DESK

Published:
2024-05-21 09:54:22 BdST

চিকিৎসা বিজ্ঞানের চিরস্মরণীয় নাম রোশালিন ইয়ালো




অশোক সরকার
__________________________

যেসব মহিলা বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের জগতে নিজেদের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন তাদের নিয়ে লিখতে আমার খুব ভালো লাগে। একটা সময় বিজ্ঞান ছিল পুরুষদের অধিকারে। সেখানে মেয়েদের প্রবেশ করার কোন অধিকার ছিল না। কিন্তু যুগে যুগে কিছু একরোখা জেদি মেয়েও জন্মেছে যারা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, মেয়েরাও পারে। যেমন অ্যাডা, মেরি কুরি, আইরিন কুরির মত মেয়েরা।

এমনই একজনের কথা আজ বলবো:
আট বছর বয়সেই মেয়েটি ঠিক করে ফেলেছিল বড় হয়ে সে বিজ্ঞানী হবে, হয়েছিলেনও তাই। পুরুষ শাসিত বিজ্ঞান গবেষণার জগতে হয়েছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
নাম: রোসালিন সাসমান।
রোসালিন সাসমান:
জন্ম ১৯২১ সালের ১৯ শে জুলাই, নিউইয়র্কের ব্রস্কস অঞ্চলের এক অসচ্ছল ইহুদি পরিবারে। স্কুলের পড়া শেষ করে রোসালিন বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হন নিউইয়র্কের এক অবৈতনিক ইন্টার কলেজে। সেখান থেকেই রোসালিন ফিজিক্সে স্নাতক হলেন।

কিন্তু তারপর!
তখনকার দিনে কোন কলেজেই দরিদ্র ইহুদি মেয়েদের ফিজিক্সে মাস্টার্স পড়ার জন্য কোন সাহায্য দিত না। সময়টা ছিল ১৯৪১, সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দলে দলে ছাত্রদের যুদ্ধে যেতে হচ্ছে। ফলে রোসালিন সুযোগ পেয়ে গেল ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে।

প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি বলেছেন,
"ভাগ্যিস তখন ছেলেরা যুদ্ধে গিয়েছিল তা না হলে পড়ার সুযোগ, নোবেল প্রাই কিছুই হতো না আমার জীবনে।"

সেখান থেকেই নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে করলেন পিএইচডি। তারপরেই বিয়ে করলেন সহপাঠী ইহুদী যুবক অ্যারন ইয়ালোকে। বিয়ের পর নাম হল রোশালিন ইয়ালো। কর্মজীবন শুরু করেন নিউইয়র্কের এক টেলিকমিউনিকেশন ল্যাবরেটরিতে। পরে ইন্টার কলেজে ফিজিক্স পড়াতেন। কিন্তু মনে শান্তি নেই, কিছু একটা করতে হবে। স্বামী অ্যারনের সহায়তায় ব্রস্কসের ভেটারনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হাসপাতালের রেডিও আইসোটোপ সার্ভিস বিভাগে অস্থায়ী গবেষণা পরামর্শদাতার পদ পেলেন। জীবনে ৪৫ বছর ওই হাসপাতাল ছিল তার গবেষণাগার।

১৯৪৭ সালে শুরু হয় তার গবেষণার জীবন। নিজের হাতে তৈরি করলেন আমেরিকার প্রথম রেডিও আইসোটোপ ল্যাবরেটরি। তখন এই বিষয়ে গবেষণার জন্য কোন যন্ত্রপাতি পাওয়া যেত না। রোসালিন তার ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনায় তৈরি করলেন তেজস্ক্রিয়তা সনাক্তকরণের জন্য রেডিয়েশন ডিটেক্টর। গবেষণার তাগিদে কলেজে পড়ানোর কাজ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে যোগ দিলেন ভেটারনস হাসপাতালে।

যন্ত্র তো তৈরি হলো, কিন্তু মেডিকেলে ফিজিক্স নিয়ে কাজ করতে হলে মানুষের শরীরের খুঁটিনাটি জানতে হবে, শুরু করলেন পড়াশুনা। তারপরেও অভাব অনুভব করলেন একজন যোগ্য গবেষণার সঙ্গীর। যাকে তিনি শেখাবেন ফিজিক্স বিনিময়ে নিজে শিখবেন মেডিসিন সম্পর্কে।

কথায় বলে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। পেয়েও গেলেন সঙ্গী হিসাবে এক অসাধারণ মানুষকে, নাম সলোমন বারসন। তাদের যৌথ গবেষণার সম্পর্ক ছিল ২২ বছর। শুরু হলো যৌথ গবেষণা। ওই সময় সবাই জানত শরীরে ইনসুলিন হরমোনের অভাবে ডায়াবেটিস হয়। রোসালিন ঠিক করলেন সহজে বিশুদ্ধ অবস্তায় পাওয়াযায় এমন ইনসুলিন নিয়ে কাজ করবেন। ১৯৫০ সালে গরু জাতীয় প্রাণীর শরীর থেকে পাওয়া ইনসুলিন ব্যবহার করে মানুষের ডায়াবেটিসের চিকিৎসা হতো। কিন্তু কিছু কিছুদিনের মধ্যেই ওই ইনসুলিনের বিরুদ্ধে মানুষের শরীর প্রতিরোধ গড়ে তুলত। রোসালিন ও বারসন শুরু করলেন গবেষণা।

ইনসুলিন খুব ছোট আকারের অনু। জৈব রসায়নের ভাষায় এদের বলে পেপটাইড। তারা ওই ইনসুলিন অনুর সঙ্গে আয়োডিনের রেডিও আইসোটোপ যুক্ত করলেন। ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে ওই বিশেষ ইনসুলিন প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা কমছে। রোসালিনদের এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল জৈব বস্তুর ন্যূনতম পরিমাণ সনাক্তকরণের এক নতুন পদ্ধতি। যার নাম তারা দিলেন "রেডিও ইমিউনো অ্যাসে বা আরআইএ।

কিন্তু ১৯৫৫ সালে তাদের মূল গবেষণা পত্র প্রত্যাখ্যান করল জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন। অনেক তর্কবিতর্কের পর ১৯৫৬ সালে তাঁদের গবেষণাপত্র গৃহীত হলো। এই ঘটনার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা নোবেল পাওয়ার সময় তিনি উল্লেখ করেছিলেন। এতেই কিন্তু থামলেন না তাঁর। আরো নিখুঁত গবেষণার ডুবে গেলেন তারা।

১৯৭২ সালে আকস্মিক মৃত্যু হল সহ গবেষক বারসনের। অনেক বিজ্ঞানী বলতে শুরু করলেন, রোসালিনের ভবিষ্যৎ এবার শেষ। মেয়েদের আবার বৈজ্ঞানিক প্রতিভা! বারসনের মৃত্যুতে সাময়িক ভেঙে পড়লেও অদম্য রোসালিন সপ্তাহে প্রায় ১০০ ঘন্টা কাজ করতে লাগলেন। চার বছরের মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রায় ষাটটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন তিনি। যেমন রক্তে হেপাটাইটিস ভাইরাসের উপস্থিতি জানতে ও রক্ত সংবহনে ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে, দেহে যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি বুঝতে, ক্যান্সার নির্ণয়ে, বিভিন্ন হরমোন ভিটামিন, ড্রাগ, বিষাক্ত বস্তু প্রভৃতির পরিমাণ মাপতে, হরমোন ঘটিত রোগের সনাক্তকরণে আরআইএ-র সূক্ষ্ম সংবেদী ভূমিকা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

নোবেল কমিটির কাছে চাপ আসছিল এই আবিষ্কারকের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। বাধ্য হয়ে ১৯৭৭ সালে নোবেল কমিটিকে দিতে হলো স্বীকৃতি। নোবেল নিতে এসে সঙ্গী বিরসনের অভাব বোধ করেছিলেন রোসালিন। সেদিন তিনি বহু বিজ্ঞানীর কাছে শুনেছিলেন যে, হরমোন সংক্রান্ত গবেষণার এক যুগান্তকারী আবিষ্কার যা বহু গবেষকদের জীবন বদলে দেবে।

অনেক লড়াই করে পুরুষ কেন্দ্রীক বিজ্ঞানের জগতে নিজের জায়গা করে নিলেও, রোসালিনের কাছে পূর্ণ নারীত্বের সংজ্ঞা ছিল গৃহপালন ও মাতৃত্ব। পেশা বা শিক্ষার জগতে মেয়েদের সংরক্ষিত আসন নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেছেন:
" এতে মেয়েদের অসম্মান করা হয়।"
শুধু নারী বলে বিশেষ সম্মান যেমন, ' ফেডারেল উইমেন্স অ্যাওয়ার্ড' অথবা 'উওম্যান অফ দি ইয়ার' পুরস্কার রোসালিন বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বলেছেন:
"বিজ্ঞানের দুনিয়ায় পুরুষ আর নারীর মধ্যে একটাই তফাৎ নারীরা সন্তানের জন্ম দিতে পারে, সেটা নারী বিজ্ঞানীদের পক্ষে বেশি কষ্টদায়ক। কিন্তু অন্য অনেক চ্যালেঞ্জের মত এটাও একটা চ্যালেঞ্জ মাত্র।

নোবেল পাওয়ার পর ছোট্ট একটি জীবনী লিখেছিলেন তিনি। সেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে উপেক্ষা-অপমান সহ্য করে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রে এক নতুন যুগের জন্ম দিয়েছেন। রেডিয়ো হিমিউনো অ্যাসে আবিষ্কারের পেটেন্ট তিনি নেননি। তাই এই শতকেও আরআইএ পদ্ধতির মূল নীতি অবলম্বন করে অনেক আধুনিক টেকনিকের সৃষ্টি হয়েছে।

২০১১ সালের ৩০ শে মে এই মহান বিজ্ঞানী মৃত্যু হয়। রোসালিন ইয়েলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক চির স্মরণীয় নাম।
অসাধারণ প্রতিভাধর এই নারী বিজ্ঞানীকে আমার শতকোটি প্রণাম।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়