SAHA ANTAR

Published:
2022-07-02 20:30:15 BdST

কাকিমাকে ক্যান্সারে মরতে দেখে দুঃখে ভেঙে পড়া ছেলেটি লাখো মানুষের জীবন বাঁচানোর দিশা


 

ডেস্ক
______________________

সাধারণ ছেলের অসাধারণ লড়াই ।
এক ছোট্ট গ্রাম থেকে ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ বায়োমেডিকেল জিনোমিক্স এ পৌঁছানোর রাস্তা কতটা এবড়োখেবড়ো? সে রাস্তায় যতই কাঁকর থাক, বর্ষায় পা যতই কাদায় বসে যাক; মনের জোর আর চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস থাকলে যে সেই চড়াই-উৎরাইও অনায়াসে পেরোনো যায়, আজ সেই গল্পই শোনা যাক।
ক্লাস সেভেনের ছেলেটার চোখের সামনে হঠাৎ যেদিন তার কাকিমা মারা গ্যালো, মাত্র তিন মাসের অসুখে ভুগে, সেদিন ছেলেটা প্রথম শুনেছিল ব্লাড ক্যান্সার নামটা। তারপর স্কুলের বইটা আতিপাতি করে খুঁজেও জানতে পারেনি সেরকম কিছু। সেদিনই খালিসা ভাঙ্গা হাইস্কুলের ছেলেটার মনে জন্ম নিয়েছিল এই রোগ সম্পর্কে জানার সুপ্ত বাসনা।
মেদিনীপুরের কৃষক পরিবারের ছেলেটা লেখাপড়ার পাশাপাশি কখনও গাই দোয়াত, কখনও বাবাকে ক্ষেতের কাজে সাহায্য করত, কখনো আবার হাত লাগাত কারখানার শ্রমিকদের কাজেও। কিন্তু যা আয়, তাতে ভালো করে দুমুঠো অন্ন জুটত না৷ ছেলেটা ততদিনে স্কুল পাশ করে যুবক হয়েছে৷ সংসার চালানোর জন্য অর্থোপার্জন এর তাগিদে ছেলেটা হাজির হল কলকাতায়।
এসে মুকুন্দপুর হাসপাতালে মাসিক ৪৫০০ টাকা বেতনে একটা চাকরি জোটালো। রুগীদের কাগজপত্র দেখা, তাদের সঠিক ডিপার্টমেন্ট এর দিকনির্দেশনা ছিল তার দায়িত্ব। সাথে চলত ইংরেজিতে কথা বলার প্রশিক্ষণ। আর মনের সুপ্ত ইচ্ছার তাগিদে কলেজ ষ্ট্রীট থেকে পুরোনো ফিজিওলজির বই কিনে পড়া।
এরপর হঠাৎ একদিন আমরিতে আগুন লাগল। ছেলেটা চাকরি পালটে চলে এল নিউ টাউনের টাটা মেডিকেল সেন্টারে। টেলিফোন অপারেটর হিসাবে। মাইনে দ্বিগুণ। এখানে এসে বুঝল যে সে তার স্বপ্নপূরণের জন্য একদম সঠিক জায়গায় চলে এসেছে। ফোন ধরার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রুগীদের প্রেসক্রিপশন পড়তে শুরু করল। সহকর্মীদের সহায়তায় পেল ল্যাবরেটরি এবং লাইব্রেরিতে প্রবেশের অধিকার।
তার এই আগ্রহ দেখে, এক সিনিয়র তাকে উপদেশ দিল, ফিজিওলজিতে গ্র‍্যাজুয়েশন করে নিতে। সেটা ২০১২ সাল। কলকাতায় কিছু কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। খবর পেল কানপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সুযোগ মিলতে পারে।
২০১৩ এর জুন। নিউ টাউনের বাসট্যান্ডে দাঁড়িয়ে। বাসায় ফেরার বাস ধরতে। অথচ সেই বাসে না উঠে, উঠে পড়ল হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার বাসে। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই। স্টেশনে নেমে টিকিট কেটে চেপে বসল সন্ধ্যের কালকা মেলের জেনারেল কামড়ায়। গন্তব্য কানপুর। পকেটে পড়ে মাত্র ৩০০ টাকা।
এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দেখা মিলল এক যুবকের সাথে, যার বাবা চাকরিসূত্রে কিছুকাল বাংলায় ছিল। ছেলেটার অবস্থা দেখে তারাই ব্যবস্থা করে দিল থাকার, ফর্ম ফিলাপ ও জমা দিতে সাহায্য করল। এতক্ষণে ছেলেটা বাড়িতে সব জানাল ফোন করে। সব কথা শুনে, ছেলেটার বাবা তার জমা করা পয়সা পাঠিয়ে দিলেন লেখাপড়ার জন্য, যেটা তিনি ভেবেছিলেন পাকা বাড়ি তৈরীতে খরচা করবেন।
ফের শুরু হল ছাত্রজীবন। দিনে লেখাপড়া, রাতে কখনও পিৎজার দোকানে কাজ, কখনো হাসপাতালে রিসেপশনিস্ট। আর ছুটির দিনে ছাত্রপড়ানো। সাথে মা তার অবশিষ্ট গয়না মর্টগেজ রাখলেন ছেলের পড়ার খরচ দিতে। এদিকে বাড়িতে বাবা অসুস্থ, ভাইও স্বাবলম্বী হয়নি---- ছেলেটা ভাবল লেখাপড়া ছেড়ে ফের পার্মানেন্ট চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা করা উচিত। এই সময় আরেক সহমর্মী অধ্যাপক তাকে একটা ল্যাব এন্টেডেন্টের চাকরি জুটিয়ে দিলেন। যাতে তাকে লেখাপড়া ছাড়তে না হয়।
এইভাবে গ্র‍্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করে ছেলেটা আবেদন করল দিল্লীর অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট ফর মেডিকেল সায়েন্সে। মেডিকেল বায়োটেকনোলজি তে উচ্চশিক্ষার জন্য। এডমিশন টেস্টে প্রথম স্থান দখল করে বেছে নিল নিজের গবেষণা ক্ষেত্র। বিষয়ঃ কিভাবে ক্যান্সার কোষের মাইগ্রেশান হয় বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের ভিতরে।
এখানেই তার পরিচয় হল চিকিৎসক শুভদীপ কর্মকারের সাথে, যিনি সদ্য ব্লাড_ক্যান্সারের ওপর গবেষণা করে ফিরেছেন আমেরিকা থেকে, সেই ব্লাড ক্যান্সার যা তার কাকিমার জীবন নিয়েছিল। দুবছর তার গবেষণাগারে কাজ করে ছেলেটা এমএসসি শেষ করল ২০১৭ এর সেপ্টেম্বরে। সাথে সাথে পেয়ে গেল জাপানের ইয়ামাগুচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্সারের ওপর গবেষণার জন্য ফেলোশিপ।
কিন্তু জাপানে গবেষণা এবং হাসপাতালে কাজ করতে তার মন টিকত না। মনে হত ভারতে ফেরার কথা, মায়ের কথা যাওয়ার কথা। অবশেষে ছেলে ফিরল দেশে। যোগ দিল ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ বায়োমেডিকেল জিনোমিক্স এ। সিনিয়র ফেলো হিসাবে৷ মায়ের কাছেও। মর্টগেজ রাখা গয়না ছাড়াতে হবে যে!
যে ছেলে, শোভন আচার্য, একদিন তার কাকিমাকে ক্যান্সারে মারা যেতে দেখে দুঃখে ভেঙে পড়েছিল, আজ সেই ছেলের লক্ষ্য হল দেশের মাটিতে এমন প্রযুক্তি গড়ে তোলা যাতে ক্যান্সারের নির্ধারণ খুব কম খরচে সম্ভব হয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের এই যাত্রায় তার স্বপ্ন সফল হোক, এটাই কামনা।।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়