Dr. Aminul Islam

Published:
2024-02-24 19:06:07 BdST

রাজা চার্লস এর ক্যানসার ও আমাদের অবস্থান


 


ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

_________________________

ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ ছিল বিশ্ব ক্যানসার দিবস। এই মাসে বিশ্বের নিউজ মিডিয়ার হেডলাইন হচ্ছে ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস এর ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবর। ৭৫ বছর বয়স্ক রাজার ঠিক কি ধরনের ক্যানসার হয়েছে তা এখনো জানা যায় নাই। তবে এই বয়সের প্রতি ৩ জন লোকের মধ্যে ২ জনের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইংল্যান্ড এর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এর ক্যানসার কেয়ার প্রোগ্রামের প্রটোকল অনুযায়ী রাজার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ইংল্যান্ডের একজন সাধারণ নাগরিকের ক্যানসার চিকিৎসা ও রাজার চিকিৎসার ভেতর কোন তফাৎ থাকার কথা নয়। আমাদের দেশে নারী-পুরুষের ক্যানসারে আক্রান্তের সঠিক সংখ্যা বলা খুবই মুশকিল। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে বাংলাদেশে কমন ক্যানসার হলো নারীদের স্তন ও জরায়ু মুখের ক্যানসার এবং নারী-পুরুষ উভয়ের খাদ্যনালী, ফুসফুস, গলা ও পরিপাকতন্ত্রের ক্যানসার। গ্লোবোকেন পৃথিবীর ১৮৫টি দেশের ৩৬ রকম ক্যানসারের ডাটাবেজ প্রতিবছর প্রকাশ করে থাকে। প্রতিটি দেশের ক্যানসার রেজিস্ট্রি থেকে দেশভিত্তিক ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা পেয়ে থাকে। সংখ্যা হিসাবে বলতে গেলে গ্লোবকেন এর হিসাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে একশত ৫৬ হাজার লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তবে এই সংখ্যা সঠিক নয় বলে আমার ধারণা। কারণ যেহেতু আমাদের নিজস্ব ক্যানসার রেজিস্ট্রি নাই, সুতরাং সঠিক হিসাবও নাই।

ক্যানসার রেজিস্ট্রি কী?

ক্যানসার রেজিস্ট্রি একটি সংস্থা, যাঁদের কাজ হলো প্রতিদিন যতগুলো ক্যানসার ডায়াগনোসিস হয় তা নিবন্ধন করা। ক্যানসার ডায়াগনোসিস এর প্রধান সোর্স হলো প্যাথলজিস্ট/প্যাথলজী বিভাগ/ডায়াগনোস্টিক সেন্টার। পৃথিবীর অনেক দেশেই আইনগতভাবে প্যাথলজিস্ট ক্যানসার ডায়াগনোসিস করলেই সেই রিপোর্ট ক্যানসার রেজিস্ট্রি অফিসে পাঠাতে বাধ্য। আমাদের দেশে এই ব্যাপারে কোন আইন আছে কিনা আমার জানা নাই। ক্যানসার রেজিস্ট্রির আন্তর্জাতিক সংস্থার নাম হলো ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অংংড়পরধঃরড়হ ড়ভ ঈধহপবৎ জবমরংঃৎরবং (ওঅঈজ)। এই সংস্থার হেড অফিস ফ্রান্সে অবস্থিত। এই সংস্থার মেম্বার হতে ২৫০-৩০০ ডলার বাৎসরিক ফি দিতে হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান ছাড়া সবাই ওঅঈজ মেম্বার। এই সংস্থার মেম্বার হলে এরা ক্যানসার রেজিস্ট্রি নিয়ে কিভাবে কাজ করতে হয় তা লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন এবং বিভিন্ন সফট্ ওয়্যার দিয়ে সাহায্য করে থাকে, যার ফলে একটি দেশের ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়। সঠিক সংখ্যা জানলে সঠিক একটি পরিকল্পনা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সহজ হয়। এই কাজটি সম্ভবত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কম্যুনিকেবল ডিসিজ শাখার করার কথা। স্বাধীনতার ৫২ বছর হওয়ার পরও একটি জাতীয় ক্যানসার রেজিস্ট্রি না হওয়া টা সত্যি দুঃখজনক।আমাদের প্রতিবেশী দেশের প্রতিটি রাজ্যেই রয়েছে তাদের নিজস্ব ক্যানসার রেজিস্ট্রি। গ্লোবোকেন প্রতিবেশী দেশের ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর হিসাব থেকে একটি গড় সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের ক্যানসার রোগীর সংখ্যা নির্ণয় করে থাকেন বলে জানা যায়। কোন ধরনের ক্যানসারে কতজন লোক প্রতিবছর আক্রান্ত হয়, সেই সংখ্যার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যবিভাগ একটি পরিকল্পনা করতে পারে কতজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দরকার এবং কি কি মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট প্রয়োজন। ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই জটিল, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। উদাহরণ হিসাবে আমরা যদি স্তন ক্যানসারের কথা আলোচনা করি তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সহজ হবে বলে আমার ধারণা। সারা বিশ্বব্যাপী মহিলাদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশেও স্তন ক্যানসার বিস্তার কম নয়। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২০ সালে আনুমানিক ২৩ লক্ষ মহিলা সারা পৃথিবীতে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন, এবং ৬ লক্ষ ৮৫ হাজার মৃত্যু বরণ করেন। এর ভেতর প্রায় ৫০ ভাগই মহিলা এশিয়া মহাদেশের। গ্লোবোকেন এর হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিবছর ১৩ থেকে ১৫ হাজার মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বর্তমানে চট্টগ্রামে প্রতি বছর কতজন স্তন ক্যানসারের রোগী সনাক্ত হয় সেটাও আমাদের জানা নাই। স্তন ক্যানসারের রোগীর চিকিৎসা সাধারণত একজন ডাক্তার পক্ষে করা সম্ভব হয় না। এর চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। একটি মালটি ডিসিপ্লিনারি টিমের সমন্বয়ে ধাপে ধাপে করা হয়ে থাকে। এই টিমের সদস্যারা হলেন ব্রেস্ট সার্জন, মেডিকেল অনকোলজিস্ট, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট ও রেডিওলজিস্ট।

ব্রেস্ট সার্জন হলো একজন সার্জারির ডাক্তার, যার স্তন ক্যানসার সার্জারি করার যথাযথ ট্রেনিং আছে। সব সার্জন ব্রেস্ট ক্যানসারের সার্জারি করতে পারেন না। মেডিকেল অনকোলজিস্ট একজন স্পেসালিস্ট ডাক্তার, যিনি কেমোথেরাপির (ক্যানসারের ঔষধ) সাহায্য ক্যানসারের চিকিৎসা করে থাকেন। রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট রেডিয়েশনের সাহায্যে ক্যানসারের চিকিৎসা করে থাকেন। এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে আলাদা করে রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট এর কোন ডাক্তার নাই। ক্লিনিকেল অনকোলজিস্ট হিসাবে যারা প্রাকটিস করেন মূলত তারাই রেডিয়েশনও দিয়ে থাকেন। ভারত, পাকিস্তান, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় দেশেই রেডিয়েশন অনকোলজি একটি আলাদা স্পেসিয়ালিটি। আমাদের দেশে ৮টি বিভাগীয় ক্যানসার সেন্টার তৈরীর কাজ শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের সেন্টারটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ চত্তরে ১৫ তলা ভবন নিয়ে হবে। এখানে আশাকরি অত্যাধুনিক লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন বসবে এবং চট্টগ্রামের ক্যানসার আক্রান্ত রোগীরা আধুনিক চিকিৎসা পাবে। কিন্তু বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা যদি রেডিয়েশন অনকোলজি স্পেশালিস্ট, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, মেডিকেল রেডিয়েশন থেরাপিস্ট যথাযথভাবে তৈরী না করতে পারি তাহলে ১৫ তলা বিল্ডিং-এ আধুনিক মেশিনগুলো ক্যানসার রোগীদের কোন উপকারে আসবে কিনা সন্দেহ। স্বাস্থ্যবিভাগ, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান এন্ড সার্জন (বিসিপিএস ) এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মিলে এই সমস্যার সমাধান করা দরকার বলে আমি মনে করি। কারণ দিনশেষে আমরা কেউ না কেউ জীবনের কোন একটা পর্যায়ে ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হতে পারি।

 

আমাদের দেশে একটা সময় ছিল যখন ইউরোলজী বলে কোন স্পেশিয়ালিটি ছিল না। জেনারেল সার্জনরাই ইউরোলজিস্ট হিসাবে চিকিৎসা দিতেন। বর্তমানে ইউরোলজী একটি সম্পূর্ণ আলাদা বিভাগ। মাত্র কিছুদিন আগে আমাদের দেশে মেডিকেল অনকোলজি আলাদা স্পেশিয়ালিটি হিসাবে যাত্রা শুরু করেছে। ক্যানসার রোগের কোয়ালিটি কেয়ার পেতে হলে রেডিয়েশন অনকোলজিকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে একটি স্পেশিয়ালিটি হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সেই ‘গ্রান্ড ফাদার ক্লস’ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ‘ক্লিনিক্যাল অনকলজি’ স্পেসালিস্ট হিসাবে কেমোথেরাপী এবং রেডিয়েশন থেরাপির যৌথ প্রাকটিস ক্যানসার রোগীর জন্য কল্যান বয়ে আনবেনা। আপনি কি আপনার বাড়ি এমন একজন লোককে দিয়ে তৈরী করাবেন যে একাই ইঞ্জিনিয়ার ও আর্কিটেক্ট হিসাবে কাজ করেন? দিনশেষে হয়তো আপনার একটি বাড়ি হবে কিন্তু কোয়ালিটি নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে।

 

রেডিয়েশন দেওয়ার মেশিনের নাম লিনিয়ার এক্সেলেরেটর। এই মেশিনটি একটি অত্যন্ত জটিল একটি এবং ব্যয়বহুল মেশিন। বর্তমান বাজারে এই ধরনের একটি মেশিনের দাম ৩ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার। মোট কথা এই মেশিনটি একটি জায়ান্ট কম্পিউটার। রেডিয়েশন খালি চোখে দেখা যায় না। রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের জন্য বিভিন্ন রকমের রেডিয়েশন ডোজ সহ প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকেন এবং রোগের ধরন অনুযায়ী একটি ট্রিটমেন্ট প্লেন করে থাকেন। এই ট্রিটমেন্ট প্লান এর কাজটি কম্পিউটারে একটি সফ্ট ওয়্যার এর মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। ক্যানসার এর ধরনের উপর ভিত্তি করে একটি প্লান করতে রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট কে ৩০ মিনিট থেকে ১৮০ মিনিট সময় ব্যায় করতে হয়। রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট এর করা প্লান মোতাবেক লিনিয়ার এক্সেলেরেটর থেকে রেডিয়েশন কতটুকু ডেলিভারী হবে, কিভাবে হবে সেটা নিশ্চিত করার জন্য একজন মেডিকেল ফিজিসিস্ট এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট কোন ডাক্তার নয়। মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট মূলত ফিজিক্সে গ্রাজুয়েশন করে এমএসসি/ পিএইচডি করতে হয়। উন্নত বিশ্বে সব ম্যাডিক্যাল ফিজিসিস্টই পিএইচডি ডিগ্রিধারী। বাংলাদেশে সরকারী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ফিজিক্স বিষয়ে কোন আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রাম আছে বলে আমার জানা নেই। তবে বছরকয়েক আগে ডা. জাফরউল্লাহ স্যারের গণবিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল ফিজিক্স এর কোর্স চালু করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ এই কোর্স চালু করার ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি।

 

লিনিয়ার এক্সিলেটরের সাহায্য রেডিয়েশন ডেলিভারী করে চিকিৎসা সম্পন্ন করার জন্য রেডিয়েশন থেরাপি টেকনোলজিস্টদের ভূমিকা অপরিহার্য। বহিরবিশ্বে এমন কি ভারতেও এই ডিগ্রিটি একটি বিএসসি ডিগ্রি।রেডিয়েশন থেরাপি টেকনোলজিস্ট-এ ভর্তির জন্য এইসএসসিতে বিজ্ঞানে ভালো জিপিএ থাকাটা আবশ্যিক। বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার মতো মেধা যাঁদের আছে তারাই মেডিকেল রেডিয়েশন থেরাপি টেকনোলজিস্ট এর ডিগ্রি নেওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কারণ এই কোর্সে এনাটমি, ফিজিক্স ও সাইন্স এর অনেক কোর্স পড়ানো হয় এবং পরবর্তীতে উনারা ৫ মিলিয়ন ডলারের মেশিনগুলো পরিচালনা করেন। রেডিয়েশন থেরাপি কোর্স এর ভর্তির যোগ্যতা এবং কোর্স কারিকুলাম পরিবর্তন করা সময়ের দাবী।

 

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে আমরা ঘটা করে বিশ্ব ক্যানসার দিবস পালন করে থাকি। ব্যানার, ফেস্টুন ও পিংক কালারের বেলুন সহ সারাদেশে র‌্যালি করে জনগণকে ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন করা হয়ে থাকে। এই সচেতনেতার সাথে সাথে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য সঠিক জনবল গড়ে তুলতে না পারলে বিভাগীয় ক্যানসার সেন্টারগুলো শ্বেত হস্তীতে পরিণত হোক এটা আমাদের কারোই কাম্য নয়।

 

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রুন্সউইক। এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, কানাডা

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়