Ameen Qudir

Published:
2017-02-10 18:31:09 BdST

সাংবাদিক বন্ধুদের হাতে ‘সত্যের অপমৃত্যু’




 

ডা. বাহারুল আলম
________________________

 

 

সাংবাদিক/সংবাদকর্মী বন্ধুদের হাতে ‘সত্যের অপমৃত্যু’ — চিকিৎসকদের বিষয়ে জনমনে জটিল অবস্থা সৃষ্টি করছে (প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে)
.............................................
চিকিৎসকের ব্যাপক চেষ্টার পরও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর্যন্ত একটি অভিযোগও উত্থাপিত বা প্রমাণিত হয় নি। চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার ভূমিকা ব্যাপক। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার কথা এনে ব্যবস্থাপনার ত্রুটিকে আড়াল করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত সকল হাসপাতালে এ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রিত হয় রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর দ্বারা।


প্রচার মাধ্যম এক্ষেত্রে বিবেক শূন্য হয়ে প্রণোদনার কাজ করে। কখনও অনুসন্ধানী হয়ে সত্য উৎঘাটন করে না। উদাহরণের ভিড়ে কেবল একটি উদাহরণই যথেষ্ট , - হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী জরুরি বিভাগে আসলে একটি ইসিজি মেশিনও নাই রোগ সনাক্তের। রোগ সনাক্তহীন ঐ রোগী মৃত্যুবরণ করলে মেরে চিকিৎসকের দাঁত ভেঙ্গে দেওয়া হয়, জরুরি বিভাগ তছনছ করা হয়। সেবিকা সহ অন্যান্য চিকিৎসা কর্মীরা প্রাণ ভয়ে পালাতে থাকে।


পরের দিন সংবাদের শিরোনাম হয়, ‘চিকিৎসকের অবহেলায় /ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু’। সংবাদকর্মী বা সংবাদ মাধ্যম কখনও এই ঝুঁকিপূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ অব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রকে দায়ী করে না, জনগণের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরে না। উপরন্তু সংবাদ প্রকাশের মুল বক্তব্যে চিকিৎসক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাটি মুখ্য হয়ে ওঠে না।
সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি প্রশ্ন রাখি, উপরে বর্ণিত ঘটনার প্রেক্ষিতে কোন নাগরিক যদি বিএমডিসি-তে অভিযোগ করে , চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে অথবা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে সরকার যদি বিএমডিসি কে বলে, ঘটনা তদন্ত করে দোষী চিকিৎসককে শাস্তি দিতে - ঐ সাংবাদিক বন্ধু জবাব দেবেন কি -- তদন্তে চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার নজির পাওয়া যাবে? নাকি ‘রাষ্ট্রের অবহেলা বা ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার জন্য রোগীর মৃত্যু হয়েছে’- পাওয়া যাবে? কোনটি ? বিএমডিসি রাষ্ট্রানুগত বিধায় কখনও রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করবে না।


চিকিৎসায় এ ব্যবস্থাপনার ভূমিকা মুখ্য থাকলেও চিকিৎসক সেটা মোটেও নিয়ন্ত্রণ করে না। অথচ দোষ পড়ে চিকিৎসকের । প্রচার মাধ্যম বা সংবাদ কর্মীরা বিষয়টি কখনও সামনে আনে না। যতটা চিকিৎসককে অহেতুক হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য মিথ্যা অভিযোগ প্রচার করা হয়। রাষ্ট্র ও তার নির্বাহী বিভাগকে কখনও রোগীর মৃত্যুতে নাগরিকদের মুখোমুখি করা হয় না, যতটা করা হয় চিকিৎসকদের।


নাগরিকদের চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক দায়িত্বহীনতার মধ্যে থেকেও রাষ্ট্র ও তার নির্বাহী বিভাগ মোটেও জবাবদিহি করে না। অপরদিকে চিকিৎসক রাষ্ট্রের কর্মচারী বিধায় তাকে নির্বাহী বিভাগ ও জনগণ একসাথে আক্রমণ করে।
পক্ষান্তরে, ‘রোগী বা রোগীর অভিভাবকদের অবহেলায় মৃত্যু হয়েছে’- এ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন দূরে থাক কখনও ভাবা হয় না। অথচ রোগ এবং চিকিৎসার বিষয়ে ব্যাপক অবহেলা থাকে আমাদের দেশে স্বয়ং রোগীর। কখনও সামর্থ্যের অভাবে , কখনও পাশ কাটানো স্বভাবসিদ্ধ। রোগী নিজেই চিকিৎসায় অবহেলা করেছে – এটি জানে তার চিকিৎসক। কিন্তু চিকিৎসকের কথা বলার সুযোগ নেই, তার বক্তব্য প্রচার মাধ্যমে আসে না। কারণ পূর্বাহ্ণেই সে অভিযুক্ত থাকে ‘ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কারণে’। বিষয়টা এমন- ‘ রাম জন্মানোর আগেই রামায়ণ লেখার মত’। জন্মানো রামকে অবশ্যই রামায়ণের পথে হাঁটতে হবে। বাংলাদেশে চিকিৎসকদের একই গুরুদশা।


সেই সংবাদপত্র (প্রথম আলো) আবারো সংবাদ প্রকাশ করলো বিএমডিসি তদন্ত করে চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু খুঁজে পায় না।
'রোগী মৃত্যুতে কোন ত্রুটি পাওয়া যায় নি’- এ রিপোর্ট রাষ্ট্রের অনুকূলে যাবে। কারণ ত্রুটি অবশ্যই ছিল, ত্রুটির কারণেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং সে ত্রুটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার।


প্রথম আলোর সাংবাদিক বন্ধু সেই সত্যটিই গোপন করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক ভাবে তিনি ধারণ করে আছেন , এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যদি বিএমডিসি মিথ্যা বলত যে, ‘তার অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে’, - সেটিই যথার্থ ও সঠিক বলা হত।
‘রাষ্ট্রের অবহেলা ও ত্রুটি ছিল-- এ কথাটি বিএমডিসি যে বলে নি, এ মিথ্যাটাও তার কাছে সত্য বলে বিশ্বাস হয়েছে। সাংবাদিক বন্ধুদের হাতে ‘সত্যের এ অপমৃত্যু’ জটিল অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
আবারো প্রথম আলোর সংবাদ কর্মীদের বলছি, ‘রোগীর অবহেলা ও রাষ্ট্রের অবহেলা’ - এই দুই অবহেলা বাদ দিলে চিকিৎসকের অবহেলা কতটুকুই বা থাকে?


চিকিৎসায় চিকিৎসকদের ভূমিকা কেবল চিকিৎসা শাস্ত্র অনুসারে নির্দেশ দেওয়া বা স্বহস্তে রোগীর শরীর ব্যবচ্ছেদ করা। বাকি সকল কাজ সেবিকা সহ চিকিৎসা কর্মীদের।সেখানে কোন ত্রুটি ঘটলে দোষ পরে চিকিৎসকের উপর। সংবাদ মাধ্যম এ বিষয়েও পাশ কাটিয়ে যায়।


চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলার কোন মানদণ্ড নাই, যার সাথে তুলনা করে নিশিত হওয়া যাবে চিকিৎসক অবহেলা করেছে। চিকিৎসায় ভুল সনাক্ত হওয়া কঠিন ও ব্যয়বহুল বিষয়। নাগরিকদের অজ্ঞতা ও সংবাদ কর্মীদের অতি উৎসাহে বলা হয় ভুল ইনজেকশন দেওয়ার পর মুহূর্তেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অথচ মুমূর্ষু রোগীর জীবন রক্ষার জন্য যে সকল ঔষধ নির্ধারিত সেসকল ঔষধ রোগীর শরীরে প্রবেশ করানোর পরও রোগীর মৃত্যু ঘটে প্রায় শতভাগ। এ জীবন রক্ষাকারী ঔষধ প্রয়োগকেই ফলাও করে সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়, ‘ ভুল ঔষধ প্রয়োগ বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু’।


বর্তমানে আরও আধুনিক ব্যবস্থাপনা আইসিইউ-তে একপর্যায়ে রোগীর মৃত্যু ঘটে, অল্পকিছু সংখ্যক রোগী বেঁচে যায়। সত্য প্রকাশের জন্য সত্যাগ্রহী হতে হয়, তাহলেই কেবল সত্যের প্রকাশ ঘটে। মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে সত্য প্রকাশ সম্ভব না। প্রথম আলোর সাংবাদিক বন্ধুর বিবেক জাগ্রত হোক, আলোকিত হোক প্রথম আলোর মত।

সংবাদে অভিযুক্ত ব্যক্তির পুর্ণাঙ্গ বক্তব্য উপস্থাপন করা সাংবাদিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তা না হলে হলুদ সাংবাদিকতার সৃষ্টি হয়। বিকৃত ও বিক্রীত অবস্থান থেকে সঠিক সংবাদ পরিবেশন করা যায় না।
___________________________

ডা. বাহারুল আলম। লোকসেবী চিকিৎসক। প্রখ্যাত পেশাজীবী নেতা । সুলেখক। সুবক্তা।
___________________________

যে লেখার প্রেক্ষাপটে এই লেখা
তার লিঙ্ক দেয়া হল।

https://epaper.prothom-alo.com/view/dhaka/2017-02-08/3

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়