SAHA ANTAR

Published:
2021-08-28 23:19:50 BdST

হেলাল উদ্দিন :নিঃস্ব, জ্ঞানী , অতি উদার, নীতিতে অনমনীয়, ধৈর্যশীল, লোভহীন , নিঃস্বার্থ , সৎ, দুঃখে ভারাক্রান্ত, অভিমানী একজন মানুষ


 

নজরুল ইসলাম চুন্নু
সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব
____________________

বরিশালের অন্যতম কীর্তিমান মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলাল উদ্দীন। তার আরো পরিচয় তিনি একজন গবেষক, লেখক, অনুবাদক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। এছাড়াও নানান বৈচিত্রময়তায় ভরপুর তার কর্মজীবন।

হেলাল উদ্দীন ১৯৪৪ সালের পহেলা জানুয়ারি ভোলা জেলার দৌলতখায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম লিয়াকত হোসেন এবং মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। তার একমাত্র সন্তান অনিক উদ্দীন লেখালেখির চর্চায় ব্যস্ত।

বরিশালের ব্রাউন কম্পাউন্ড, ভাটিখানা এলাকায় তার দূরন্ত কৈশোর ও যৌবনের কিছুকাল কেটেছে। বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, বিএম কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করেছিলেন তিনি। যা শুধুমাত্র একাডেমিক পড়াশুনার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তার পঠন পাঠন ছিল অত্যন্ত বিস্তর ও ব্যাপক। তিনি অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান রাখেন ।

তিনি সাহিত্য অঙ্গনে সেই সময়ে বরিশালে ছিলেন প্রথম কাতারের একজন মানুষ। সেইসময় কিছু গ্রন্থসম্পাদনা করেছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের “সর্বহারা” কাব্যগ্রন্থের একটি "স্বতন্ত্র সংস্করণ" বরিশাল থেকে প্রকাশ করা হয় যেটার গ্রন্থ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন হেলাল উদ্দিন ।

তারপর দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনিও সক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আটঘর, কুড়িয়ানা,সাতলা এলাকায় ও খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যুদ্ধ করেন তরুণ হেলাল উদ্দিন ।

সে সময় বরিশাল যুবসংঘের কর্মীরা বরিশাল কালীবাড়ি রোডস্থ ধর্ম রক্ষিণী সভাকক্ষে শুরু করল দেশীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির কারখানা। এসব গোলাবারুদ চাঁদপুর, খুলনা গল্লামারি যুদ্ধে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছিল। হেলাল উদ্দিন এই কাজের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল তারিখে বরিশাল যুবসংঘের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় অনিয়মিত অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা “বাংলাদেশ"। সেটি ছিল যুদ্ধের স্বপক্ষে শ্লোগান তোলা স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংবাদপত্র। হেলাল উদ্দিন ছিলেন সে সংবাদপত্রের অন্যতম একজন সম্পাদক। "বিপ্লবী বাংলাদেশ" নামে একটি পত্রিকা ৯নং সেক্টরের মুখপাত্র হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ থেকে প্রকাশিত হত যা পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর বরিশাল থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। হেলাল উদ্দিন ছিলেন এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হেলাল উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করার জন্য পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেন। ৮ই ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবসে তিনিও মুক্ত হন।

দেশ স্বাধীন হল। তিনি শায়েস্তাবাদ হাইস্কুলের বিজ্ঞান এর শিক্ষক হিসাবে যোগদান করলেন। সে সময় শিশু সংগঠন "খেলাঘর" করতেন তিনি। পরবর্তীতে শিশু সংগঠন "চাঁদের হাট" গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। 'তথ্য কেন্দ্রের পাঠাগার' এর গ্রন্থাগারিক হিসাবেও কাজ করেন হেলাল উদ্দিন।

১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত একটানা তিনি বিভিন্ন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের নানান গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালন করেন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশ এর উন্নয়ন ও পুনঃনির্মাণে সেসব কাজের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

১৯৮৯ সালে তিনি আমেরিকায় চলে যান, সেখানকার ভারমণ্ড ইউনিভার্সিটিতে তিনি প্রাচ্যের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব এই বিষয় এর উপর লেকচার প্রদান করতেন। পাশাপাশি অনান্য আরো কয়েকটি ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার কাজ করেন তিনি।

১৯৯৬ সালে আমেরিকাতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকার Program Director এবং একজন Founder member হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তিনি।

Program on EPI (Expended Program on Immunization in Bangladesh) এবং
Ritual of Child Birth in Rural Bangladesh এই দুটি বিষয়ের উপরে তার দুটি রিসার্চ পাবলিকেশন আছে।

তিনি একজন Phlebotomy Techician হিসাবে নিউইয়র্কের Health Care Career থেকে ১৯৯৩ সালে একাডেমিক ও ক্লিনিক্যাল উভয় ক্ষেত্রে Qualified হন।

তিনি পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু করেন । তিনি আমেরিকায় থাকাকালীন সময় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর সাথে কিছু কাজ করেন। আমেরিকাতে থাকাকালীন সময়ে তিনি সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর বিখ্যাত বই “The Brief History Of Time” এর সফল সুন্দর অনুবাদ করেন। আমেরিকার কোন এক পাবলিশার সেই অনুবাদের কপি দিতেও বলেন প্রকাশ করার জন্য। তিনি প্রকাশ করতে রাজিও হয়েছিলেন, কিন্তু প্রকাশকের ভাষাগত কিছু ব্যাপারে তার প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সেটি আর প্রকাশের জন্য ওই প্রকাশককে দেননি। সেই কপিটি এখনও হেলাল উদ্দিন এর বাসায় সংরক্ষিত রয়েছে।

এছাড়াও তিনি স্টিফেন হকিং এর কাজের উপর ভিত্তি করে হকিং যেসব পদার্থবিজ্ঞান এর Term ব্যবহার করেছিলেন তার উপর একটি রিসার্চ কাজ করেন যা এখনও ভারমণ্ড ভার্সিটিতে রয়েছে। তিনি ভারমণ্ড ইউনিভার্সিটির রিসার্চার লেসলি লং এর সাথেও কাজ করতেন।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আমেরিকা থেকে দেশে চলে আসেন।

সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিশেষভাবে কোন কাজ পরিচালনা করার সামর্থ্যে হেলাল উদ্দিন কে একজন আদর্শ বলা যায়।

২০২০ সালের ০৩ জানুয়ারি হেলাল উদ্দিনকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভাস্কর চিত্তহালদার সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করেন বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়ুর রহমান।

এই গুণী মানুষটিকে একরকম বলা যায় নিঃস্ব, অতি জ্ঞানী , অতি উদার, নীতিতে অনমনীয়, ধৈর্যশীল, লোভহীন , নিঃস্বার্থ , সৎ, দুঃখে ভারাক্রান্ত, অভিমানী একজন মানুষ। হীণ ব্যক্তিস্বার্থ তিনি বুঝতেন না। এই কীর্তিমান মানুষটি বর্তমানে বরিশাল সদর উপজেলার দঃ দুর্গাপুর গ্রামে তার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে অবসর জীবন পার করছেন। বর্তমানে অত্যন্ত অসুস্থ ও প্রায় দৃষ্টিশক্তিহীণ অবস্থায় বাড়িতে রয়েছেন তিনি।

এই মহান মানবের সুবিশাল কর্মযজ্ঞই তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত করেছে।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়