Ameen Qudir

Published:
2016-12-13 18:10:05 BdST

সৌদী যাওয়ার ইন্টারভিউ : মহিলা ডাক্তার কেঁদে বেরুলেন


 

 

 

 

_______________________________

ডা. আবু হেনা , সৌদী আরব
___________________________________

সকাল ৯ টা ।ডিসেম্বের ১৯৯৬ , স্থান BOESEL , ধানমণ্ডি সাতমসজিদ রোড । দোতালায় চেয়ারে বসে আছে প্রায় জনা ত্রিশেক ডাক্তার , মহিলা এবং পুরুষ মিলে । আমিও তাদের মধ্যে একজন । কেউ কেউ এসেছেন বগুড়া মহাম্মদ আলি হাসপাতাল থেকে । কেউ বা খোদ ঢাকা মেডিকেল থেকে । প্রায় সবাই ইন ডোর মেদিকেল অফিসার , কেউ বা CA ।আমার মত গ্রামের হাসপাতাল থেকে কেউ নেই । সকাল থেকেই বসে আছি । মনে হচ্ছে আমার সাক্ষাতকার নিতে নিতে বিকেল হয়ে যাবে ।যেই কেউ বেরুচ্ছে সাক্ষাতকার দিয়ে , আমি দৌড়ে তাকে ধরছি ,” ভাইজান কি কি জিজ্ঞসা করে?” কেউ কেউ জবাবে দাঁত ভেংচে দেয়,” আরে মিয়া , আপনেরে কমু ক্যান ? আমি বাঁচি না নিজের জ্বালায় !” বুঝলাম যে তার পরীক্ষা ভাল হয় নি ।


আমি অবশ্য দাঁত ভেংচানোতে মোটেই দমি না।কেউ কেউ অবশ্য ভাল ভাবেই দু একটা প্রশ্ন বলে। যেমন ,” আমারে কইল যে অজ্ঞান রুগি আইছে , কি করবা?( আসলে ভদ্রলোক তার নিজের ভাষায় বলছে), তয় আমি কইলাম ইসিজি করুম , ডি সি শক দিমু তারপর ভেন্টিলেটরে দিমু রুগি রে। মাগার হালায় আমারে কয় কি! তুমি যেখানে কাম করবা , হেহানে তুমি ছাড়া আর কোনও ডাক্তার ও নাই ,কুনও যন্ত্রপাতি ও নাই ।আছে শুধু একটা বেড , অক্সিজেন আর সেলাইন।“ এবারে আমি তাকে বললাম যে আপনি বলেন নাই যে “ অজ্ঞান” শব্দটা ভুয়া শব্দ !আমি দেখব যে এই অবস্থার কারন কি, এবং তাকে তাড়াতাড়ি বড় হাসপাতালে পাঠাতে হবে , অবশ্য তার আগে কিছু প্রাথমিক জিনিস ,দেখতে হবে ডায়েবেটিক কিনা, যেমন সেলাইন লাইন , অক্সিজেন এগুলা চালু করতে হবে। ভদ্রলোক আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন।


এবারে কাদতে কাদতে , মানে ক্রন্দনরত অবস্থায় বছর ৩৫ এর এক মহিলা ডাক্তার সাক্ষাতকার কক্ষ থেকে বেরুল ।

জিজ্ঞাসা করলাম , “আপা কি বিষয় ? কাঁদেন ক্যান ?” “ হুউউ হুউ ... আমাকে রুমে ঢুকতেই এক ঝাড়ি , Don’t you know that you must respect the culture of that country , for where you are going to give your examination? Get out from here!” ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম ফর্সা টকটকে মহিলা ,হলুদ স্লিভ লেস ব্লাউজ পড়েছে , এমন টাইট যে স্তন ফেটে বেরুতে চাচ্ছে, স্লিভ লেস ব্লাউজের ফাক দিয়ে বগলের চুল বেরিয়ে পড়তে চাইছে আর শাড়ীটাও হলুদ।শাড়ী এমন টাইট করে পড়া যে গায়ে কোণও আপ্রন ও নাই !এবারে আমি বললাম , “ অতি সত্যি কথা আপা ।“ উনি আমাকে কোনও কথা না বলে চলে গেলেন ।


“ আরে মিয়া , এরা যে কত সময় আমাদের সাথে ফাজলামি করবে!” তাকিয়ে দেখি , ছাই রঙের দামি সাফারি স্যুট পরে বসে আছে এক ডাক্তার সাহেব , হাতের টিস্যু পেপার দিয়ে মুখের পানের রস মুছছে ।ঠোট , মুখ সব পানের রসে লালে লাল। সামনে রাখা রূপোর পানের দিব্বা। আমি তার দিকে চাওয়া মাত্র আমাকে বলল ,” কি জুনিয়ার ভাই , খাবেন নাকি একটা , এলাচি দেওয়া পান ।“আমি বললাম না ভাইজান ,” সব জায়গায় সব জিনিস চলে না। আমার চাকরীটা দরকার খুব বেশি । তবে আপনার মনে হয় হবে না।“ “ আরে মিয়া , ৬ টার বাসে বগুড়ার টিকেট কেটে রেখেছি । ফকিরাপুল থেকে ছাড়বে । এখন তো তিনটা বাজে । কখন যে ডাকবে !”


কথায় কথায় বললেন যে মহাম্মাদ আলি মেদিকেল হাঁসপাতাল , বগুড়া বললেই সবাই তাকে এক নামে চিনে। তার প্রাকটিস খুব ই ভাল ওখানে , তাও এসেছেন তার স্ত্রীর চাপে পড়ে !” বগুড়া আইসেন , বগুড়ার দৈ খুব নাম করা , খাইছেন কখনো ?”” না ভাই খাই নি।“ এদিকে প্রায় সাড়ে তিন টা বাজে । আমি মাঝখানে ১ টার সময় বেরিয়ে গিয়ে নীচের কনফেক্সনারি থেকে প্যাঁটিস আর এক কাপ কফি খেয়ে এসেছি । এতক্ষনে পেটে ক্ষুধা আবার জানান দিচ্ছে । “ বগুড়া মোহাম্মাদ আলির ডাক্তার “.অমুক..” , যান ভিতরে যান , আপনার সিরিয়াল ।“ পিয়ন এসে হাক ছাড়ল ।

ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি তার ব্রিফকেসে পানের ডিব্বা ঢুকিয়ে সামনের কক্ষের বন্ধ দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল । দুই মিনিট ও হয় নি । আবার ক্যাঁচ করে দরজা খুলে বাইরে বেরুলো সেই বগুড়ার ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে। “ এর পরে ডাঃ আবু হেনা” , ঘোষকের কণ্ঠ । কিন্তু এখন না , স্যার নামাজ পরবেন এখন । আপনেরে ১৫ মিনিট পর ডাকবে ।“
আমি এবারে ভাবলাম ১৫ মিনিট আছে । “ কি ভাইজান আপনারে কি প্রশ্ন করল” আমি বগুড়াকে জিজ্ঞাসা করলাম ।“আরে প্রশ্ন করলে তো ! আমারে বলে , তোমার ঠোটে কি লাগিয়েছ? স্যার পান , মানে ব্যাটেল লিফ! হার্ট এর জন্য খুব ভাল স্যার ।

“” তোমার কি হার্টের অসুখ আছে?” “

না স্যার , মানে এগুলো হারবাল ।“
“ from where you have come from?”

“ sir , bogura” .“ ok , go there and work hard .”


এবারে আমার ডাক আসলো ।আমার পরনে ফুল হাতা হাল্কা আকাশি রঙের শার্ট ইন করে পরা ।কালো চিকন বেল্ট পরা , কালো প্যান্ট , সস্তা দরের তবে অফিসিয়াল ড্রেস ।

পায়ে বাটার ক্যামব্রিজ সু। দরজা খুলেই আমি ভিতরে ঢুকলাম না । টোকা দিয়ে প্রস্ন করলাম , “may l come in , sir?” ভিতর থেকে জবাব এল ,”yes , come in.”

আস্তে করে ভিতরে ঢুকলাম । ভিতরের তাপমাত্রা AC চালিয়ে গরম রাখা হয়েছে । আমার সামনের টেবিলের উল্টা দিকে প্যান্ট শার্ট পরা সৌদি ডাক্তার বসে আছে ।“সালামালাইকুম “ “ walaikum salam . “please sit down “ উনি বললেন , “ thank you “ আমি বসে বললাম ।
“Please show me your lisence “ .

আমার বুঝতে দু সেকেন্ড লাগলো যে আমার BMDC রেজিস্ট্রেশন দেখতে চাইছে । বের করে তার হাতে দিলাম , আসল টা , আমার সেই আমলের ছবি লাগান । তারপর বলল , “ গিভ মি অরজিনালস অফ অল ইয়উর সারতিফিকেতস ।“

আমি একে একে সব দিলাম । ওখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও , ডি জি হেলথের ইংরেজিতে ছাপানো আমার নাম লিখা একটা সার্টিফিকেট ছিল, যেটা ছিল যে আমি ARI প্রোগ্রামের ন্যাশনাল ত্রেনার ।ভদ্রলোক এই কাগজটা হাতে নিয়ে আমাকে প্রস্ন শুরু করল ।“ দেখো , তোমার এই ARI প্রোগ্রামের বিষয় তুমি যে যুক্ত , আমি খুব অভিভুত । আমি কানাডা থেকে ডাক্তারি পাশ করেছি ।আচ্ছা বলত , তোমার দেশে তুমি কি ধরনের রুগি দেখ?”

আমি শুরু করলাম , ARI , diarrohoea , Road trafic accident থেকে MI পর্যন্ত কিছুই বাদ দিলাম না।“ আচ্ছা মনে কর , তুমি ছুটি কাটাচ্ছ সৌদি আরবে , তুমি তোমার পরিবার সহ গাড়ি নিয়ে বেরাতে বেরিয়েছ , রাস্তায় দেখলে যে একজন অচেতন মানুষ পরে আছে । কি করবে?” “ আমি গাড়ি সাইড করে , তারপর রাস্তায় দারিয়ে সাহাজ্জের জন্য হাত উথাব। মানুশ এলে তাকে ধরে সাইদে এনে পরিক্ষা করব , যেহেতু রাস্তা , প্রথমেই আমি দুর্ঘটনার কথা ভাববো , এ ছাড়াও অন্য কিছু ও হতে পারে । যেমন MI , তবে আমার সাথের অন্য জনকে বলব যে আম্বুলেন্স ডাকো , আর আমি তাকে যতটুকু সাহায্য দেওয়া যায় , যেমন ঘাড় উঁচু থাকলে নামিয়ে দিব , জাতে শ্বাস ছলতে পারে , রক্তপাত থাকলে কাপর ছিঁড়ে বন্ধ করব ...।“
ভদ্রলোক হা করে সুধু শুনছে আমার কথা ।তারপর প্রস্নের পর প্রশ্ন , মেন্টাল depression থেকে শুরু করে গাইনি পর্যন্ত .দু একটা প্রস্ন অবশ্য আমি পারি নি । তবে সে জন্য সরাসরি বলেছি যে উত্তর টা আমার মনে পড়ছে না ।


শেষে ভদ্রলোক বললেন “ আচ্ছা আজ আমি প্রায় ২৬/২৭ জনকে পরীক্ষা নিলাম , আচ্ছা তুমি কি দেশের বাইরে কোথাও পরালিখা করেছ?” “ না , আমি দেশেই পড়েছি ।“ “ আচ্ছা MBBS ত ইংরেজিতেই পড় তাই না?” “ ইয়েস স্যার” “ তাহলে তোমাদের ডাক্তাররা ইংরেজি বুঝে না কেন?” “ what do you mean?”এবারে আমি একটু রাগত স্বরেই বললাম। “ না , মানে এক ডাক্তার , তোমাদের ঢাকা মেডিক্যালের , আমি বললাম , how are you?” উত্তরে বলল যে সে আমার আমার প্রশ্ন টাই বুঝে নাই ।

আমি তোমার সাথে প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বললাম । তুমি খুব ধারালো । যে প্রশ্ন তোমার জানা নাই , সে ক্ষেত্রে তুমি দুটো রাস্তা নিয়েছ , কিছু ক্ষেত্রে তুমি বলেছ যে তোমার দেশে এই নিয়মে ম্যানেজমেন্ট কর ( তুমি ভাল করেই জান , যে তোমার দেশের নিয়ম আমার জানা নাই!) , হা হা হা । আর কিছু ক্ষেত্রে তুমি সরাসরি বলেছ যে উত্তর তুমি জান না ।ভুল উত্তর না দেওয়ার চাইতে অপরাগতা স্বীকার করা ভাল। তোমার পরীক্ষা ভাল হয়েছে , আজ একমাত্র তুমি ই যোগ্য ।“ “ দেখ , তুমি ভাল করেই জানো যে বই পরে পাশ করা আর রুগী ম্যানেজমেন্ট করা এক কথা নয় ।দ্বিতীয়ত , আমাদের দেশে স্পকেন ইংলিশ জিনিস টা অনুপস্থিত । স্যার রা ক্লাসে যে বক্তৃতা দেন , বা বইয়ের ইংরেজি বুঝতে আমাদের কোনও কষ্ট হয় না ।

কিন্তু খাস আমেরিকান বা ব্রিটিশ উচ্চারণ এর সাথে আমাদের দেশের ৯৯% ছাত্ররাই পরিচিত নয় । আমার কথা বলছ? আমি ক্লাস ৭ থেকে টিভি র ইংরেজি সিরিয়ালগুলো গিলতাম । ফলে আমার জন্য এটা নরমাল উচ্চারণ ।আর তুমি যেহেতু কানাডা থেকে পড়েছ , কাজেই , “ “ ভদ্রলোক এবারে আমাকে বললেন “thank you.” বাইরে বেরিয়ে ঘড়িতে দেখি যে এক ঘণ্টা হয়ে গেছে । BOESEL এর কেরানি দৌড়ে এসে আমাকে বলল “স্যার আপনার কন্টাক্ট ফোন নাম্বার টা লিখে দিয়ে জান , আপনার হয়ে গেছে , সৌদি বলল ।“ আমি বললাম লিখুন ,” আমার আপার নাম্বার ...০৩১৬৩... আমার নিজের ফোন নাই ।”

_________________________________


ডা. আবু হেনা
স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় , সৌদি আরবিয়া

আপনার মতামত দিন:


সাক্ষাৎকার এর জনপ্রিয়