Ameen Qudir

Published:
2017-02-09 15:48:43 BdST

সাব সেন্টারের ভিলেজ পলিটিক্স :মনে পড়ে কি সেই স্বর্ণালী ইন সার্ভিসের দিনগুলি !


ডা. অসিত বর্দ্ধন
_____________________

ডাক্তারদের এক সময় ইন সার্ভিস ছিল। যারা আজকের নবীন তারা কেউ সেই স্বর্ণযুগের কথা জানেন না। তখন ইন্টার্নশিপের পরেই চাকরি তৈরি। সাধারণত ইন্টার্নশিপের শেষের দিকে বিয়ের ধুম পড়ত। নিজের রাজত্ব আর একজন পাটরানী নিয়ে চিকিৎসক চলতেন মফস্বলে। খুব বেকায়দার লোক হলে একাই। আমাদের ছাত্রবস্থাতেই এই স্বর্গসুখে যতি পড়ে। মহান সম্রাট লেজেহোমো ইন সার্ভিস থেকে ইন তুলে আউট করে দিলেন। চাকরি গেল, ক্যাডার এল। ডাক্তারেরা নেমে এলেন কেরানির কাতারে।

 

এর পর থেকেই বিসিএসের সোনার হরিণের পেছনে দৌড়, দৌড় আর দৌড় করতে হতো। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পশ্চাৎদেশ ঘষটাতে ঘষটাতে বিড়ালের ঘাড়ে শিকে ছিঁড়ে পড়ল একদিন। এনেস্থেটিস্ট হিসেবে চেয়েছিলাম শহরে, পোস্টিং হল সাব সেন্টারে। উপজেলা জেলা শহর থেকে ভটভটিতে প্রায় ঘণ্টা খানেকের পাকদণ্ডি সফর।

মাত্র ৩৯ টা বাঁক রয়েছে রাস্তায়! সাব সেন্টার উপজেলা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার নৌকা ড্রাইভ। সে নৌকা আবার টাইম টেবল নামের কিছু কখনো শোনেনি। মাঝিকে দেখলে বাহাদুর শাহের উত্তরাধিকার মনে হয়। যাবেন কি যাবেন না উনার মর্জি।

প্রথম যোগদানের দিনে আর এম ও সাহেবের সাথে দেখা হল। মাই ডিয়ার লোক। মানে উনার হাতে কোন ক্ষমতা নাই, সব ক্ষমতা মহামহিম THA সাহেবের হাতে। এই হেলথ কমপ্লেক্সে তিনি CMLA র সমান। (CMLA মানে চীফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর, যিনি ইচ্ছা করলেই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেত। সে কবেকার অন্ধকার দিনের গল্প।) তবে তিনি নাই, তাই নদীর ধারে হাওয়া খেতে যাওয়া যায়।

পরের দিন সকালে নদীর ধারে গেলাম। "বসে আছি পথ চেয়ে, মাঝি কাকার দরশন চেয়ে" । মাত্র আধা ঘণ্টা পরে এলেন। এ ঘাট , সে ঘাট করে যখন আমাকে নামালেন আমার কারাগারে, তখন বেলা এগারোটা।

মনের মধ্যে তখনো উত্তম কুমারের ছায়া আছে। অগ্নিস্বর দেখেছি, গ্রামে থাকা ডাক্তারের প্রতিরূপ। নিজের সাব সেন্টারে যাচ্ছি, ২২ বুকের ছাতি তখন যে কোন মাপে ৫০। সাব সেন্টারের দরজা দেখতেই হুশ করে সব বাতাস বেরিয়ে ১৬ তে পোঁছাল ছাতি। দেখি তেমন কেউ নেই।


সরাত সরাত শব্দ শুনে এগিয়ে গেলাম। দেখি এক অল্পবয়সী মেয়ে ঘর ঝাড় দিচ্ছে। সিঁথির সিন্দূর দেখে বুঝলাম বিবাহিত। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসু নয়নে তাকালেন, মানে কি চাই?
" আমি এই সাব সেন্টারের ডাক্তার,"
" আমাদের তো ডাক্তার আছে!"
আগে শুনেছি কখনো কখনো ডাবল পোস্টিং হয়। মানে একসাথে দুই জায়গায় নয়, দুইজনের এক পদে। সেরকম কিছু কি হোল কি না! উপজেলা থেকেও তো কেউ কিছু বলেনি।


ওখানে রেকর্ড নাই, এখানে ডাক্তার আছে ব্যপার কি?
"তা আপনাদের ডাক্তার সাহেব কোথায়?"
"উনার শ্বশুর বাড়ি তো এখানেই, উনি ওঠি (okhane) গেছেন।"
"আজ আসবেন?"
"আসপিনি, কেবল তো এগারোটা বাজে"
তাই তো! আমার মাথার দোষ! কেন নৌকা ভ্রমণের মজা না নিয়ে "জোরসে চালাও" করে মাঝির আধুনিক ভাটিয়ালিতে বাগড়া দিচ্ছিলাম।

এদের লাইফ স্টাইল দেখে পুরনো একটা হিন্দি গানের কলি মাথায় এলো। " দুনিয়াকা মজা লে লো , দুনিয়া তুমহারি হ্যাঁয় ( দুনিয়ার সমস্ত আনন্দ উপভোগ কর, এই পৃথিবী তোমারি) "
একটা টেবিল যেটার উপড়ে শের শাহ এবং হুমায়ুনের যুদ্ধ হয়েছিলে। পাশে বৃষ্টির জল জমে পানিপথের নামের সার্থকতা জুড়ে দিয়েছে। একটা চেয়ারে একটা প্রায় নতুন তোয়ালা লাগানো। সমস্ত ঘরে এই আসবাবটি শুধুমাত্র রাজকীয়তা বহন করে। বাঁকি সব দেখে মনে হয় পতিত প্রান্তর। ভুতর গল্প জমানো যাবে যে কোন সময়। দূরে একটা অশ্বত্থ গাছ, বিশাল। ওর যে কোন ডালে যে দুয়েকটা পেতনি নেই, তা ই বা কে জানে।

 

এই সময়ে হঠাৎ আলো বদলে গেল। বাতাস চঞ্চল হল, পাখিরা চুপ। কান পাতলেই নদীর কুলুকুলু শোনা যাবে। বুকের ভেতর ঢিব ঢিব ও শোনা যাবে। আসছে, আমার প্রথম রোগী! আমি ঝট করে শের শাহর সেই চেয়ারে বসে পড়লাম। আসে পাশে কোন প্রেস্ক্রিপশান ফরম নেই। কোন এক ওষুধ কোম্পানির দেওয়া একটা কলম জ্বলন্ত আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

লুঙ্গি পড়া ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, " কি চাইচছেন?"
হতবাক আমি। আমার ঘর, আমার রাজত্ব , আর বলে কি না কি চাচ্ছেন?
সেই ভদ্রমহিলা আমার চাইতেও দ্রুত নড়াচড়া করতে পারেন। পরিষ্কার করা থামিয়ে বললেন, " নতুন স্যার, সালাম দেন"
" স্লামালেকুম স্যার, আমি হেলথ এসিস্টেন্ট জব্বার।আমি পরিবার পরিকল্পনা দেখি।"


ঠিক তখনি হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকলেন পুরানো স্যার । চোখে জিজ্ঞাসা, কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
" স্যার আমি মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট, রহিম আলি"


"আমার নাম ডাঃ অসিত , আমার এখানে পোস্টিং হয়েছে। কাল উপজেলাতে জয়েন করেছি। আজ এখানে এলাম।"
"আদাব স্যার," আপনি কষ্ট কর‍্যা এতদুর আলেন সার,আমাক খবর দিলে আমি দেখে করতে পায়রতাম । আগের সার তো কোনদিন এখানে আসেননি। উপজেলা থেকেই চলে যাতেন।স্যার কি এখানে থাকবেন ?"


আমার ফুটো হওয়া ছাতিতে জল ঢোকে। ঘর ঘর শব্দ হয় বুকের ভেতর। গলা শুকিয়ে আসে। যে স্বপ্নের পিছে দৌড়ে এতদূর পর্যন্ত আসা, সেখানে অভ্যর্থনা নেই, আছে ভ্রুকুটি। সৌহার্দ্যর বদলে মল্লযুদ্ধের হাতছানি। ইচ্ছে হল চেয়ারটা ভেঙ্গে যাক। এখানে বসার কোনো জায়গা না থাকুক। দেখি বেটা কোথায় বসে!


পাড়াগাঁয়ে থাকলে মানুষের কূটবুদ্ধি বাড়ে। এই ভদ্রলোকের চোখে অন্তর্যামীর দৃষ্টি।
"স্যার, এই চেয়ার আর তয়ালাটা আমার, আমি কিনা আনিছি। এখানে তো কিছু ছিল না। আমি সব করিছি একা একা। নিজের পয়সা দিইয়ে।"
ধরণি দ্বিধা হউ। চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।

"স্যার যাবেন? এখন তো নৌকে পাবেন না। আমার মটর সাইকেল আছে। উপজেলাত আমারও যাওয়া লাগবি। আপনাক ন্যামে দিবনি। "

 

কল্পনা আর বাস্তব এক নয়। কখনো ভাবিনি এই বিরান প্রান্তরে প্রতিযোগিতা আছে। নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য অদম্য, অনৈতিক প্রয়াস আছে। এই ফাকা ঘর, প্রায় ভেঙ্গে পড়া আসবাব, আর জনহীনতা যতটা বুক ভেঙ্গে দিয়েছিলে, তাঁর চাইতে বেশি খচ খচ করতে লাগল অধুনা SACMO হওয়া সেই ভদ্রলোকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। "থাকবেন? না কি থাকবেন না! "


আমার দৃষ্টি নামিয়ে নিই। এই মুহূর্তে আর থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে না। আশা করিনি কেউ ফুল সাজিয়ে বসে থাকবে, তবে প্রথম দিনেই প্রতিযোগিতার আঁচ স্বপ্নটাকে ঝলসে দেবে ভাবিনি।

মটর সাইকেলের পেছনে বসে শুনতে থাকি "শতরঞ্জ কি খিলারির" ইতিহাস। আমার আগের জন চুক্তি করে রেখেছিলেন। এখানে আসতেন না। মাসের শুরুতে এসে কাগজপত্রে সই করে দিতেন উপজেলাতে বসেই। কাগজ মানে হচ্ছে লেজার খাতা যেখানে ওষুধের হিসাব লেখা থাকে। উপজেলা স্টোর থেকে কাগজে কলমে ১০ তা ট্যাব্লেট দিলে হাতে দেয় ৬ তা। অলিখিত নিয়ম। এভাবেই চলে। এর উপরে মহামহিমের চাহিদা মাসে ১০০ টাকা। ওষুধ বেচে দিতে হবে, কিন্তু কাগজে সব ঠিক থাকবে।


এসব শুনতে শুনতে স্বপ্ন ভঙ্গর বেদনা কমে আসে। হলী ফ্যামিলির চাকরি ছাড়ার দুখ টা আবার জেগে ওঠে। রাজশাহীর ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে, ' কি সে পলেম খোদা" ।


সেই রাতে ঠিক করি যে ভাবেই হোক সাব সেন্টারে আর নয়। তখনো সেই জেলা শহরে কোন এনেস্থটিস্ট নেই। সিভিল সার্জন ছিলেন একজন খুব ভাল মানুষ। কিছুদিন দৌড়াদৌড়ি করে ডেপুটেশন পাই জেলা হাসপাতালে।

মিথ্যা সই করার অপকর্ম আর করতে হয়নি। সে সুখ ও সহ্য হয়নি। এরপরে ৫ বছরের মধ্যেই সরকারি চাকরি ছেড়ে সউদি আরব যাওয়া। সে গল্প আরেকদিনের জন্য
যেখানে প্র্যাকটিস রত SACMO আছেন , সেখানে আরেকজন MBBS দিতে সরকারের উঁচু পদে বেশ আগ্রহ। ভিলেজে ভিলেজ পলিটিক্স থাকবে না তো কি বাকের ভাই থাকবে?


আমারও প্রিয় গান একটা " উড়তা যায়ে মেরা লাল দোপাট্টা মলমল কা ..............."

_______________________________

ডা. অসিত বর্দ্ধন
কন্সলাটেন্ট এনেস্থেটিস্ট , কানাডা।
bdemr.com এর প্রতিষ্ঠাতা।
রামেক ২৫ তম ব্যাচ, ৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়