Ameen Qudir

Published:
2017-03-08 22:58:03 BdST

আপা একটাবার একটু বলবেন এইডা ছেলে হইবে না মাইয়া?


 

 

ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী
____________________________

রোগীনি প্রেগনেন্সীর শেষ দিকে!আলট্রাসনো বেডে উঠতেই বেশ কষ্ট পাচ্ছিল।স্ক্যান শেষ হতেই শ্বাস টেনে বলতে লাগল,আপা একটাবার একটু বলবেন এইডা ছেলে হইবে না মাইয়া?

 

আমি একটু নির্বিকার দৃষ্টিতে উনার মুখের দিকে তাকালাম।মাইয়া বলাটা এবং বলার মাঝের তাচ্ছিল্যটুকু আমার কানে বিঁধেছে।

আমাকে নিশ্চুপ দেখে নিজেই বলল,বলবেন না তো!আমি বুঝছি।আবার ও মাইয়া।আমগো ব্বংশের প্রদীপ নিভা গিয়া অহন খালি মাইয়া।
জানতে পারলাম,দুই মেয়ের পর ছেলে হয়েছিল উনার।মারা গেছে।তারপর দুই মেয়ে।
আলট্রাসনোগ্রাম স্ক্রীনে যাকে দাপাদাপি করতে দেখেছি সে ও মেয়ে।
বলতে পারলাম না।বরং ওর প্রদীপ নেভা লাইনটা শোনার পর থেকে অবচেতন মনে নিজেকেই যেন দোষী ভাবতে লাগলাম!প্রদীপের খবর দিতে পারলাম না।
এ ব্যর্থতা ঐ নারীর,এ ব্যর্থতা আমার!
আসলেই কি তাই???
প্রতিদিন হাজারো প্রশ্ন!উত্তরগুলো আমাকে প্রদক্ষিন করে ঘুরপাক খায়।এই পুরুষশাসিত সমাজের এই যে ভাবনা,ব্বংশের প্রদীপের - এত শিক্ষা,এত উন্নতি,নারী নেতৃত্ব - তবু প্রদীপ জ্বালাতে কেন ছেলে সন্তানের ই দরকার হয় সংসারে???
আমার মায়ের আমি প্রথম সন্তান।একটি সন্তানকে জন্ম দিতে এবং বড় করতে যে কঠিন তপস্যা,,আমার মা চারটি কন্যা সন্তানকে বড় করেছে একটি পুত্র সন্তানের আশায়,যে পুত্র তার জীবনে কখনোই আসেনি।
আমার বাবা মার জীবনে প্রদীপ জ্বালাবার ছেলে সন্তান আসেনি।তাই বলে আলোর অভাব তো আমার কখন ও মনে হয়নি!
তাদের চার কন্যার দুজন দেশের প্রথম সারির একটি সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তার।বাকী দুজন ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের!একজন পাস করেছে।অন্যজন ছাত্রী।
চাকুরীরত তিন কন্যা প্রচন্ড পরিশ্রমের আর সাধারন জীবন যাপন করে।কিন্তু একটা টাকাও দুর্নীতির না।
প্রতিটি কন্যাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে।প্রতেকেই সমাজ সচেতন।প্রতেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি জড়িত থেকেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে!

আমরা তাহলে কোন প্রদীপের কথা তুলে কারো মাতৃত্বকে অপমান করি?একটি নবজাতকের জন্ম নেয়ার মত আনন্দঘন ঐশ্বরিক মুহূর্তকে কলঙ্কিত করি!কালিমা লেপন করি!

নারী সেই অমোঘ শক্তির নাম যে ঘরে,বাইরে,উদ্যানে,জলে - স্থলে,আকাশে - বন্দরে নিজেকে স্নেহ, প্রেম, পরিশ্রম ,নিষ্ঠা,সাহসিকতা এবং সততায় সকলকে জয় করে।সকল প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে চোখের পলকে!

গৃহে নারী যেমন নীরবে নিভৃতে প্রদর্শন করে সবথেকে গুরুত্বপূর্ন কাজ গুলি।ঠোঁটের কোনে আলগা হাসি ধরে থেকেই নারীর সর্বোত্তম রুপ মা, ধারক হয়ে জমা রাখছেন পরিবারের সকলের সুখ দুঃখ শোক অভিমান!ছোট্ট ছোট্ট শান্তনা আর পরামর্শে সকলের জীবনকে করে তুলছে আনন্দময়!

আর কর্মজীবী নারী তো কখন ও কখন ও দশভূজা!আমার হাসপাতালেই চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী যে নারী আমাদের রুমে দায়িত্ব রত,বিধবা হয়েছেন সেই কিশোরী বয়সে!চার সন্তানের মা সুফিয়া।
শিক্ষিত নন।বুদ্ধীদীপ্ত ও নন।কিন্তু কি এক সরলতা।কি এক শক্তি,আত্মবিশ্বাস!ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন।নাতনীর বিয়ের দিনে যখন আমরা সাহায্যে এগিয়ে গেলাম,ওনার কৃতজ্ঞ চোখ দেখে আমি লজ্জিত বোধ করেছি।আমার কেবলি মনে হলো,দুর্ভার্গ্যের সাথে যুগ যুগ ধরে একলা লড়াই করা এই যে সাহসী নারী, এদের অনেক কিছু দেবার আছে আমাদের!

সময় বদলে গেছে।কর্মজীবী নারীরা ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরে।শিল্প,বানিজ্য,শিক্ষকতা,চিকিৎসা,মিডিয়া এবং প্রায় সব পেশাতেই অত্যন্ত প্রশংসার সাথে দক্ষতার সাথে কাজ করছে নারী।কর্মব্যস্ততা বা পারিবারিক পরিস্থিতি কখনো নারীর এ পথ চলাটাকে করে তুলছে সঙ্গীহীন,কখন ও বা আঁকা বাঁকা।

আজ ৮ মার্চ।আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিশ্বের সকল নারীর জন্য অনেক অনেক ভালবাসা এবং অভিনন্দন।

আর সমাজের কাছে আকুতি,আমাদের একটু সচেতনতা একটু আন্তরিকতা আর সহমর্মিতা চাইলেই নারীর চলার পথ চলাটাকে করে তুললে পারে সুন্দর ও সুগম।
আর সেই সুগম পথ চলায় আমরা সকলে যেন হই সকলের সহায়ক শক্তি।।

________________________________

ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী । জনপ্রিয় লেখক । পেশাজীবী নেতা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়