DESK

Published:
2024-04-01 12:23:20 BdST

পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনী চিকিৎসকদের পৃষ্ঠপোষকতা করা : রাষ্ট্রের জন্য সেরা বিনিয়োগ


 

ডা. আজাদ হাসান

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য প্রশাসন বিশেষজ্ঞ লেখক


----------------------


পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনী (পিজি ট্রেনী) চিকিৎসকদের পৃষ্ঠপোষকতা করা - রাষ্ট্রের জন্য হতে পারে সেরা বিনিয়োগ (ইনভেস্টমেন্ট)। প্রশ্ন করতে পারেন কিভাবে?
বিষয়টা একটু আলোচনা করা যাক।

আজ থেকে ৫০ বছর আগেও আমাদের দেশের রোগীরা "ক্যাটারেক্ট" অপারেশন কিংবা "গল ব্লাডারের পাথর" অপারেশন এর জন্য বিলেত যেতেন। কিন্তু বিগত ৩০ বছরে "ক্যাটারেক্ট অপারেশন" কিংবা "গল ব্লাডারের পাথর/পিত্তথলির পাথর অপারেশন"- এর জন্য কাউকে বিদেশে যেতে শুনি নাই। বিগত ২৫-৩০ বছর যাবৎ আমাদের দেশেই সাফল্যের সাথে ওপেন হার্ট সার্জারী (CABG), কার্ডিয়াক স্ট্যান্টিং,( PTCA), হার্টের বাল্বের অপারেশন, পরিপাকতন্ত্রের চিকিৎসায় ভিডিও এন্ডোস্কপি, কোলনস্কপি, ERCP প্রভৃতি জটিল এবং উন্নত চিকিৎসা দেশেই নিয়মিত হচ্ছে। তাছাড়া হেলথ ইন্ডিকেটর এর দিক দিয়েও মাতৃ মৃত্যুর হার, নবজাত শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে।

সুতরাং আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান যত উন্নত করা সম্ভব হবে, দেশের মানুষের স্বাস্থ্যও তত ভালো থাকবে। আর সে জন্য আমাদের দেশে অধিক সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরী করতে হবে।
আমাদের দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক "বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক" তৈরী করতে পারলে, এর মাঝে আমাদের জন্য কিছু প্রত্যক্ষ লাভ এবং পরোক্ষভাবেও কিছু লাভ নিহিত আছে। কিভাবে?
১) প্রথমতঃ রোগীরা সহজে চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। রোগীরা হয়রানী হতে মুক্তি পাবে। ২) রোগীদের বিদেশগামীতা কমানো সম্ভব হবে। ৩) চিকিৎসার কারণে প্রতি বছর আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় সংকোচন হবে। ৪) আমরা যদি স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন করে অধিক হারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সার্ভিস দিতে সমর্থ হই, সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ যেমনঃ নেপাল, ভূটান, এমন কি প্রতিবেশী ভারতের যে সব রাজ্য আমাদের সীমানার পার্শ্ববর্তী সেখান থেকেও রোগীরা আমাদের দেশে চিকিৎসার জন্য আসবে। যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সাহায্য করবে। ৫) তাছাড়া বিদেশে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে চিকিৎসকদের পাঠাতে সমর্থ হবো যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনি ডক্টররা ভালো নেই। বর্তমানে তাঁরা তাদের ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন নিয়ে পেরেশানিতে আছেন। তবে আশার কথা হলো, মাননীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী মহোদয়ের সময়োচিত এবং আন্তরিক সহযোগিতা পূর্ণ পদক্ষেপ এর ফলে ভাতার বিষয়ে একটি সম্মানজনক পরিসমাপ্তি হবে বলে আশাবাদী।

পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনী চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রসংগে আমি দু'টি কথা উত্থাপন করছি।
প্রথম কথা হলো, একজন অফিসারের (চিকিৎসক-এর) ট্রেনিং এর জন্য যে ধরনের শিক্ষার পরিবেশ প্রয়োজন, সেটা কি আমাদের দেশের পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনি চিকিৎসকদেরকে কোন একটি পোস্ট গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট-এ (ইনক্লুডিং বিএসএমএমইউ-তে) দিতে পারছে?
একবার ভেবে দেখুন বিএমএ, এসআইএনটি, মীরপুর স্টাফ কলেজের অফিসারদের ট্রেনিং এর পরিবেশ। আপনারা অনেকেই পিএটিসি অথবা কুমিল্লার বার্ড হতে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করেছেন। একবার ভাবুন তো ওখানকার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের পরিবেশের কথা।
এবার আসুন আমাদের পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গুলোর পরিবেশের কথা।
১) ট্রেনি ডক্টরদের পোস্টের নাম "রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ান" আর ট্রেনিং এর নাম "রেসিডেন্সি ট্রেনিং"। অর্থাৎ এই সব ট্রেনিং ডক্টররা সংশ্লিষ্ট ইন্সটিটিউটের "রেসিডেন্ট"- এ থাকবেন এবং পড়াশুনার পাশাপাশি হাতে-কলমে কাজ শেখার জন্য ট্রেনিং করবে। আজ পর্যন্ত কোন একটি ইন্সটিটিউট কি এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছে? না এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথাও আছে। যদিও বা বিএসএমএমইউ-তে পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের জন্য একটি হোস্টেল আছে কিন্তু সেখানে সীটের অপ্রতুলতা, বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব এবং মান সম্মত ক্যান্টিনের অভাব রয়েছে। তাছাড়া হোস্টেলে সীট বরাদ্দ নিয়েও রয়েছে চরম নৈরাজ্য। ২) লাইব্রেরীঃ বর্তমানে আধুনিক লাইব্রেরী বলতে যে ধরণের সুযোগ সুবিধা সম্বলিত লাইব্রেরী বোঝায়, সে রকম মান সম্মত একটি লাইব্রেরীও কোন পোস্ট গ্রাজুয়েট ইন্সটিটিউট এ পাওয়া যাবে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। বিএসএমএমইউ-তে যে লাইব্রেরীটা আছে, তাকে লাইব্রেরী না বলে স্ট্যাডি রুম বললে ভালো হয়। ৩) এবার পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনি ডক্টরদের ভাতার প্রসংগে আসি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশ হতে পিএইচডি কিংবা পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রী করতে যারা যান, তাঁরা কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমনঃ UNDP, UNESCO, COMMON WEALTH ইত্যাদি সংস্থার স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে যান। তাছাড়াও বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিরও নিজস্ব স্কলারশীপ ফান্ড থাকে। অর্থাৎ পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কলারশীপ পেয়ে থাকেন। এবং আর্থিক ভাবে তাঁদেরকে (পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের) স্কলারশীপ বাবদ যে এমাউন্টটি দেয়া হয়ে থাকে তা দিয়ে ওনারা নিজের টিউশন ফি এবং পরিবারের খরচ নির্বাহ করে নির্বিঘ্নে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেন।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় কিছুদিন আগ পর্যন্ত 'পোস্টগ্রাজুয়েট ট্রেনী ডক্টরদের স্কলারশীপ" বা "ভাতার" বিষয়টি কর্তৃপক্ষের মাথায়ই ছিল না। যা হোক, পরবর্তীতে সদাশয় কর্তৃপক্ষ ভাতার বিষয়টি মেনে নিয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনী ডক্টরদের ভাতা দেয়া শুরু করলেও বর্তমান বাজার মূল্যের উর্ধগতির সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় সম্প্রতি ঐ সব চিকিৎসকরা "ভাতা বৃদ্ধির আন্দলোনে" নামতে বাধ্য হন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় "ভাতা প্রদান" নিয়েও কর্তৃপক্ষ বার বার তাদের প্রতিশ্রুতি হতে বিভিন্ন ছলে কৌশলে সরে আসতে থাকেন। যা অত্যন্ত দুঃখ জনক এবং অপ্রত্যাশিত।

প্রসংগত উল্লেখ্য, আপনারা হয়ত অনেকে জানেন না, বিদেশ হতে বিভিন্ন সময় "স্বাস্থ্য বিষয়ক" বিভিন্ন স্কলারশিপ এসে থাকে যেগুলোর সার্কুলার সচিবালয়ের বাহিরে খুব একটা প্রচারিত হয় না বা হলেও সেটার জন্য আবেদন করার জন্য এত অল্প সময় থাকে যে, ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে ঢাকার বাহির হতে কারো পক্ষে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করা সম্ভব হয় না।
এই সুযোগে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা সেই সব স্কলারশীপ গুলোতে যান। ফলে যেসব ট্রেনীংগুলোতে চিকিৎসকদের যাওয়ার কথা সেই সুবিধাগুলো আমলারা নিয়ে নেন। ফলে ডাক্তারদের জন্য উপযোগী ট্রেনিং আমলারা নিলেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে তা কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। আপনারা অনেকে হয়তঃ জানেন না, বর্তমানে সরকারী স্কলারশীপ নিয়ে সচিবালয়ের অনেক কর্মকর্তা আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রামে কিংবা পিএইচডি প্রোগ্রামে কোর্স করছেন। অথচ ২০০০ সনের আগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে নির্বাচিত সরকারী চিকিৎসকদের জন্য 'বই কেনা" বাবদ যে বরাদ্দ ছিল, সেটাও বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ট্রেনী চিকিৎসকরা পাচ্ছেন না। কিন্তু সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সের জন্য কিন্তু সরকারের টাকার কিংবা বাজেটের কমতি পড়ে না।

আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না যে, দেশের মেধাবী ছাত্ররাই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ৫ বছরের এমবিবিএস কোর্সে ৪টি পেশাগত/প্রফেশনাল পরীক্ষায় (নূন্যতম ৬০% নম্বর অর্জন সাপেক্ষে) সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর, ১ বছর ইন্টার্নশীপ ট্রেনিং সমাপ্ত করার পর, প্রতিযোগিতা মূলক বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকুরী প্রাপ্ত হন। এক একটি বিসিএস পরীক্ষা প্রিলিমারী হতে ফাইনাল গেজেট নোটিফিকেশন পর্যন্ত গড়ে ২ থেকে আড়াই বছর লেগে যায়। তারপর সরকারি চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে আরো ২ বছর গ্রামে বাধ্যতামূলক চাকুরী সমাপান্তে আবারো প্রতিযোগিতা মূলক "পোস্ট গ্রাজুয়েশন এডমিশন টেস্ট" কোয়ালিফাই করার পর এক একজন চিকিৎসক "পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনী" ডক্টর হিসেবে কোর্সে আসেন। আর ডক্টরদের এই জার্নিটাতে আসতে আসতে গড়ে সবার বয়স ৩০-৩৫ বছর হয়ে যায়। সেই সাথে প্রত্যেকের কাঁধে সংসারের বোঝা চেপে বসে। এত গেলে সরকারী চিকিৎসকদের পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সে আসার "রোড ম্যাপ"। এবার বেসরকারী ক্যান্ডিডেটদের কথা বলি, তাদের অনেকে অত্যন্ত কম বেতনে প্রাইভেট ক্লিনিকে অস্থায়ী ভিত্তিতে কিংবা পার্টটাইম জব করে কিংবা কোন জব না করেই একনিষ্ঠ ভাবে কেবল পড়াশুনা করেন পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে ঢোকার জন্য। তাদের অধিকাংশের না আছে বাসস্থানের নিশ্চয়তা, না আছে খাদ্য নিরাপত্তা। অথচ এরাই "জাতির মেধাবী সন্তান"।

এ তো গেলো পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে চান্স পাওয়ার কাহিনী। আর পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সের জার্নিটি আরো কঠিন এবং কঠোর। নির্দিষ্ট কোর্স অনুযায়ী ক্লাস করা, ক্লিনিক্যাল সাবজেক্ট হলে সকালে প্রফেসরদের সাথে ওয়ার্ড রাউন্ডে উপস্থিত থাকা, তাছাড়া মর্নিং, ইভিনিং, নাইট ডিউটি করা: যারা সার্জিক্যাল সাবজেক্টে তাদেরকে এসবের পাশাপাশি রুটিন ওটিতে এসিস্ট্যান্সী এবং ইমার্জেন্সী ওটি করতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন পার্টের এক্জাম, ফেইজ-১, ফেইজ-২ এক্জাম তো আছেই। বস্তুতঃ বর্তমানে পোস্ট গ্রাজুয়েট ইন্সটিটিউট সমূহের ইনডোর এবং আউটডোরের একটা বিরাট অংশের রোগী এসব মেধাবী চিকিৎসকরাই সামলে থাকেন। কোর্সের নিয়ম অনুযায়ী কোর্স কালীন সময় ট্রেনী ডক্টররা বাহিরে প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন না। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যদি ওনাদেরকে ইন্সটিটিউট এর মাধ্যমে সরকারী ভাবে ভাতা দেয়া না হয়, তাহলে ওনারা কিভাবে জীবন নির্বাহ করবেন? কিভাবে সংসার চালাবেন? এই যে ওনারা পোস্ট গ্রাজুয়েশন ইন্সটিটিউট গুলোতে দিবারাত্রি রোগীদের সার্ভিস দিচ্ছেন, তাদের এই শ্রমের কি কোনই মূল্য নেই?

আর তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, জাতির এই সব "মেধাবী সন্তানদের" প্রতি কি দেশ ও জাতির কোন দায়বদ্ধতা নেই। আমরা যদি আমাদের দেশের "মেধাবী সন্তানদেরকে" পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না দিতে পারি, তা হলে তা আমাদের জন্য একদিন বিপর্যয় ডেকে আনবে। এসব মেধাবী চিকিৎসকদের একটা অংশ বিদেশে চলে যাবেন এবং একটা অংশ আর্থিক অস্বচ্ছতার কারণ পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্স হতে ছিটকে পড়বেন। যা হবে চরম দূর্ভাগ্যের বিষয়।

তাই দেশ ও জাতির স্বার্থে দেশের মেধাবী সন্তান এই সব পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনী চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধির যৌক্তিক দাবী মেনে নিয়ে তাদের দাবীকৃত ভাতা সম্মান জনক মাত্রায় উন্নীত করতে সদাশয় সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়