SAHA ANTAR

Published:
2022-07-17 21:55:03 BdST

পাকিস্তানী শিশু আফসিনের জীবন বাঁচালেন দিল্লীর চিকিৎসক: একদম বিনা পয়সায়


ইদুল আজহার আগে ইয়াকুব কুমবার ফেসবুকে বোনের হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি পোস্ট করেন। ছবির নিচে লিখেছেন ‘এখন আফসিন হাসছে, কথা বলছে

 


বিবিসি______________

সম্প্রতি ইদুল আজহার আগে ইয়াকুব কুমবার ফেসবুকে বোনের হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি পোস্ট করেন। ছবির নিচে লিখেছেন ‘এখন আফসিন হাসছে, কথা বলছে।’

আফসিন গুলকে স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলতে পারা, হাঁটতে পারার মতো অবস্থায় আসতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১২টি বছর। এখন আফসিন ১৩ বছরের কিশোরী। কিন্তু ১০ মাস বয়সে বোনের কোল থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায় তার ঘাড়। এর পর থেকে তার ঘাড় ৯০ ডিগ্রি বেঁকে যায়। সব সময় গলায় পরে থাকতে হতো বেল্ট। কথা বলতে পারত না, খেতে গেলে ভীষণ কষ্ট হতো।

আফসিন সেরিব্রাল পালসিতেও আক্রান্ত ছিল। ছয় বছর বয়সে সে হাঁটা শেখে। আট বছর বয়সে কথা বলা। এসব কারণে তার বয়সী শিশুদের তুলনায় সে অনেক পিছিয়ে পড়ে।

 

 

চিকিৎসক রাজাগোপালন কৃষ্ণান (বায়ে)

আমরা অনেক খুশি...চিকিৎসক আমার বোনের জীবন বাঁচিয়েছেন। আমাদের জন্য তিনি একজন ফেরেশতা।
ইয়াকুব কুমবার, আফসিনের ভাই

-------------------


মেয়ের কথা বলেতে গিয়ে আফসিনের মা জামিলান বিবি যেন সেই সময়ে ফিরে যান। জানান, ভালো চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য ছিল না তাঁদের। সে (আফসিন) হাঁটতে, খেতে বা কথা বলতে পারত না। মাটিতে শুয়ে থাকতে হতো তাকে। আফসিনের সব কাজ অন্যদের করে দিতে হতো।

আফসিন গুলরা সাত ভাই-বোন। তাদের মধ্যে সে সবার ছোট। কিন্তু কোনো দিন তার স্কুলে যাওয়া হয়নি, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা হয়নি। সেই দুর্ঘটনার পর তার মা–বাবা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেছেন। চিকিৎসক কিছু ওষুধ ও গলাটা সোজা ধরে রাখার জন্য বেল্ট দেন। কিন্তু দিন দিন তার অবস্থা খারাপের দিকেই যায়। করাচি শহর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে মিথিতে বাড়িতেই কেটেছে আফসিনের কষ্টের ১২ বছর।

গত মার্চে আফসিনের জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে। দিল্লীর একজন চিকিৎসক বিনা পয়সায় আফসিনের ঘাড়ে সফল অস্ত্রোপচার করেন। এরপর চার মাস হতে চলল।

আফসিন অবশেষে হাঁটতে, কথা বলতে ও খেতে পারছে। অস্ত্রোপচারের ক্ষতও শুকিয়ে এসেছে। দিল্লীরচিকিৎসক রাজাগোপালন কৃষ্ণান প্রতি সপ্তাহে তাকে স্কাইপে দেখেন। কৃষ্ণান দিল্লি অ্যাপোলো হাসপাতালে মেরুদণ্ডের জটিল সার্জারি বিশেষজ্ঞ।


আফসিনের ভাই ইয়াকুব কুমবার বলেন, ‘সে এখনো কিছুটা অসুস্থ...স্কুলে যাওয়ার মতো অবস্থা তার এখনো হয়নি। তবে চিকিৎসক বলেছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার অবস্থার উন্নতি হবে। আমরা অনেক খুশি...চিকিৎসক আমার বোনের জীবন বাঁচিয়েছেন। আমাদের জন্য তিনি একজন ফেরেশতার মতো।’


কৃষ্ণান বলেন, আফসিনের ঘাড়ের কাছে মেরুদণ্ডের ওপরের হাড় ভেঙেছে, যা ঘাড় ঘোরাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এটি সম্ভবত বিশ্বে প্রথম ঘটনা।

২০১৭ সালে আফসিনকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল একটি নিউজ ওয়েবসাইট। এটি অনেকের নজর কাড়ে। পাকিস্তানের নামী অভিনেতা আহসান খান নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আফসিনের ছবি পোস্ট করে সবাইকে শিশুটির সহায়তায় এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। সনম বালোচের উপস্থাপনায় জনপ্রিয় মনিং শোতে আমন্ত্রণ জানানো হয় আফসিনের মাকে। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের একজন সংগঠক আফসিনের পরিবারকে অস্ত্রোপচারের খরচ বহনে সহায়তা করতে অনলাইন তহবিল সংগ্রহও করেছিলেন। সে বছরের নভেম্বরে তৎকালীন ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির এমপি নাজ বালোচ আফসিনকে নিয়ে টুইট করেন। সেখানে তিনি জানান, সিন্ধু প্রদেশ সরকার আফসিনের চিকিৎসার দায়িত্ব বহন করবে।

আফসিনের ভাই ইয়াকুব কুমবার বলেন, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বেসরকারি হাসপাতাল আগা খান ইউনিভার্সিটি হসপিটালে আফসিনকে ভর্তি করা হয়। বিশেষজ্ঞরা জানান, অস্ত্রোপচার করা হবে। তবে তার বাঁচার আশা ৫০ শতাংশ। এ কথা শুনে আফসিনের মা–বাবা আরেকটু ভেবে দেখবেন বলে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর তাঁরা তাদের এক বোনের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁরা আবার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু সেখান থেকে তাঁরা তেমন ইতিবাচক সাড়া পাননি।


এমপি নাজ বালোচ জানান, তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। প্রয়োজনে বিদেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহায়তা নেওয়ার কথাও বলেন। কিন্তু যখনই বিদেশি এনজিও এগিয়ে আসতে শুরু করে, তখনই বালোচ নিজেকে সরিয়ে নেন।

পরের বছর ২০১৯ সালে আবার খবরের শিরোনাম হন আফসিন। যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক আলেকজান্দ্রিয়া থমাস আফসিনের অবস্থা ও তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পরে থমাসই পরিবারটিকে দিল্লির চিকিৎসক কৃষ্ণানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। কৃষ্ণান আফসিনকে সহায়তার আশ্বাস দেন।

বেসরকারি শিশুযত্ন সংস্থার সহায়তায় আফসিনের পরিবার গত বছরের নভেম্বরে মেডিকেল ভিসায় দিল্লী আসে।


আফসিনের ভাই ইয়াকুব কুমবার বলেন, ‘চিকিৎসক কৃষ্ণান জানান, অস্ত্রোপচারের সময় তার হৃদ্‌যন্ত্র বা ফুসফুসের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ওই সময়টা আমাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল।’ এ ছাড়া আর্থিক সংকটও ছিল। চিকিৎসার খরচ মেটাতে তাঁরা অনলাইনে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু চিকিৎসক কৃষ্ণান তাঁদের ভরসা দেন। তাঁর চেষ্টা ও তত্ত্বাবধানে অস্ত্রোপচার
ঘাড়ে মূল অস্ত্রোপচার করার আগে আফসিনের বড় ধরনের দুটি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এরপর আরও একটি বড় অস্ত্রোপচার হয়।

গত ফেব্রুয়ারিতে মূল অস্ত্রোপচার হয়। কৃষ্ণান বিবিসিকে বলেন, ‘তিনি ও তাঁর দল ছয় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আফসিনের মাথার খুলির সঙ্গে মেরুদণ্ডকে সংযুক্ত করতে পেরেছিলেন। তারপর ঘাড় সোজা রাখতে কাঠি এবং স্ক্রু ব্যবহার করে মাথার খুলিটিকে সার্ভিক্যাল মেরুদণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল।

অস্ত্রোপচার সফল হওয়ার পর চিকিৎসক কৃষ্ণান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চিকিৎসা না হলে আফসিন হয়তো বেশি দিন বাঁচতে পারত না।

এখনো আফসিনের কিছু জটিলতা আছে। অন্য শিশুদের তুলনায় কিছুটা ধীরগতি তার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার উন্নতি হবে, এমনটাই বলছেন চিকিৎসক। আপাতত আফসিন যে বেঁচে আছে, হাসছে, তাতেই খুশি তার পরিবার।

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়