Dr. Aminul Islam

Published:
2021-07-09 14:43:33 BdST

হাসপাতালে জনবল সংকট




ডা. আজাদ হাসান
__________________________

হাসপাতালে জনবল সংকট।।

আমাদের দেশের সরকারী হাসপাতাল সমূহে গেলে সবার কমন অভিযোগ হলো, "মান সম্মত সার্ভিস পাওয়া যায় না"। এই যে মান সম্মত সেবা পাওয়া যায় না তার বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো ~ পর্যাপ্ত জনবল সংকট।

আমার ধারণা মন্ত্রণালয় তো দূরের কথা, খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিকটও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক এবং নার্সসহ অন্যান্য কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের জন্য Sanctioned বা অনুমোদিত পোস্ট কত (?) বর্তমানে কতজন কর্মরত আছেন (?) বর্তমানে কতটি পদ শূন্য আছে (?) এবং Required number of Post বা প্রকৃত পক্ষে কতটি পোস্ট থাকা উচিৎ তার কোনো সঠিক বা আপডেটেড মানব সম্পদের পরিসংখ্যান ( Manpower Statistics) আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর যদিও বা সেই পরিসংখ্যান থেকেও থাকে কিন্তু সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী মানব সম্পদ উন্নয়নের পরবর্তী কর্মকৌশল বা কর্মপন্থা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।

ইতিমধ্যে দেশের অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সমূহকে ৩১ শয্যা হতে ৫০ শয্যায় উন্নিত করা হয়েছে এবং জেলা সদর হাসপাতাল সমূহকে ৫০ শয্যা হতে ১০০ শয্যায় উন্নিত করা হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও, বৃদ্ধি প্রাপ্ত কলেবরের সাথে সামঞ্জস্য রেখে হাসপাতালের সেবার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টি করা হয় নি এবং পদায়ন করা হয় নাই। ফলে যারা বর্তমানে কর্মরত আছেন তারা বিভিন্ন ভাবে কাজের চাপে ওভারবার্ডেন্ড এবং মানসিক ভাবেও বিপর্যস্ত। প্রসংগত উল্লেখ্য ~
স্বাধীনতার ৩০ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সমূহের ইমারজেন্সীর জন্য ইএমও পদ সৃষ্টি করা হয় নাই।
জেলা সদর হাসপাতাল সমূহে সার্বক্ষণিক ইমারজেন্সী সার্ভিস এনশিউর করতে যেখানে নূন্যতম ৮ জন ইএমও প্রয়োজন, সেখানে বর্তমানে পোস্ট আছে ৩ জনের। [উল্লেখ্য, গাইনী অবস্ বিভাগে প্রায়ই ইমারজেন্সী কেস আসে, এগুলো ম্যানেজ করা একজন স্পেশালিষ্ট এর পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। তাঁকে সহায়তা করতে ৩ শিফটের জন্য নুন্যতম ৪জন ইএমও প্রয়েজন।]
সদর হাসপাতালে মেডিসিন, সার্জারী, গাইনী বিভাগ ও শিশু বিভাগে রোগীর টার্নওভার বেশী, সুতরাং এসব বিভাগের সার্ভিস উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অধিক সংখ্যক স্পেশালিষ্ট -এর পদ সৃষ্টি করা।
প্রতিদিন একজন স্পেশালিষ্ট অনকল, একজন ওয়ার্ড রাউন্ড এবং একজন আউটডোর ডিপার্টমেন্টের রোগীদের জন্য রেসপন্সিবল হবেন। তা হলে দেখা যায় প্রতিটি বিভাগে নূন্যতম ৪জন করে স্পেশালিষ্ট প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে সদর হাসপাতাল সমূহে উল্লেখিত ডিপার্টমেন্ট সমূহে ২ জন স্পেশালিষ্টের পদ আছে। এসব বিষয় সমূহ সমাধান করা প্রয়োজন।
তা ছাড়া প্রতিটি সদর হাসপাতালে পোস্ট মর্টেম করার জন্য আলাদা ভাবে কোনো ডিপার্টমেন্ট এখনো গড়ে উঠে নাই। সদর হাসপাতালের ইএমও এবং আরএমও সাহেবরাই নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ যাবৎ পোস্ট মর্টেম এর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মেডিকো-লিগ্যাল কেসের ক্ষেত্রে ন্যায় বিচারের স্বার্থে পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের গুরুত্ব অপরিসীম, তাই এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের জন্য পদ সৃষ্টি করতঃ যথাযথ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক।

তাছাড়া হাসপাতালের সার্বক্ষনিক অপারেশন চালু রাখতে অধিক সংখ্যক এনেস্থিসিয়া স্পেশালিষ্টের পদ সৃষ্টি করতে হবে।

তা ছাড়া হাসপাতালের ইনভেস্টিগেশন সুবিধা বৃদ্ধি করার জন্য প্রতিটি সদর হাসপাতালে অধিক সংখ্যক প্যাথলজিক্যাল স্পেশালিষ্টের পদ সৃষ্টি করা এবং পদায়ন করা প্রয়োজন।

তা ছাড়া অফিস আওয়ারের পর ইমারজেন্সী কোন রোগী আসলে তার পরীক্ষা নীরিক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা আজো আমাদের সদর হাসপাতাল সমূহে গড়ে উঠে নাই।

অফিস টাইমের পর প্রশাসনিক বিষয় সমূহ মনিটর করার জন্য প্রতিটি সদর হাসপাতালে উপ-তত্বাবধায়ক বা ডেপুটি ডাইরেক্টর পদ মর্যাদার ৩ জন অফিসার দায়িত্বে থাকা প্রয়োজন।

তা ছাড়া অফিস আওয়ারের পর ইমারজেন্সী রোগীর জরুরী এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড, সার্জারীর সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে। এবং সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের চিকিৎসক এবং অন্যান্য টেকনিশিয়ান অন কল থাকবেন।

অফিস আওয়ারের পর ডিউটির জন্য সংশ্লিষ্ট স্পেশালিষ্ট এবং স্টাফদের কমপেনসেটরি লিভ কিংবা ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।

যে কথা নিয়ে আমার আজকের লেখার সূত্রপাত করেছিলাম সেটা হলো, স্বাস্থ্য খাতে মানব সম্পদের অসম্পূর্ণ আপডেটেড তথ্য। আমার আশংকাটি যে অমূলক ছিল না তা সম্প্রতি বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হতে ক্লিনিক্যাল নন-ক্লিনিক্যাল শিক্ষকদের গণ বদলীর লিস্টের মাঝে মৃত চিকিৎসকদের নামের অন্তর্ভুক্তি প্রমাণ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অপূর্ণ তথ্য ভান্ডারের করুণ চিত্র।।
এই গণ বদলীর কারণে অন লাইন এর মাধ্যমে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে।
তার চেয়ে অধিকতর ভালো হতো যদি ৪২ বিসিএস পরীক্ষার অসমাপ্ত অংশ কমপ্লিট করে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়াটা তরান্বিত করা এবং চলমান চিকিৎসক সংকট কাটিয়ে উঠতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া যেতো।

তা ছাড়া দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারি হাসপাতাল গুলোতে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ফলে হাসপাতালের সেবা ব্যাহত হচ্ছে। এদিকেও বিশেষ লক্ষ্য দিতে হবে।

সবশেষে আমি যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং জেলা সদর হাসপাতালে নিয়োজিত চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্টাফদের পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রেরণ করবে। অধিদপ্তর উক্ত পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ে প্রেরণে করবেন। তা হলে মন্ত্রণালয়ে আপডেটেড তথ্য থাকবে এবং পরবর্তীতে বিসিএস -এর মাধ্যমে শূন্য পদে নিয়োগের জন্য সহায়তায় আসবে।।
এখানে আর একটি বিষয়ে উল্লেখ করতে চাই তা হলো, ১৯৭২ হতে ১৯৮৬ সন পর্যন্ত ইনসার্ভিস এর মাধ্যমে প্রতি বছর ১২০০ চিকিৎসক সরকারী চাকুরীতে জয়েন করতেন। এই সব চিকিৎসকরা সবাই ২০০৩ সন হতে গড়ে ১২০০ চিকিৎসক রিটায়ার্ড করা শুরু করেছেন এবং সেই সাথে ১২০০ পদ শূন্য হচ্ছে। এবং এভাবে ২০১৭ সন পর্যন্ত গড়ে ১২০০ পদ শূন্য হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো ২০০৩ হতে এ পর্যন্ত প্রতি বিসিএস -এ কিন্তু গড়ে ১২০০ চিকিৎসক কখনো নিয়োগ দেন নাই।

প্রতিবার বিসিএস নিয়োগের আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় হতে শূন্য পদের সংখ্যা চাওয়া হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেক তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় এবং রুট লেভেল হতে মন্ত্রণালয়ের দূরত্বের কারণে কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে তথ্যগত অসম্পূর্ণতার কারণে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নিয়োগ পান না।।

কিন্তু যদি প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর প্রতিটি হাসপাতালের জনবলের পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা সম্ভব হয়, তা হলে ভবিষ্যতে তথ্য গত গ্যাপ কমে আসবে এবং তা স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।।
তা ছাড়া আরো দু'টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো,
১) সুষ্ঠু পদায়ন ও বদলীর নীতিমালা এবং
২) সুষ্ঠু পদোন্নতির নীতিমালা।

সরকারী চাকুরীর শুরুতে যেমন গ্রামে চাকুরী করার বাধ্যবাধকতা আছে, তেমনি গ্রামে চাকুরীর নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ সাপেক্ষে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে জেলা পর্যায়ে বদলীর নীতিমালা।
তাছাড়া প্রতি বছর পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সের জন্য উল্লেখ যোগ্য সংখ্যক চিকিৎসক কোর্সে ডেপুটেশন পেয়ে থাকেন। পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সে থাকার সময়ও কিন্তু ক্লিনিক্যাল সাবজেক্ট এর পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টরা নিয়মিত সংশ্লিষ্ট পোস্ট গ্রাজুয়েট ইন্সটিটিউট এর রোগীদের চিকিৎসার সাথে জড়িত থাকেন। এখন পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্স সম্পন্ন চিকিৎসকদের কিভাবে তাদের যোগ্যতার নিরিখে দ্রুত প্রমোশন এবং পদায়ন করা যায় তার জন্য সুষ্ঠ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
আর যারা পোস্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে পারবেন না তাদের জন্য ও চাকুরীর মেয়াদ এবং অভিজ্ঞতার আলোকে নন-ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টে প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর যাতে কাউকে "Joining as Medical Officer and retiring as Medical Officer", এমন অবস্থার শিকার হতে না হয়, সে ভাবে সিস্টেম ডেভলাপ করার উদ্যোগ নিতে হবে।।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়