Saha Suravi

Published:
2024-10-02 18:36:35 BdST

টিউশনি,বোনের চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা: সংচাং ম্রো-র ডাক্তার হওয়ার অদম্য কাহিনি



ডেস্ক
__________________

ম্রো সম্প্রদায়ের প্রথম নারী চিকিৎসক হিসেবে ইতিহাস গড়েছেন বান্দরবানের সংচাং ম্রো। ডাক্তার হওয়ার পথে তার সংগ্রাম ছিল এক দীর্ঘ ও চ্যালেঞ্জিং যাত্রা। তার বাবা কাইংপ্রে ম্রো, একজন কৃষক, সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি গভীর মনোযোগী ছিলেন। আর্থিক অভাবের কারণে খাতা, চক বা শিক্ষার অন্যান্য সামগ্রী কেনার সামর্থ্য না থাকলেও সংচাংয়ের শেখার আগ্রহ কখনোই থেমে থাকেনি।
অল্প বয়সেই মা অসুস্থ হয়ে পড়লে সংচাংয়ের বাবা সন্তানদের শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে, যেভাবেই হোক, তাদের পড়াশোনা করাবেন। সংচাং আলীকদম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও, বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবের কারণে তিনি সাভারের সেন্ট জোসেফ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন।
কঠিন আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়াশোনা চালাতে সংচাং টিউশনি করতেন, এবং তার বড় বোন নিজের চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা তুলে দিয়ে তাকে সহায়তা করেন। চিকুনগুনিয়ার মতো অসুস্থতা এবং অন্যান্য পারিবারিক সংকট সত্ত্বেও সংচাং কখনোই তার স্বপ্নের পথ থেকে সরে দাঁড়াননি।
২০১৭ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়ার পর সংচাং তার বাবাকে প্রথম সুখবরটি দেন। ম্রো সম্প্রদায়ের প্রথম নারী ডাক্তার হিসেবে তিনি এখন এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছেন।

 

ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রথম নারী চিকিৎসক:

৫৩ হাজার ম্রো জনগোষ্ঠীর গর্ব ডাক্তার সংচাং শিরনামে বান্দরবান থেকে মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্টে অনন্য লড়াইয়ের গল্প লিখেছেন
সুফল চাকমা ।


তা প্রকাশ হল:

কিছু দিন আগেও পাহাড়ের ম্রো আদিবাসীদের বিবেচনা করা হতো সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে। সময়ের পরিক্রমায় ম্রোদের সেই অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। সেই দিনবদলের চূড়ায় নতুন পালক যুক্ত করলেন ডাক্তার সংচাং ম্রো। বান্দরবানের আলীকদমের এক প্রত্যন্ত পাহাড় থেকে উঠে আসা এই মেয়ে ম্রো আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম নারী ডাক্তার। অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও বাবার অনুপ্রেরণায় এগিয়ে আসা সংচাং ম্রো আজ পুরো জাতিগোষ্ঠীর প্রেরণা।

সংচাং ম্রোয়ের চিকিৎসক হয়ে ওঠার যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না। তার শৈশব ছিল দারিদ্র্য আর সংকটে ভরা। মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। এক বোন মারা যান চিকিৎসার অভাবে। এই ঘটনাগুলো সংচাং ম্রোকে চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা জাগাতে প্রেরণা জোগায়। সংচাং ম্রোয়ের বাড়ি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় সদর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড পাইয়া কারবারিপাড়ায়। কাইংপ্রে ম্রো ও তুমলেং ম্রো দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে সংচাং চতুর্থ।

বাবা কাইংপ্রে ম্রো, যিনি নিজেই কোনো প্রথাগত শিক্ষা পাননি, তিনি সন্তানদের মধ্যে একজনকে চিকিৎসক বানানোর স্বপ্ন দেখেন। বাবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম করেন সংচাং ম্রো। রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে ১৭-১৮ সেশনে চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। বর্তমানে ডাক্তারি শেষ করে তিনি ঐ মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন করছেন।

২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ম্রো জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা মাত্র ৫৩ হাজার। বান্দরবানে ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের বসবাস দুর্গম এলাকায়। যেখানে শিক্ষা-চাকরি থেকে বঞ্চিত অধিকাংশ মানুষ, যোগাযোগব্যবস্থা নেই, সরকারি আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনও চরম উপেক্ষিত। সেই দুর্গম এলাকা ম্রো জুমিয়া পরিবার থেকে আসা ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রথম নারী ডাক্তার সংচাং ম্রো। ১৯৯৭ সালে এই জনগোষ্ঠী থেকে জীবময় ম্রো চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে প্রথম এমবিবিএস পাস করেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এবং তার ছোট ভাই ডাক্তার জ্যোতির্ময় ম্রো ২০০৩ সালে একই মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরবর্তীতে আরও রিংতুই ম্রো ও ছুম থং ম্রো নামে দুজনসহ চারজন পুরুষ ডাক্তার ম্রো থেকে থাকলেও এইবার প্রথম ম্রো কোনো নারী ডাক্তার হলেন।

পড়াশোনার বিষয়ে ছোটবেলা থেকেই সংচাং ম্রোকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। সংচাং ম্রো জানান, শৈশবে বাবার কাছেই আমার প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। তাকে পড়াতে গিয়ে তার বাবাও পড়াশোনা শুরু করেন। তিনি বলেন, জুমের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাবা আমাকে মাটিতে এঁকে বা কখনও কলাপাতায় এঁকে একটা একটা করে বর্ণ শেখাতেন। সেই সময় তাদের গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না আর বই-খাতা কেনার মতো সামর্থও ছিল না। পরে গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে লামা মিশন নামে হোস্টেলে ভর্তি করে দেন। এক বছর পর সেই হোস্টেল বন্ধ হয়ে গেলে সংচাংকে ফাদার লুপির পরিচালিত তৈদাং হোস্টেলে ভর্তি করা হয়। সেই হোস্টেলে থেকে সংচাং ম্রো চম্পটপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলীকদম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে সংচাং ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। ২০১২ সাল পর্যন্ত সেখানেই চলে তার লেখাপড়া।

সংচাং ম্রো বলেন, আলীকদমে বিজ্ঞানের ভালো শিক্ষক না থাকার কারণে আমাকে যেতে হয় সেন্ট যোসেফস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে। অভাব-অনটনের মধ্যেও অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সিস্টাররা আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। এসএসসি পরীক্ষার পর আমি হলিক্রস কলেজে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হই। টাকার অভাবে সেই সময়ে ভর্তি হতে না পেরে খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু নমিতা সিস্টার আমাকে আবার কলেজে নিয়ে যান এবং আমাকে ফ্রি করে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেন। জানালেন, কলেজের অনেক শিক্ষকও তাকে বিনা পয়সায় পড়িয়েছেন। বলেন, মেরি মার্গারেট সিস্টার তো আমার হাতখরচও মাঝেমধ্যে দিয়ে দিতেন। আমার যখন এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়, তখনও টাকা না থাকায় আমি বাসায় যাইনি। কলেজে থাকা অবস্থায় দুই ভাই-বোনকে পড়িয়েছি। সেই জমানো টাকা দিয়েই মেডিকেল ভর্তির প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। বাবা বলেছিলেন বাসায় এসে একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে। কিন্তু আমি বাবাকে বলেছিলাম যতক্ষণ কোথাও আমি চান্স না পাই তত দিন আমি বাসায় ফিরব না। অবশেষে, সংচাং ম্রো রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং সফলভাবে তার ডাক্তারি পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করছেন।

আলীকদম ম্রো কল্যাণ ছাত্রাবাসের পরিচালক ও ম্রো সম্প্রদায়ের নেতা ইয়ং লক ম্রো, ম্রো সম্প্রদায় থেকে প্রথম নারী ডাক্তার সংচাং ম্রোকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, পিছিয়ে পড়া দুর্গম এলাকার লোকজনকে আধুনিক চিকিৎসাসেবা দিতে ম্রো নারীদের প্রথম ডাক্তার সংচাং ম্রো অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।

আলীকদম-নাইক্ষ্যংছড়ি ম্রো কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক হেডম্যান থংপ্রে ম্রো বলেন, সংচাং ম্রোদের মধ্যে প্রথম নারী ডাক্তার। তার এই কৃতিত্ব ম্রোদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও ম্রো সম্প্রদায়ের নেতা রাংলাই ম্রো বলেন, ম্রো সম্প্রদায় শিক্ষা-দীক্ষায় এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। দুর্গম এলাকা যেখানে এখনও আধুনিক সুবিধা পৌঁছেনি সেখান থেকে শত প্রতিকূলতার মধ্যে বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে একজন জুমিয়া ম্রো পরিবার থেকে নারী ডাক্তার হওয়া এত সহজ ছিল না। তিনি ম্রো নারীদের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রাখবেন। তিনি এটাও আশা প্রকাশ করে বলেন, এখন এই ডাক্তারকে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও সহানুভূতি প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

সংচাং ম্রোর এই কৃতিত্ব শুধু তার নিজের জন্য নয়, এটি পুরো ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্যও একটি আশীর্বাদ। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, পাহাড়ের মানুষ যেন আর কখনও চিকিৎসার অভাবে মারা না যায় এবং তিনি নিজে সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য কাজ করতে চান। আলীকদমের সাধারণ মানুষও তার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে সংচাং ম্রো আলীকদমের মানুষের জন্য সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়