Ameen Qudir

Published:
2017-02-11 17:04:48 BdST

দিনমজুরের ৬ মেয়ে: ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র,আইটি, পুলিশ অফিসার,মেয়র


ডাক্তার প্রতিদিন ও এই সময়
_________________________

‘শিক্ষা সব চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা দিয়ে তুমি গোটা বিশ্ব পাল্টাতে পারো।’ নেলসন ম্যান্ডেলার এই অমর বাণী-ই সত্যি করে দেখালেন এমন একজন মানুষ যাঁকে পড়াশোনা চালানোর জন্য খেতমজুরের কাজ করতে হয়েছে। যিনি দলিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও গ্রামের প্রথম ব্যক্তি হিসাবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। যেখানে মেয়ে সন্তানকে অভিশাপ বলে মনে করা হয়, সেখানে নিজের ৬ কন্যা সন্তানকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন নীরবে কাজ করে যাওয়া এক ‘হিরো’কে নিয়েই এই নিবেদন।

 রাজস্থানের জয়সলমের জেলার চেলাক গ্রামে এক দলিত পরিবারে জন্ম রূপরাম ধনদেবের। খেতমজুর বাবা পরিবারের খুন্নিবৃত্তি করতেই দিন গুজরান করতেন। তবুও সেটা সম্ভব হত না।

গ্রামের পাঠশালায় পড়াশোনা শুরু করেন রূপরাম। সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লাগাতার প্রথম হওয়ার পর পাঠাশালার প্রধান শিক্ষকের নজরে পড়েন রূপরাম। প্রধান শিক্ষক গিয়ে তাঁর বাবাকে অনুরোধ করেন যাতে ছেলের পড়া বন্ধ না হয়। ২৭৫ কিমি দূরে নাচনা গ্রামে এক সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়ে যান রূপরাম। সেখানেও অব্যাহত থাকে তাঁর প্রথম হওয়ার দৌড়।

এর পর আর গ্রামের গণ্ডিতে তাঁকে বেঁধে রাখা যায়নি। জয়সলমেরে হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় সেই গ্রামের স্কুলের শিক্ষকই তাঁকে সাহায্য করেন। তাঁর পরামর্শেই অঙ্ক নিয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হন। একাদশ শ্রেণিতে দুরন্ত ফল করেন। পরে শিক্ষকদের পরামর্শেই তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করেন। রূপরামের কথায়, ‘সেটাই ছিল আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটাই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আমার পরিবারে কেউ লেখাপড়া জানতেন না। তাই কারও সঙ্গে পরামর্শ করতে পারতাম না। শিক্ষকদের কাছ থেকে যে সাহায্য পেয়েছি তা জীবনে ভুলব না।’

রাজস্থানের নিয়ম মেনে অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। তবে তাতে পড়াশুনার কোন বিঘ্ন ঘটেনি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া মানে ৫ বছরের পড়াশুনা। সঙ্গে বিপুল টাকার যোগান। সেখানেই ফের আটকে গিয়েছিলেন রূপরাম। কারণ খেতমজুর বাবার পক্ষে সেই টাকা যোগানো সম্ভব ছিল না। তখন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন গ্রামের জমিদার। যার জমিতে দিন মজুরি করতেন রূপরামের বাবা। জমিদার রূপরামের পড়াশুনার সমস্ত খরচ দেন।

রূপরাম বলেন, অনেকে বলেন বিয়ের পর নাকি পড়াশুনা করা যায় না। আমি তা মানতে পারব না। আমার স্ত্রীর অনুপ্রেরণাতেই আমি আরও ভালো ফল করতে পেরেছি

তবে পড়াশুনার পাশাপাশি সপ্তাহান্তে গ্রামে গিয়ে খেত মজুরি করতে হয়েছে তাকে। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় প্রথম কন্যা অঞ্জনার জন্ম। বছর দুয়েক বাদে ভালো নম্বর নিয়ে বি,এ টেক পাশ করেন রূপরাম। এরপর সরকারি দপ্তরে ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পান।

পরপর মেয়ে জন্মানোয় গ্রামে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়, কিন্তু কোন কিছুতেই কান দেননি রূপরাম। শুধু তাই নয় নিজের মেয়েদের ছেলের চেয়ে কোন অংশে কম মনে করেননি রূপরাম। তাদের পড়াশুনায় কোন খামতি রাখেননি তিনি।

মূলত তাঁর অধ্যাবসায়ের ফলেই ৬ মেয়ে ও এক ছেলে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে শীর্ষে পৌঁছেছেন। প্রথম মেয়ে অঞ্জনা, স্বামীকে সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়েও বাবার অনুপ্রেরণায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করে মেয়র হয়েছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মেয়ে গোমতি ও রাজেশ্বরী যথাক্রমে জেলার প্রথম মহিলা ডেন্টিস্ট ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হয়েছেন। চতুর্থ কন্যা আইটি ইঞ্জিনিয়ার এবং এমবিএ করার পর পুলিশ সার্ভিসে দুরন্ত ফল করেন। এখন তিনি ডিএসপি পদে কর্মরত। পঞ্চম কন্যা ধাওয়ানা সবচেয়ে কম বয়সি হিসেবে আইইটি জোধপুর থেকে বিএ টেক করেন। ষষ্ঠ কন্যা প্রিয়া ক্যালিফোর্নিয়াতে মাস্টার্স করছেন।

দিদিরা যেমন তারচেয়ে কোন অংশেই কম নন ভাই হরিশ। জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সরকারি চাকরি করতে করতে তিনি ঠিক করেন চাষাবাদে মন দেবেন। ২০১০ সালে বাবা রূপরাম অবসর নেওয়ার পর থেকে তিনি চাকরি ছেড়ে অ্যালোভেরা চাষে মন দেন। আজ বছরে কয়েক কোটি টাকার অ্যালোভেরা বিক্রি হয় তার ফার্মে।

রূপরাম বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় আমার কাছে আর একটি পোশাক ছিল। প্রতি রাতে আমি তা ধুয়ে দিতাম যাতে পরের দিন ফের পরতে পারি। আমার মনে হয় তোমার জন্ম কোথায় হয়েছে বা তুমি কোথা থেকে এসেছ সেটা কোনও ব্যাপারই নয়। দিনশেষে একটি জিনিসই বিবেচ্য হবে তুমি শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছুতে পারলে’। এই শিক্ষায় সন্তানদের শিক্ষিত করেছেন রূপরাম।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়