Ameen Qudir

Published:
2017-03-09 15:37:40 BdST

মৃতসঞ্জীবনী : অর্ধমৃত ডাক্তারদের জন্য


ডা. রেজাউল করীম
________________________________

আজ দিনদুপুরে ডাকাতি দেখার ইচ্ছে নিয়ে এক নামকরা দস্যুখানায় হাজির হলুম।


সেখানে দেখা হল এক সাহেব ডাক্তারের সাথে- দিশি- তবে নামের পর নানা জমকালো বর্ণমালা , নক্ষত্র-খচিত আকাশে তারার মত জ্বলজ্বল করছে। কথায় কথায় বুঝলুম- সাহেব আর কুল্লে সপ্তাখানেক দেশের জল খাবেন। তাপ্পর পাত্তাডি গুটোবেন।

বিপ্লবী "বিলে"র ধাক্কায় গাঁ গেরামের সব বিল ঝেঁটিয়ে এমনি করে সব ডাক্তার যদি পালায়, অবাক হবার অন্তত কারন নেই। দেশের তাবৎ বিল ঘেঁটে কখনো এমন দেশটি খুঁজে পাবেন না যেখানে আপনি রোগীর প্রান বাঁচাতে না পারলে আপনাকে জেলের ঘানি টানতে হবে। বিস্তর বই টই পড়ে যৌবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় জ্ঞাণসমুদ্রের বালুকাবেলায় নুড়ি কুড়িয়ে আপনি দেখলেন, আপনি কুল্লে সুচ্যগ্র পরিমান ডাক্তারি শিখেছেন। মানুষের পাশে দাঁডিয়ে যমের সাথে গজ-কচ্ছপের জন্য তাও খুব একটা কম নয়। তারপরও পড়ার আর বিরাম নেই- নানা কিসিমের রোগের হাজার রকমফের নিয়ে আলোচনা, তর্ক বিতর্ক জ্ঞানস্পৃহা রাবনের চিতার মত জ্বালিয়ে রাখলেও এ বিদ্যা করায়ত্ব করা কঠিন।


কিন্তু কি অনায়াস দক্ষতায় আপনার বিচার হচ্ছে-টিভির পর্দায়, সাংবাদিকের কলমে, আইনসভায়। শুনতে পাই একজন রাজনীতিকের কলম থেকে বেরিয়েছে এই বিল- যেখানে চিকিৎসায় বেখেয়ালের জন্য তিনবচ্ছর কারাবাসের বিধান রয়েছে।


জনদরদি সরকার জনগনের জন্য নিশ্চয় নানারকম কাজকর্ম করবে তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে? সরকার দেখাতে চায় সে জনগনের কথা ভাবে। এ এমন রাজ্য যেখানে মাথা পিছু শয্যা সংখ্যা মাত্র ০.০০৮, যে কোন জায়গায় চিকিৎসা খরচের শতকরা ৮০ ভাগ রোগীকে বহন করতে হয়, একই রোগে নিরক্ষরদের খরচের মাত্রা স্বাক্ষর মানুষের তুলনায় বেশী হয় সেখানে সরকারী বাজেট কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। সরকার যদি মানুষের উপকার করতে চায় তাহলে যা করতে পারে তাহল- সরকারী প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন ও তার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো।

তা না করে সরকার যা করছে তাহল চিকিৎসকদের সমাজের শত্রু বলে চিহ্নিত করতে চাইছে। বেসরকারী সংস্হাগুলি গড়ে উঠেছে ব্যবসা করার জন্য- সেখানে মানুষ গিয়ে সর্বস্ব খোয়ায় কিন্তু কোন বেসরকারী ব্যবসাদার তার পন্যের দাম সরকারকে জিজ্ঞাসা করে ঠিক করে। এমন ব্যবস্থা দরকার যেন
- মানুষের আস্থা সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় মহাপুরুষ মহানারীরা আগে একাডেমিক স্ফিয়ার থেকে আসতো- এখন আসে রাজনীতি থেকে।


সেই মহামানবরা যাতে প্রথমত: সরকারী ব্যবস্থার প্রতি আকর্ষিত হয়, তার জন্য সরকার কি করেছেন? সরকারের পোষা বেড়ালের অসুখ করলেও তো সেই ব্যবসাদারদের কাছেই হত্যে দেন- তারপর বিল না মিটিয়েই ভোকাট্টা দেন বলে শোনা যায়, তার বেলা!


সরকারের নীতি নির্ধারক বিশেষ কমিটির বেশীরভাগই সেইসব হাঙরের খোঁয়াড থেকে আসে। তাহলে, সরকার আসলে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা ঘোষনা করছে? অপর দিকে এক অসহায় মা তার বাচ্চাদের ঘরের কাছের সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যেতে ভরসা পাচ্ছে না তার কারন তার প্রতি তাদের কোন আস্থা নেই।


- বেসরকারী স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের কারা ডেকে এনেছেন? পিজি থেকে গাঁ-গন্জের হাসপাতালে পাব্লিক প্রাইভেটের নামে সরকারী খরচের আঁচে যারা লাভের চপশিল্প খুলেছে- তাদের কে ডেকে এনেছে। সরকার প্রতি মেডিকেল কলেজে প্রায় কম করে দশকোটি টাকার যন্ত্র কিনে বেসরকারী ব্যবসাদারদের ব্যবসা করতে দিয়েছে। তারপর, প্রতিটি ফ্রিকেসের পিছু তাদের রিএমবার্সমেন্ট দিচ্ছে। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে যে সামান্য টাকা সরকার নিচ্ছে তা নগন্য বললেও বেশী বলা হয়। একটা নির্বাচিত সরকার একদিকে পেছনের দরজা দিয়ে সব কিছু বেচে দিচ্ছে অন্য দিকে লোককে বোকা বানানোর জন্য নতুন নতুন ফিকির খুঁজছে।

-সরকারের অন্যতম প্রধান দায়বদ্ধতা হল প্রাথমিক স্বাস্থ্য। সেখানে তার সাফল্য কি কি? প্রসবকালীন সুবিধা বাডছে না কেন? এত কন্যাশ্রী প্রকল্প- তাও খোদ কলকাতা শহরে শিশুকন্যার সংখ্যা কেন হাজারে ৮৬৯। কেন অপুষ্ট বাচ্চারা মা হয়ে যাচ্ছে, কেন তারা নিরক্ত হয়ে কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যাচ্ছে? কেন সার্বিক শিশুমৃত্যুর হার ৩০র আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে? কেন এত হাম-যক্ষা-ডেঙ্গু হয়? কেন বিশুদ্ধ পানীয় দল পায় না মানুষ?

__________________


আমাদের আরবী ক্লাসে মৌলভী সাহেবকে খুব বিরক্ত করলে তিনি বিড়ালের লেজ সোজা করার মত কোন কাজ ধরিয়ে দিতেন।

একবার আমাদের বলেছিলেন: বলত, "চাহার-মগজ-শিকন" মানে কি? ও মানে আমি আজো বার করতে পারি নি!

বিপদে পড়লে- জনগনকে একটি চুষি কাঠি ধরাতে পারেন, জমকালো নামের আড়ালে একটি সুবৃহৎ অশ্বডিম্ব দান করতে পারেন। দিনকয়েক আগে পার্ক সার্কাস হয়ে ফিরছি দেখি রাস্তায় ইয়া বড় একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে- মাথায় আদ্দেক ঘোমটা পরা এক মহিলার ছবি, হাত দুটো আসমানের দিকে তাক করে আছে, "দাও, দাও" করে কোন দাঁওয়ের জন্য দোয়াদরুদ পডছে। মুখটা কেমন চেনা চেনা মনে হল, কিন্তু তেমন পাত্তা দিলুম না।

কিন্তু চোখ আটকে গেল একটা কথায়- "মদিনাতুল হুজ্জাজ"- এ আবার কোনদেশী হাজ্জাজ। সে ব্যাটা তো শুনেছি কবেই নিকেশ হয়ে গেছে! একটু আধটু আরবী ফারসী পডেছিলুম- হাতুডি দিয়ে ঠুকলে দুচারটে ক অক্ষর মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে - সেটি খাটিয়ে বুঝলুম, ইনি কিনি! এ আমাদের রাজ্য সরকারের অতুল কীর্তি- ট্যাঁকের পয়সা গচ্ছা দিয়ে ভোট আদায়ের সস্তা খেলার নেমেছে। আপনি যদি কাওকে খুব অবাক করে দিতে চান, তাহলে এমন একটা কিছু করে ফেলুন, সবাই থ হয়ে যাবে।

লালমোহনবাবু বলেছিলেন- বাঘ দেখলে ভয় না পেয়ে তার চোখে টর্চ মারতে। তাহলে তার চোখ ধাঁধিয়ে যাবে- বাছাধন সিধে দৌড়ে পালিয়ে যাবে। আর নাহয় কঠিন এমন কিছু বলবেন বা করবেন- লোকে হাঁ করতে ভুলে যাবে।


আমানুল্লা যখন সুবা আফগানিস্তানের রাজা হয়ে বসলেন তখন ফরমান দিলেন মেয়েদের স্কুলে ভলিবল কম্পালসারী আর "দেরেশ"( আসলে dress) ছাড়া কেউ অফিসে যেতে পারবে না।

ফলে সবাই রাতারাতি পাঠানি আচকান কেটে দেরেশ বানাতে শুরু করল আর দড়ির ফেট্টি বেঁধে কোমরে আটকে পাতলুন কেটে প্যান্ট বানিয়ে রাতারাতি সাহেব বনার চেষ্টা করতে লাগল। তারপরে কি হয়েছিল প্রতিবেশী দেশের গল্প পড়লেই বুঝতে পারবেন। কথা হল, শাসক ইতিহাস পড়তে পছন্দ করে না, নিজের উচ্চ কন্ঠ সব দূর্বলতার মহৌষধ বলে মনে করে। দিনে দুপুরে লোক ঠকায়, মিছে কথার সাতমহলা প্রাসাদ বানিয়ে সেখানেই ঘর গেরস্তালি পেতে বসে। ভাবে কে আছে আমার সাথে পাঙ্গা নেবে। কিন্তু কারাগারের কুঠুরির ভেতরেও প্রতিরোধের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে-তারপর অহমিকা আর আত্মম্ভরিতার গজদন্ত মিনার খান খান করে দেয়।


যাবার বেলা ( আহা রাত হয়েছে, ঘুমোতে যাওয়ার কথা হচ্ছে) একটা কথা বলে যাই- লালন শার গান
মরার আগে মলে, শমন-জ্বালা ঘুঁচে যায়
জানগে সে মরা কেমন, মুরশিদ ধরে জানতে হয়!
এবার কালীঘাটে হত্যে দেবেন না রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে তা রাতভর ভেবে কুলকিনারা করুন!!

________________________

ডা. রেজাউল করীম । বাংলা র প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক। সুপন্ডিত।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়