । তাহলে গলদটা কোথায় ? গলদ হলো তাদেরকে পড়াচ্ছেন বা ট্রেনিং দিচ্ছেন যারা , তারা হয় পড়ানোর/ ট্রেনিং দেবার যোগ্যতা রাখেন না অথবা ইচ্ছা করে আপটু দ্যা লেভেল জ্ঞান দান করেন না , যাতে করে তাদের ফিল্ডে কম্পিটিটর আসে ! এবং তারাই আবার পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশানের পরীক্ষক !

 

ডাক্তারদের মধ্যে যারা উঁচু পর্যায়ে আছেন , তারা হলেন মেরুদন্ডহীন । তারা ভাবেন , কিছু বললে যদি আবার ঢাকার বাইরে বদলী করে দেয় ! মার খাচ্ছে তো জুনিয়াররা , আমার কি সমস্যা ! তারা ব্যাস্ত দুই রাজনৈতিক দলের দুই ভাগ আর বিএমএ নিয়ে । মূলত পোষ্টিং আর পদ ঠিক রাখার জন্য । তারা কখনোই মূল বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরবেন না । কখনোই দাবী তুলবেন না যে ম্যালপ্র্যাকটিস ইন্সুরেন্স চালু হোক ।


শক্তিশালী নন বায়াজড্ মেডিক্যাল কমিটি তৈরী হোক । কারন তা হলে যে অনেক থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে !


সুতরাং আগে নিজেদের ভিতরের ঘুন পোকাটাকে মেরে ফেলে তারপর ওমুক পত্রিকা/ অমুক কোম্পানিকে বয়কট করার কথা বলতে হবে । তা না হলে যাহা লাউ তাহাই কদু থেকে যাবে । বাংলাদেশের সমাজ থেকেই ডাক্তাররা উঠে এসেছে । তারা কেউই এলিয়েন নয় । সমাজের ভিতরের অসততা , অনৈতিকতা এবং অনিয়ম তাদেরকেও কলুষিত করে অবধারিত ভাবে । এখন সমাজ বিজ্ঞানীদের এ বিষয়টা নিয়ে গবেষনা করতে হবে ।
মনে রাখবেন অসীর চাইতে মসীর শক্তি অনেক বেশী ।

________________________________


ডা. আবু হেনা । সৌদী আরবে কর্মরত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়