ডেস্ক

Published:
2024-03-01 07:45:49 BdST

স্মরণডা. দিলরুবা বেগম, চমেক পরিবার এর একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র


 

ডা.মোহাম্মদ মহিউদ্দিন
_________________

১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের ২৪তম ব্যাচের এমবিবিএস ফাইনাল এর মৌখিক ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা চলছে।মেডিসিন এবং সার্জারীর পরীক্ষা শেষ।খুব সম্ভবত ২৩শে ফেব্রুয়ারিতে গাইনী পরীক্ষা শুরু হয়েছে।সবারই টেনশন হচ্ছে এক্সটারনার্ল পরীক্ষক এর ভূমিকা নিয়ে।প্রথম দিন এর পরীক্ষার্র্থীর কাছ থেকে জানার জন্যে সবারই অপেক্ষা, এক্সটারনাল পরীক্ষক কেমন প্রশ্ন করছেন? উনাদের মেজাজ মর্জি কেমন, ইত্যাদি ইত্যাদি ।সব খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল প্রফেসর দিলরুবা ম্যাডাম খুবই ভাল। আমরা মনে মনে একটা ভরসা পেলাম। উনি সিলেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে এসেছেন,কিন্তু উনি চট্টগ্রাম মেডিকেল এর ১৬ তম ব্যাচের ছাত্রী।

যাইহোক প্রথমদিনের পরীক্ষার পর সবার একটা ধারনা হয়ে গেল যে প্রফেসর দিলরুবা ম্যাডাম এর কাছে ভীতিকর মন নিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে না।
একধরনের উৎকন্ঠাহীন মন নিয়ে সবাই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকলো।

২৪শে ফেবরুয়ারি যংথারীতি পরীক্ষা শেষ হলো।দিলরুবা ম্যাডাম পরীক্ষার পর চলে গেলেন উনার বাবার বাসা নন্দন কানন এ।নন্দন কানন এর এই বাসায় ৮ ভাই বোনের সাথে চট্টগ্রামেই কেটেছে উনার স্কুল ও কলেজ জীবন।

১৯৫৫ সালের ৯ই এপ্রিলে উনার জন্ম। ডা. খাস্তগীর স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন ১৯৭০ সালে। তারপর চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট করেন।
এমবিবিএস কোর্স এ ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে।
তিনি চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সুবাদে তিনি আমার আলমা মেটার।

অত্যন্ত মেধাবী চিকিৎসক দিলরুবা ম্যাডাম এমবিবিএস পাশ করেন ১৯৭৯ সালে।চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এ ইন্টার্ন শীপ শেষ করে তিনি তৎকালীন ঢাকার আইপিজিএমআর এ গাইনীতে এফসিপিএস কোর্স এ ভর্তি হন।

তখন পিজি হাসপাতাল এর পরিচালক ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক জনাব নুরুল ইসলাম, উনি ছিলেন ডা. দিলরুবার বাবার স্কুলের সহপাঠী এবং খুবই নিকটতম বন্ধু।
ডা. দিলরুবার বাবার নাম ছিলেন আবু সাইয়েদ চৌধুরী উনার গ্রামের বাড়ি চন্দনাইশ থানার গাছবাড়ীয়া গ্রামে। প্রফেসর নুরুল ইসলাম ও জনাব আবু সাইয়েদ চৌধুরী দুজনেই গাছবাড়ীয়া এন. জি. এইচ. ই স্কুলে পড়ালেখা করেছেন।ডা. এন ইসলাম উনার একটি লেখায় ডা. দিলরুবার ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যে পিজি হাসপাতালে ডা. দিলরুবা সম্পূর্ণ নিজের মেধার ভিত্তিতে ভর্তি হয়েছিলেন এফসিপিএস কোর্স এ।
অত্যন্ত সফলতার সাথে প্রথম বারেই ১৯৮৫ সালে এফসিপিএস ডিগ্রী অর্জন করেন।

তারপর কিছুদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর গাইনী বিভাগে রেসিডেন্ট সার্জন হিসাবে কাজ করেন।
ডা. দিলরুবা খুব সম্ভবত সর্বকনিষ্ঠ গাইনীতে এফসিপিএস করা ডাক্তারদের একজন। উনি যখন আমাদের পরীক্ষা নিতে আসেন উনার বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বৎসর।এত অল্প বয়সে বাংলাদেশে গাইনীতে সহকারি প্রফেসর হওয়ার নজির খুবই কম।সেই বছর এক্সটার্নাল হিসাবে আরো এসেছিলেন সিনিয়র প্রফেসর মোখলেসুর রহমান স্যার।প্রথম দুই দিনের পরীক্ষায় সবাই দিলরুবা ম্যাডাম এর ব্যাপারে খুবই খুশী ছিলেন।যাঁদের পরীক্ষা বাকী তাঁরাও পজিটিভ মনে প্রিপারেশন নিচ্ছিল। ম্যাডাম বিকালে বাবার বাসায় চা খেয়ে একটি বেবী টেক্সী তে করে উনার শ্বশুড় বাড়ি মুরাদ পুরের দিকে রওনা দিয়েছিলেন ম্যাডামের বাবাই উনাকে একটি টেক্সীতে তুলে দিয়ে মাগরীবের নামাজ পড়তে আন্দরকিল্লাহ জামে মসজিদে চলে যান।

জনাব আবু সাইয়েদ চৌধুরী স্বপ্নেও কল্পনা করেন নাই মসজিদে উনি উনার জীবনের সবচেয় কস্টতম একটি সংবাদ শুনবেন।ম্যাডামের টেক্সী যখন মুরাদ পুর বাস স্ট্যান্ড এর কাছাকাছি পৌঁছায় তখনই একটি দ্রুতগামী কোস্টার এসে টেক্সী কে চাপা দেয়।দূর্ঘটনার পর গুরুতর আহত অবস্থায় উনাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে আনা হয়। কিন্তু কিছুক্ষন পরই ডা. দিলরুবা ম্যাডাম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।উনার নিথর দেহ সাদা চাদরে ঢেকে ১৭ নম্বর ওয়ার্ড এর সামনে নিয়ে আসা হয়।
মূহুর্তের মধ্যেই এই দুঃসংবাদ সারা ক্যামপাস ও চট্টগ্রাম শহরে ছড়িয়ে পড়ে।উনার সহকর্মী, বন্ধুবন্ধব, ছাত্র ছাত্রী ও আত্তীয় স্বজন দলে দলে মেডিকেল ক্যাম্পাসে জড়ো হয় উনাকে শেষ বিদায় জানাতে।পুরো ক্যামপাস ঢেকে যায় শোকের কালো চাদরে।

আমাদের ২৪ তম ব্যাচ এর সাথে দিলরুবা ম্যাডামের স্মৃতি ওতপ্রোত ভাবে জডিয়ে আছে।একজন অসাধারন প্রতিভার অধিকারী চিকিৎসক ও শিক্ষক এর এভাবে চলে যাওয়া ছিল অনেক অপুরনীয় ক্ষতি।

উনার স্মৃতিকে স্মরনীয় করে রাখতে সিলেট মেডিকেল কলেজ কতৃপক্ষ ডা. দিলরুবা ম্যাডাম এর নামে একটি ছাত্রীনিবাস এর নামকরন করেছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সমিতি ভবনের নামকরণও করা হয় ডা. দিলরুবা বেগম এর নামে।

ডা. দিলরুবা বেগম ছিলেন একজন ট্যালেন্টেড ১৬ তম ব্যাচের সিএমসিয়ান।আমাদের মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির টেলেন্টদেরকে নতুন প্রজন্মের কাছে স্মরনীয় করে রাখতে বাৎসরিক মেমোরিয়াল লেকচার শুরু করতে পারলে উনাদের অবদানকে সন্মানিত করা হবে বলে আমি মনে করি।

ভাষা শহীদ এর ফেব্রুয়ারিতে ডা. দিলরুবা বেগম এর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
বিঃ দ্রঃ ডা. দিলরুবার ছবি ও পারিবারিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন উনার বড় ভাই জনাব মাহমুদুল হাসান।

লেখকঃ ডা.মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ,রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ,সেইন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রুন্সউইক।এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি ,কানাডা॥

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়