Ameen Qudir
Published:2017-02-18 15:35:38 BdST
জীবন থেকে নেয়া গল্পটি হয়তো "আমার,তোমার , আপনার"
ডা. নাসিমুন নাহার
_______________________________
আমাদের যেদিন অফিসিয়ালি ডিভোর্স হলো সেদিন ছিল শনিবার।ছোটবেলায় দাদী বলত--'বুইঝছ বুইন্ডি শনিবারে শনি ঘটে !'
কি জানি !
ঐদিন তো জানতাম না শনিবারে আমার জীবনে শনি ঘটল নাকি আমি শনির রাহু মুক্ত হলাম.।
আমাদের সমস্যার শুরুটা হয়েছিল ঠিক বিয়ের দিন থেকেই।বিয়ের অনুষ্ঠানে আমার এক্স মাদার ইন ল -আমার অতীতের সবথেকে গুরুত্ব পূর্ণ চরিত্রে থাকা মানুষটি (!); বিয়ের খাবার স্পর্শ না করে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষনা করছিলেন আমার সাথে ।ওনার কথা ছিল---ওনার একমাত্র ছেলের জন্য দশ জায়গায় মেয়ে দেখবে তারপর বিয়ে দিবে অথচ ওনার রাজপুত্রের মতো দেখতে ছেলে এই খুব সাধারণ দেখতে মেয়েটিকে বিয়ে করতে কেন পাগল হলো ??!! নিশ্চয়ই এই মেয়ে তার ছেলেকে জাদুটোনা করেছে !! কি হাস্যকর কথা, একজন সরকারী চাকরী করা যথেষ্ট শিক্ষিত মহিলা এগুলো বলে বলে দিনের পর দিন আমাকে আঘাত করতেই থাকতেন।
অথচ সত্যটা ছিল এ রকম -- আমি মেডিকেল ছাত্রী বলে আমার বাসা থেকে কখনোই ইন্জিনিয়ারের সাথে বিয়ে দিতে কোনভাবেই রাজী ছিল না।অথচ আমার এক্স হাজবেন্ড কোনভাবেই আমাকে ছাড়া আর কোন মেয়েকে বিয়ে করবে না বলে চরম সিদ্ধান্তটা তার বাসায় জানানোর পরে তার বাবা এবং বোনেরা মিলে বারবার আই রিপিট রিফিউজ হবার পরেও বারবার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে থাকে আমার বাসায় তিন বছর ধরে।
যাহোক বেচারা অনেক স্ট্রাগল করেই আমাকে পেয়েছিল।আমিও তাকে পেয়েছিলাম পুরোটুকুই.........
কিন্তু ভাগ্য এবং সময় আমাদের সাথে ছিল না প্রথম দিন থেকেই।
বিয়ের রাত যাকে আমরা বাসর রাত বলে থাকি ঐদিন আমাদের বিছানায় ওর বোনেরা একটা মাত্র বালিস দিয়ে ফিসফিস করে আমাকে তাদের ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে বলেছিল -- এই বাসায় তোমাকে আমরা মেনে নেইনি।শুধু ভাইকে হারাতে হবে বলে এইসব লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা।আজকে এই একটা বালিশ দিয়ে এই বাড়িতে আমাদের কাছে তোমার অবস্থান ঠিক কি তা বুঝিয়ে দিলাম ! কেমনে সংসার কর দেখব !
নতুন বৌ আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতেই থাকলাম।
আমি তখনও ছাত্রী বলে আমাদের সম্পর্ক টা ছিল অনেকটাই long distance relationship এর মতো।মাসে একবার দেখা, ফোনে কথা এভাবেই চলছিল আমাদের বিবাহিত জীবন।
পরিবার যখন আপনার বিরুদ্ধে থাকে এবং আপনাদের সম্পর্কটা যদি দূরত্বের হয় তাহলে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ ঘটে যায়, নিজেদের মাঝে নিজেদের অজান্তেই এত গ্যাপ সৃষ্টি হয়ে যায় যে তখন দেখা হওয়া মাত্রই ছোটছোট ইস্যু নিয়ে ঝগড়া করতে করতেই সময় শেষ হয়ে যায়।আমাদের সাথেও তাই হচ্ছিল।
ভুল বোঝাবুঝি এতোই মারত্বক পর্যায়ে চলে যেত যে ও পারত না নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে।আমি ছাড়া আর কেউ তো ওর আসলে ছিল না যার উপর সহজে ও রাগ ঝাড়তে পারে।তাই ইচ্ছে মতো মারত আমাকে............মায়ের উপরে রাগ,বোনের উপরের রাগ, অফিসের রাগ সবকিছুই ঢালত আমার উপরে।আমি তখন শুধুই অবাক হয়ে দেখতাম ওকে, কাঁদতে ভুলে যেতাম।যে মানুষটা প্রচন্ড ভালোবেসে বিয়ে করল আমাকে সেই একই মানুষ কিভাবে পশুর মতো মারতেই থাকত আমাকে.........আমার ভীষন কষ্ট হতো।
বাবা মায়ের খুব আদরের মেয়ে ছিলাম কিনা........আব্বু কোনদিনও মা ছাড়া কথা বলেনি আমার সাথে।আমার বাসায় কেউ জানত না ও যে আমার গায়ে হাত তোলে।নিজের হাজবেন্ডকে পৃথিবীতে কোন মেয়ে ই কিছুতেই চায় না বাবার বাড়িতে ছোট করতে, তা যতই খারাপ স্বামী সে হোক না কেন।
রাগ কমে গেলে সে কিন্তু সরি বলত আমাকে, ভালোও বাসত, বলত -- আমি কি করব বল? সবাই আমার মাথা খারাপ করে দেয়।তুমি বেশিদিন আমার সাথে থাকবা না। এক দুদিন থেকে হোস্টেলে নাহয় তোমার বাবার বাসায় ফিরে যাও।আমাদের সম্পর্ক এভাবেই চলুক !!!
এভাবেই চলছিল।এরমধ্যে ওর বাসা থেকে প্রচন্ড প্রেসার দিতে থাকল বাচ্চার জন্য।নাতীর মুখ না দেখে মরতে হবে তাদেরকে ! কি দরকার ছিল ডাক্তারী পড়ুয়া মেয়ে বিয়ে করার !!
যাহোক আমি ঠিকই কনসিভ করে ফেললাম।আর ঠিক তখন থেকেই ভীতু ভীতু গাধা টাইপের এই আমি বদলে যেতে শুরু করলাম একটু একটু করে।এখন আর আমি শুধু একজন মেয়ে নই, একজন মানুষের মা হতে যাচ্ছি।মায়েদের নরম দুর্বল হলে চলে না, কিছুতেই।
পুরো প্রেগনেন্সি পিরিয়ডটা আমি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে ই কাটাই। ততদিনে আমি ঠিকই বুঝে ফেলেছিলাম--ডাক্তার আমাকে হতেই হবে।আমার জীবনটা নরমাল না হবার সম্ভাবনা খুবই বেশী।আমার হাজবেন্ড ঐসময়েও আমার গায়ে হাত তোলা বন্ধ করতে পারেনি।সে একদিন আমাকে বলল---listen প্রেগনেন্ট হয়েছ বলে এক্সট্রা এটেনশন সিক করবা না।এইটা সব মেয়ের জন্য খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা।ঐদিনের পরে আর কোনদিন তার মনোযোগ আশা করিনি।ইন্ট্রোভার্ট আমি দিনে দিনে ডিপ্রেশনের রোগী হয়ে যেতে থাকলাম।
বাচ্চা হয়ে যাবার পরে তার নতুন এক চেহারা দেখার ভাগ্য হলো আমার।বাচ্চা বাচ্চা করে অস্থির যে পরিবার তারা আমার লেবার পেইন ওঠার এবং হাসপাতালে নেবার পনের ষোল ঘন্টা পরে এসে হাজির হন।তার মায়ের যুক্তি ছিল -- ব্যাথা উঠলেই সাথে সাথে বাচ্চা হয়ে যায় না।তুই এখন ঘুমা।ওর সাথে ওর বাবা মা আছে।!!! অথচ ঐ রাতে- জীবনের ভয়াবহতম দীর্ঘতম রাতে ওকে আমি ভীষণভাবে ই আমার পাশে চাচ্ছিলাম শেষবারের মতো।
আমার obstructive labor থাকায় ম্যাডাম সিজারের সিদ্ধান্ত নেয়ায় রীতিমত ম্যাডামের সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়।এগুলো নাকি হাসপাতালের টাকা নেবার ধান্ধা !! তার পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট বোন ঘোষনা দেয় -- এভাবে থাকতে দে, সময় হলে বাচ্চা বাইর হবে, ডাক্তাররা এসব বলেই !!!
যাহোক বাচ্চা হবার পর সে যোগাযোগ করা একদমই কমিয়ে দিল।সে যে শুধু একজন দায়িত্বহীন স্বামীই নয় বরং একজন দায়িত্বহীন পিতাও তা প্রমান করল।
সে তার বাসায়, আমি মেডিকেলে আর বাচ্চা আমার বাবা মায়ের বাসায় এভাবেই কোনরকম যোগাযোগহীন ভাবেই আমি MBBS পাশ করে ফেললাম। অজস্র কান্নাময় নির্ঘুমরাতের বিনিময়ে, অসংখ্য ঘুমের বড়ির সংস্পর্শে, সন্তানের থেকে দূরে থেকে।ততদিনে আমি জেনে গেছি পৃথিবী টা একটা যুদ্ধক্ষেত্র হতে যাচ্ছে আমার জন্য।ডাক্তার হতে না পারলে আমি কিছুতেই যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়াতেই পারব না।তাই দাঁতে দাঁত চেপে বই নিয়ে পরে থেকেছি।
অতঃপর বছরখানেক কোন রকম যোগাযোগহীন থাকার পরে পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত হলো আমাদের অফিসিয়ালি আলাদা হতে হবে, আমাদের ভবিষ্যত আছে না !!!!
কাগজে সাইন করার সময়ে এক ফোঁটা জল ছিল না আমার চোখে।কাজী বলল-- বলেন সব দেনা পাওনা আপনি মাফ করে দিচ্ছেন।খুব হাসি পাচ্ছিল আমার।মানুষটাই আমার থাকছে না, সেখানে আবার দেনা পাওনা !! প্রথমবারের মতো উচ্চ স্বরে বলে উঠলাম --মাফ করার মালিক আল্লাহ, আমি কেউ না।একবার তাকালাম ওর দিকে।তারপর মাথা উঁচু করে গাড়িতে এসে বসলাম।বাসায় ফিরে কলিজার টুকরো বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে দরজা বন্ধ করে খুব কাঁদলাম।সমস্ত চোখের জলে এক জীবনের ভালোবাসার দায় মেটালাম যেন।ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়লাম আর প্রতিজ্ঞা করলাম----বাবা আমি কখনোই তোকে ছেড়ে যাব না।নিজের সুবিধার জন্য , সুখের জন্য, পৈতৃক সম্পত্তির লোভেও না ! মা একাই তোকে সম্মানের একটা জীবন দেবে,ঠিক দেখে নিস।
এরপর অবধারিত ভাবেই সমাজ হাজার হাজার প্রশ্নে কৌতুহল দৃষ্টিতে আমাকে ছিঁড়ে খুবলে খেল.......প্রতিদিন মরতে হলো আমাকে।
আমি লাকি পুরোটা সময় আমার পরিবার এবং কাছের কিছু বন্ধু দেয়াল হয়ে সাথে ছিল।
বছরখানেকের মধ্যে অসহনীয় হয়ে উঠছিল পরিচিত জীবনটা।
তাই জীবনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য ছোট্ট বাচ্চাটার হাত ধরে অজানা অপরিচিত এক পৃথিবীতে পা বাড়ালাম আমি চাকরি সূত্রে।শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে শান্ত শীতল প্রকৃতিরকোল ঘেষা পৃথিবীর কোন এক কোনে এসে আস্তানা গেঁড়ে বসলাম একদম একা--- নিজের উপর বিশ্বাস, সাহস আর একাডেমিক সার্টিফিকেটগুলোর ভরসায়।
সন্তানকে নিজের পরিচয়ে মানুষ করব বলে।এই নোংরা চরম হিপোক্রিয়েট সমাজকে কিছুতেই সুযোগ দিব না আমার সন্তানের দিকে আঙুল তুলে বলার ---ও তো নানা বাড়িতে মানুষ !!
আজ তিন বছর হলো ঠিকই টিকে আছি নিজের পরিচয়ে , সততাত সাথে, কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে, মাথা উঁচু করে, আশেপাশের সবার কাছে কৌতুহল ছাপিয়ে সম্মানের দৃষ্টিতে-- সবার ডাক্তার ম্যাম/দাক্তুরনী হয়ে একদম সত্য পরিচয়ে।
অনেক ভয় ছিল মনে----একজন ডিভোর্সির সন্তানের স্কুলিংটা সহজ ছিল না কিছুতেই।কিন্তু আমার সন্তানের পরিচয় ডিভোর্সীর ছেলে নয় বরং ডাক্তারের ছেলে হিসেবেই গণ্য হয়।
এই পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত শুধু যোগ্য এবং যোদ্ধারা ই টিকে থাকে।
কিছু কিছু মেয়ে ভীষন unpredictable হয়।ওরা জীবনে কখনো হেরে যায় না ।
_____________________________
ডা. নাসিমুন নাহার । দেশের জনপ্রিয় কলামিস্ট । লেখক।
আপনার মতামত দিন: