SAHA ANTAR

Published:
2021-09-03 14:15:27 BdST

বিনামূল্যে সব অতিমারী রোগীর জীবন বাঁচাচ্ছে কুমুদিনী হাসপাতাল


ছবি ডেলি স্টার

 


শাহনেওয়াজ খান চন্দন

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম/ ডেলি স্টার _____________


কোভিড-১৯ আক্রান্তদের যখন বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে, তখন টাঙ্গাইলের ছোট শহর মির্জাপুরের একটি হাসপাতাল হাঁটছে ঠিক উল্টো পথে। গত বছরের মে মাস থেকে সব করোনা রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে এই হাসপাতাল।

হাসপাতালটির সব করোনা রোগীকে বিনামূল্যে শয্যা, অক্সিজেন থেরাপি ও চেক-আপ সুবিধা দেওয়া হয়। এমনকি খাবারও বিনামূল্যে পান তারা।

বলা হচ্ছে শহীদ সমাজসেবী রণদা প্রসাদ সাহার কুমুদিনী হাসপাতালের কথা।

কুমুদিনী হাসপাতালের সহকারী মহাব্যবস্থাপক অনিমেষ ভৌমিক বলেন, 'আমরা কোভিড-১৯ রোগীদের কাছ থেকে জেনারেল বেড ও অক্সিজেন থেরাপির জন্য কোন চার্জ নিই না। আইসিইউ বেডের জন্য তাদের দৈনিক তিন থেকে চার হাজার টাকা খরচ করতে হয়, যেখানে অন্যান্য হাসপাতালে প্রতিদিনের আইসিইউ ৩০ হাজার টাকার বেশি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা রোগীদের বিনামূল্যে অ্যান্টিজেন টেস্টও করি। আর আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ক্ষেত্রে, আমরা নমুনা সংগ্রহ করি এবং প্রতিটি নমুনা ১০০ টাকা মূল্যে সরকার নির্ধারিত পরীক্ষাগারে পাঠাই। রোগীরা এক ছাদের নিচেই সব সেবা পাচ্ছেন।'


সব মিলিয়ে কুমুদিনী হাসপাতাল এই অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবায় অন্যতম ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। যদিও, হাসপাতালটির নাম একটি মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত।

১৯০৩ সালে সাত বছর বয়সী রণদা প্রসাদ সাহা তার মা কুমুদিনী দেবীকে প্রসব-পরবর্তী ধনুষ্টঙ্কারে মারা যেতে দেখেন। কারণ তাকে মির্জাপুর থেকে দূরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মির্জাপুর তখন প্রত্যন্ত গ্রাম।

এ ট্র্যাজেডি রণদা প্রসাদকে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করেছিল। পরবর্তীতে বাংলার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার পর তিনি তার জীবন দরিদ্র ও অসুস্থদের কল্যাণে এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য উৎসর্গ করেন।

তিনি তার সব সম্পত্তি ও সঞ্চয় কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (কেডব্লিউটিবি) গড়ে তোলার জন্য ব্যয় করেন। এ ট্রাস্ট এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় দাতব্য সংস্থা, যা চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছে।

১৯৭১ সালের ৭ মে রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে পাকিস্তানি বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। তারা আর ফিরে আসেননি। তবে, এ অপূরণীয় ক্ষতির পরও সমাজসেবী পরিবারটি দাতব্য কাজ অব্যাহত রেখেছে।

বর্তমানে কেডব্লিউটিবি নয়টি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, যার সব আয় দাতব্য কাজে ব্যয় করা হয়।

কেডব্লিউটিবি সম্প্রতি আরেকটি মানবিক উদ্যোগ নিয়েছে। একটি বিশ্বমানের চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে এটি। এর নাম দেওয়া হয়েছে কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস অ্যান্ড ক্যান্সার রিসার্চ (কেআইআইএমএসসিএআরই)।

এ কমপ্লেক্সে একটি ৩০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল, একটি ৫০ শয্যার ক্যান্সার হাসপাতাল, একটি মেডিকেল কলেজ, নার্সিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি দেওয়ার জন্য একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং একটি মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট থাকবে।

রণদা প্রসাদ সাহার নাতি এবং কেডব্লিউটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহার জানান, বিশাল এ প্রকল্পের জন্য নারায়ণগঞ্জে জমি প্রস্তুত করেছে কেডব্লিউটিবি। প্রতিষ্ঠাতার নীতি মেনে, কেআইআইএমএসসিএআরই সেখানে দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সবাইকে সেখানে একই মানের চিকিৎসা দেওয়া হলেও, একজন রোগী কত টাকা দেবেন, তা নির্ভর করবে তিনি কতটা সামর্থ্য রাখেন তার উপর।

রাজীব সাহা বলেন, 'পরিকল্পনা ও জমির কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এখন, আমরা রিসোর্স সংগ্রহ করছি। বর্তমানে আমাদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ এটি। এটি আমাদের স্বপ্নের প্রকল্প। আমরা সেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞানে, বিশেষ করে ক্যান্সারের চিকিৎসায় মৌলিক গবেষণা করতে চাই।'

এ পরিবারের জনকল্যাণমূলক উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও বিশেষ উদ্যোগটি হচ্ছে কুমুদিনী হাসপাতাল। ব্রিটিশ বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড আরজি ক্যাসি ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করেন। এখন এটি এক হাজার ৫০ শয্যার একটি জেনারেল হাসপাতাল, যা চিকিৎসা সেবা বহন করতে না পারা মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়।

এমনকি সচ্ছল রোগীদের ক্ষেত্রেও চিকিৎসার খরচ খুবই কম রাখা হয়। বহির্বিভাগ থেকে ২০ টাকার টিকিট কিনে মানুষ টানা এক মাস বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। সব ধরনের সাধারণ সার্জারি এবং গাইনোকোলজিক্যাল অপারেশন চার্জ ৩০০ থেকে ছয় হাজার টাকার মধ্যে।

হাসপাতালটি বছরে সাড়ে চার লাখেরও বেশি রোগীকে আউটডোর সার্ভিস এবং ৬০ হাজার জনকে ইনডোর সার্ভিস দিয়ে থাকে। এ ছাড়া, ২৫ হাজারের বেশি ছোট-বড় অস্ত্রোপচার করা হয় সেখানে।

রাজীব সাহা বলেন, 'আমরা হাসপাতালে ২২টি বিশেষ সেবা দিই। আমাদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসহ ডাক্তার, নার্স ও টেকনোলজিস্টদের একটি দল রয়েছে।'

এ ছাড়া, কেডব্লিউটিবি ১৯৭৩ সালে কুমুদিনী নার্সিং ইনস্টিটিউট, ২০০১ সালে কুমুদিনী মহিলা মেডিকেল কলেজ এবং ২০১৯ সালে কুমুদিনী মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে।

২০২০ সাল পর্যন্ত চার হাজার ৫৮২ জন নার্স কেডব্লিউটিবির নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। মেডিকেল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন এক হাজার ৯২১ জন ডাক্তার। এ ছাড়া, প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরে ১৪ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন।

রাজীব সাহা বলেন, 'আমরা সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে শিক্ষা ও বোর্ডিং সুবিধা দিই। সচ্ছল ছাত্র-ছাত্রী ও রোগীদের কাছ থেকে আমরা যে ফি পাই, তা দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার খরচ এবং দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়। আমরা একেবারেই অলাভজনক।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থীরা যেন নিঃস্বার্থ হয় ও পরোপকারের আদর্শে পূর্ণ থাকে, আমরা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। আমাদের নীতিবাক্য হচ্ছে জাতি, শ্রেণি বা ধর্ম নির্বিশেষে সবস্তরের মানুষের সেবা করা।'

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়