Ameen Qudir

Published:
2018-08-07 18:59:03 BdST

সবসময় সত্যি বলতে নেই


 

 

প্রীতম মন্ডল। ইনটার্ন চিকিৎসক।
_________________________________

ডাক্তারি পড়তে এসে ফার্স্ট ইয়ারে মড়া কাটতে গিয়ে মনে হতো আর কি ই বা দেখার বাকি আছে জীবনে! যেখানে 'রিং' মুভিটা দেখার পর একমাস রাত্রে ঘরের লাইট জ্বেলে ঘুমিয়েছি, ভয়ে টিভির দিকে তাকাইনি, সেখানে ডেড বডি খ্যাঁচ করে ধরছি আর ঘ্যাঁচ করে কাটছি! বুকে কোনো ভয়ের চিন্হ মাত্র নেই, চোখে মুখে একটা " ইইয়া! ডান ইট ম্যান!" স্ট্যাম্প নিয়ে কলার উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। মনে হত এর থেকে বিস্ময়কর আর কিছু হয়না পৃথিবীতে। তারপর যত দিন গেছে , কলেজের প্রত্যেকটা রংচটা করিডোরে লুকোনো মানব শরীরের রহস্যময় মায়াজাল পড়েছি, ছুঁয়ে দেখেছি হৃৎস্পন্দন। আসতে আসতে শরীর নামক উপন্যাস টা পড়তে পড়তে অনেক দূর চলে গেছি। যতই এগোই পরের পাতায় আরেকটা বিস্ময় এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যতো বাঁক ঘুরি ততই অবাক করা ব্যাপার হুশ করে সামনে এসে চোখ ছানা বড়া করে দিয়ে চলে যায়। নতুন করে কাজে লেগে পড়ার স্বাদ পাই।
ইউ এস জি রুমে বসে বসে রিপোর্ট লিখছি। একটার পর একটা পেশেন্ট আসছে, ইউ এস জি হচ্ছে এবং চলে যাচ্ছে। কোনো বিরাম নেই। বেলা দুটোর সময় একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। রোগা পাতলা শরীর, চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। ঘুম পাড়ানি ছোট ছোট চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মেয়েটা, মাথাটা নোয়ানো এবং থুতনিটা বুকের দিকে নামানো। বয়স সাত বছর। আমি বললাম, " ও কি হাঁটতে পারে না?"
" না ডাক্তারবাবু, হাঁটতে পারছে না।" উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।
" কি হয়েছে ওর?"
" আজ্ঞে এই কদিন হলো জ্বর, গায়ে হাত পায়ে ব্যাথা, গলা তুলতে পারছেনা, আর কিছু খেতে পারছেনা!"
" আচ্ছা ঠিক আছে, ওকে শুইয়ে দিন ওই বিছানাটায়" আমি বিছানার দিকে ইঙ্গিত করে বললাম।
সিস্টার দিদি কাগজ দেওয়ার পর দেখলাম ওর হোল অ্যবডোমেনের সাথে সাথে চেস্ট এবং বুকের সামনের দিকের ওয়াল এবং গলার ইউ এস জি করতে হবে। সেইমত আমি রিপোর্ট লেখার কাগজ রেডি করছি হঠাৎ ম্যাডাম পাস থেকে বললেন, " ওরে ! এ কি রে!"
আমি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বললাম," কি ম্যাডাম!?"
" এই দেখ কি অবস্থা! এর লিভার বামদিকে, স্প্লিন ডানদিকে, প্যানক্রিয়াসের টেল ডানদিকে!! এটা তো সাইটাস ইনভার্সাস রে!"
আমি পুরো ভুত দেখার মত তাকিয়ে রইলাম কিচ্ছুক্ষন। বইতে এ জিনিস পড়েছি। কোনোদিন চোখে দেখবো ভাবিনি। সত্যিই ভাবিনি। সাধারণ ভাবে সাইটাস ইনভার্সাস মানে মিরর ইমেজ। অর্থাৎ কিনা আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন বাম হাতকে ডান আর ডান হাতকে বাম বলে মনে হয় সেরকম। তফাৎটা হলো গিয়ে, এটা মনে হয় নয়, সত্যি। লিভার ডানদিকের জায়গায় বাম দিকে, স্প্লিন বাম দিকের জায়গায় ডানদিকে, প্যাঙক্রিয়াস উল্টানো, সোজা কথায় দেহের বামদিকের জিনিস ডানদিকে আর ডানদিকের জিনিস বামদিকে। খুব চট করে এ জিনিস দেখা যায় না। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ওই মেয়েটির হার্ট জায়গা মতোই আছে।
কি অবাক করা বিস্ময়!! ভাবা যায় না জাস্ট। আমি মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, " এর আগে এর কি কোনো পেটের ছবি হয়েছিল?"
" না স্যার, এই প্রথমবার হাসপাতালে ভর্তি হলো ও।" উত্তর দিলেন ভদ্রলোক।
পরে পুরো ইউ এস জি করে জানা গেল, মেয়েটির দুটো থাইরয়েড গ্ল্যান্ড অনেক বড় হয়ে গেছে। বুকের সামনের দেওয়ালে একটা শক্ত মাস আছে। পেটে জল জমেছে, বুকের দুদিকেও জল থৈ থৈ করছে।
ইউ এস জি হয়ে যাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভদ্রলোক একবার জিজ্ঞেস করলেন," স্যার রিপোর্ট কি বুঝছেন স্যার, খারাপ কিছু কি?"
আমি ভদ্রলোকের হাতে রিপোর্ট লেখা কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, " যে ডাক্তার বাবু ওকে দেখছেন, ওনাকে গিয়ে এটা দেখাবেন, উনি বলে দেবেন। ভয় পাবেন না, ভালো হয়ে যাবে ও"।
ভদ্রলোক আর কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেলেন।
সব সময় সত্যি কথা বলতে নেই। আসলে বলা যায় না। কিছু ক্ষেত্রে সত্যির থেকে মিথ্যে বললে কিছুক্ষনের জন্য হলেও বন্যা আটকানো যায়। এ জীবন সত্যিই বিস্ময়কর।
________________________
প্রীতম মন্ডল। ইনটার্ন চিকিৎসক। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, কলকাতা।

আপনার মতামত দিন:


মেডিক্যাল ক্যাম্প এর জনপ্রিয়