SAHA ANTAR

Published:
2021-06-17 15:36:35 BdST

সেদিনের ক্লাসের একটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ছেলেটি আজ জীবনযুদ্ধে প্ৰথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ


 


দেবব্রত তরফদার
কথাসাহিত্যিক
__________________


খুব কম সময়ের মধ্যে আমার জীবনে একটা পরিবর্তন এলো। বাবাকে এখানে গ্রামের দোকানে স্থিতু করার জন্য অতি দ্রুত দোকানটা চালু করলাম। আর এসব করতে গিয়ে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে গেলাম এরমধ্যে। প্রায় ছয় বছর আগে যখন গ্রাম ছেড়েছি তখন ছিলাম ন বছরের বালক। এক বছর পর নিয়মিতভাবে বছরে দুবার গ্রামে এলেও বয়সোচিত কারণে পুরো গ্রামটাকে সঠিক ভাবে চেনা হয়নি। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর এই দু মাসে গ্রাম এবং তার মানুষেরা আমার কাছে অন্য রূপে ধরা দিল। এখন আমি যে কোন বয়সের মানুষের সঙ্গে ইচ্ছামত কথা বলে থাকি। এর থেকেই বুঝতে পারছি মানুষের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। দিনের পর দিন মুনিশদের সঙ্গে মাঠে যাবার ফলে তাদের সঙ্গে একটি হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এরা বিভিন্ন বয়সের এবং প্রায় কেউই আমার সমবয়সী নয়। এইসব মানুষের আচরণে বুঝতে পারি যে মানুষ জন আমাকে বেশ পছন্দ করেন। দোকান খোলার পর বিভিন্ন বয়সের মানুষের সঙ্গে আমার আড্ডা জমে উঠল। তার প্রভাব পড়ল ব্যবসায় কেননা ক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকল। বাবা ছিলেন অসম্ভব মেজাজি এবং মুডি মানুষ, বাবাকে অনেকেই ভয় করত । আমার কাছে ব্যাপারটা ছিল তার উল্টো। তাদের ভালবাসার পরিমাণ এত বেড়ে গেল যে তারা চাইল আমি যেন পাকাপাকিভাবে এখানে থেকে যাই। বাবাও মনে হয় এমন একটি ধারণা পোষণ করতে লাগলেন।
এদিকে বেশ কিছুদিন কৃষ্ণনগর যাওয়া হয়নি। ইচ্ছা প্রকাশ করাতে বাবা বিভিন্ন অজুহাতে দিন পিছিয়ে দেন। এই ব্যাপারটা কিন্তু আগে ছিল না। আমি মায়ের কাছে অভিযোগ করি কিন্তু তার কোন ফল হয় না।
অবশেষে একদিন সকালে আবার সেই পুরনো ডেরায় বাবার সাইকেলে। দিদিকে গিয়ে বলি," ভাবিনি কখনো তোদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।" তারপর সব ঘটনা খুলে বলি। বাবা দু-একবার এখানে আসলেও এই ব্যাপারে নিশ্চয়ই তেমন কথা হয়নি দিদির সঙ্গে। ঘটনার বীভৎসতায় দিদি শিউরে ওঠে আর ছোট বোনটা কাঁদতে শুরু করে। এই অবস্থায় আর কিছু বলার নেই কেননা সেই সময়টাকে কাটিয়ে এসেছি।
কলেজিয়েট স্কুলের পাঁচিলে সকালের ঠেকটার জন্য ছটফট করছিলাম। গরমের ছুটি বোধহয় শেষ হয়ে এসেছে কেননা রাস্তায় অজস্র প্রিয়ঙ্গু ফুলের মেলা। বন্ধুরা বোধহয় দাঙ্গার ঘটনার জন্য চিন্তিত ছিল। চাপড়ার বন্ধু শুভাশিস গন্ডগোল শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণনগর চলে এসেছে। ও যা তথ্য দিয়েছিল তা পুরোটাই উল্টো। আমি পুরোপুরি ঘটনার মধ্যে ছিলাম তবুও বন্ধুদের বিশ্বাস করাতে কষ্ট হচ্ছিল। শুভাশিসের সবজান্তা ভাবে রাগও হচ্ছিল।
কৃষ্ণনগর একদিন কাটিয়ে আবার সেই চটকাতলার দোকানে। এই সামান্য সময়ে এলাকার মানুষের খুব প্রিয় হয়ে গেছি। আগে হয়তো আমি অনেককে নামে চিনতাম এখন কিন্তু অনেকের সঙ্গে চেনা জানা হয়ে গেছে। যখন তখন যার তার বাড়িতে পাত পেড়ে বসে পড়ি। আমার আন্তরিক আচরণে সবাই মুগ্ধ হয়। ঘটি না ঢুবলেও তালপুকুর তো। বাবুদের ছেলে বলে কথা। তাছাড়া আমার জ্যাঠতুতো দাদা গ্রামে থাকলেও একটু দূরত্ব বজায় রাখত মানুষের সঙ্গে। হয়তো সন্ধ্যাবেলায় কারো বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। গৃহকর্ত্রী উঠোনে পাটকাঠির চালার নিচে রুটি ভাজছে কুপি জ্বালিয়ে। আয়োজন সামান্যই রুটি আর আলু কুমড়োর ছেচকি। গরম রুটির সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। এ রুটির আকার বিরাট আমাদের রুটির আড়াই তিন গুণ। গৃহিণী হয়তো বাড়ির লোকের সঙ্গে আমাকেও বসিয়ে দিলো উঠোনেই। আমিও আপত্তি না করে হাত ধুয়ে বসে পড়লাম। যত না খিদে তার চাইতেও বেশি গরিব চাষীবাসি মানুষকে খুশি করার উদ্দেশ্য। হয়তো মুসলিম পাড়া দিয়ে আসছি। আব্রুর কারণে এদের বাড়ি গুলি মাটির প্রাচীর অথবা পাটকাঠির বেড়া দিয়ে ঘেরা। নতুন পরিচিত কেউ জোর করে ধরে নিয়ে যায় তার বাড়িতে। বাড়ির মহিলাদের কৌতুহল খুব। আমার মা জেঠিমার কথা দিদিদের কথা জানতে চায়। মা অথবা বড়মা যেহেতু বাড়ি থেকে প্রায় বের হতেন না আর মুসলিম মহিলাদের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা সে কারণে এদের খুবই কৌতূহল ছিল। আমার মাকে গ্রামের মিথ বলা যায়। বাড়ির পুরুষদের কাছে হয়তো মায়ের গল্প শুনে থাকবে। আমি তখন কিশোর , পুরুষ হইনি। তাই আমাকে লজ্জা সংকোচের কিছু নেই। এরকমই একদিন আয়নাল কাকার বাড়িতে ঢোকার পর গল্পগাছা করার শেষে কাকি রাজহাঁসের ডিম ভাজতে বসল। এমনিতেই হাঁস-মুরগি থেকে যা আয় হয় সেটা বাড়ির মহিলাদের প্রাপ্য। রাজহাঁস বছরে সাত-আটটি ডিম দেয়। নতুন বাচ্চা তোলার জন্যই ডিম রেখে দেওয়া হয়। কাজেই এই ডিমকে মহার্ঘ বলা যায়। পরিবারের বাচ্চাদের রসনা থেকে বঞ্চিত করে আমাকে খেতে দেওয়া হল। এই গুরুত্ব, এই ভালবাসা উপলব্ধি করতে শিখেছিলাম তখনই। এদের এইসব আন্তরিক আচরণে আপ্লুত হয়ে পড়তাম। তাই এই সময় থেকে আমার বাকি কলেজ জীবনে সময় পেলেই গ্রামে চলে গেছি। ওই সময়ে আমার শিকড় যে গভীরে প্রোথিত হয়েছে তা এখনো রয়ে গেছে। এর কয়েক বছর পর পুরোপুরি গ্রাম থেকে চলে আসলেও আজ প্রায় তিন যুগের বেশি সময় পর সেই শিকড়ের টানে বার বার ফিরে যাই সেইখানে। জানি এই জীবনে ঐ শিকড় আর ওপড়ানো সম্ভব নয়।
দিন যায়। কদিন আগেই যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে আজ তার চিহ্ন মাত্র নেই। শুধুমাত্র ফিরে আসে বারবার মানুষের আলোচনায়। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ডেরা এখন রমণীমোহন কাকার পরিতক্ত ঘরে। গ্রামের একটি দিদি ওদেরকে রান্না করে দেয়। শুনেছি এরা নাকি উত্তরপূর্ব ভারতের মানুষ। রাস্তাঘাটে কুকুর ঘুরতে দেখে এদের নাকি হাত নিশপিশ করে কিন্তু গ্রামের মানুষ অপছন্দ করার কারণে বেচারাদের মুরগি আর মাছেই রসনা পরিতৃপ্তি করতে হয়।
আর বেশিদিন নয়। এখান থেকে পাততাড়ি গোটানোর সময় হয়ে গেল বোধহয়। তবে বাবা এখন না যেতে দেবার ব্যাপারে সরব। নিজেই নিজের জালে জড়িয়ে গেছি। বাবাকে এত ভয় পেতাম যে প্রতিবাদের জায়গা নেই। শুধু মায়ের কাছে ছিল হাজারো অভিযোগ কিন্তু সেটা নামেই কেননা মাকেও কোনদিন বাবার মুখের উপর কোন কথা বলতে শুনিনি। বুঝতে পারছি রেজাল্ট কোন কারনে খারাপ হয়ে গেলে এখানে সবকিছুর ইতি হয়ে যাবে। এই আটচালা টিনের দোকানে কেটে যাবে আজীবন। কখনো কখনো অভিমান বা রাগ জমে গিয়ে ক্রোধ বাসা বাধে। গ্রামের গরিব মানুষকে সময়ে অসময়ে বাবার কাছে হাত পাততে হয় কাজেই তারা কখনোই বাবাকে চটায় না। এসব কথা বলার সময় তারা বাবা কে সমর্থন করে আর আমার মনে হয় সদ্য চেনা মানুষগুলি বাবাকে ইন্ধন যোগাচ্ছে। এই কারণে আমার মধ্যে যে জেদ তৈরি হয়েছিল তা আমাকে ওই কিশোর বয়স থেকে স্বাবলম্বী করেছে।
অবশেষে একদিন সমন এসে গেল। কোন এক দুপুরে খবর পেলাম রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমাদের গ্রামের আবুছিদ্দিক আর দীপক পরীক্ষা দিয়েছে বাগমারা স্কুল থেকে আর তারা গেজেট দেখতে চলে গেছে মাজদিয়ায় আমাদের না জানিয়ে। বিকেলে তাদের রেজাল্ট জানলাম দীপক এক বিষয়ে সাপ্লি আর আবু সামান্য নম্বরের জন্য সেকেন্ড ডিভিশন মিস করেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও ছটফট করছি , সাইকেলে মাত্র এক ঘন্টার পথ। বাবা কিছুতেই আসতে দিলেন না। সারারাত ঘুম হল না, বাবা বারবার ওদের খারাপ রেজাল্টের প্রসঙ্গ তুলে আমায় পরোক্ষে বলতে লাগলেন যে খারাপ রেজাল্ট হলেই পড়া বন্ধ।
ভোরবেলায় বেরোতে যাব, তখন বাবা দোকানের মনোহারি মালপত্রের লিস্ট করতে বসলেন। ঢাউস দুখানা ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলাম। সঙ্গে আব্দার , ও ডনবস্কো স্কুল থেকে এই বছরে পরীক্ষা দিয়েছে।
সে সময়ে রেজাল্ট বের হতো প্রথমে বুকলেট এর মাধ্যমে। প্রতিটি জেলার পৃথক বুকলেট মাত্র দেড় টাকায় বিক্রি হতো যেখানে রোল নাম্বার এর সঙ্গে শুধুমাত্র মোট প্রাপ্ত নম্বর দেওয়া থাকত। বেকার যুবকরা সম্ভাব্য দিনে কলকাতার গিয়ে লাইন দিত বুকলেট এর জন্য। আর সেটা পেলেই দৌড়ে শিয়ালদা স্টেশন। যে যত আগে আসতে পারবে তারাই তত বেশি হবে। এক টাকা দু টাকা নিয়ে রেজাল্ট জানানো হতো। কৃষ্ণনগরে সবাই ভিড় করত পোস্ট অফিসের মোড়ে। রেজাল্ট জানা হয়ে গেলে সেই বুকলেট তখন মূল্যহীন। ‌ পরদিন সকালে যখন এলাম তখন পোস্ট অফিসের মোড় ফাঁকা। ‌ আমাদের মত দুই-একটি পাবলিকের জন্য দুজন বসে আছে। দুরু দুরু বক্ষে রোল নাম্বারটা বলি। ছেলেটি এক কাঠা দাঁত বার করে রেজাল্ট বলে। সে সময়ে ফার্স্ট ডিভিশন পেলে লোকে তাকে দেখত কোন ছেলেটা। ‌রেজাল্ট একেবারেই হেলাফেলার মত ছিলনা। তবে আবদারের রেজাল্ট শুনে সব আনন্দ একবারে মাটি হয়ে গেল। সায়েন্স গ্রুপে সাপ্লি পেয়েছে বেচারা। বাড়িতে ফিরলাম, দিদি খুব খুশি রেজাল্টে গতকালই দেখে এসেছে। আবদারের রেজাল্টের জন্য নিজের ভালো রেজাল্টের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারলাম না। ওকে নিয়ে ছুটলাম দোকানের মনোহারী বাজার করার জন্য। দুই ব্যাগ ভর্তি করে ওকে রওনা করে দিলাম বাড়ির দিকে। তারপর ছুটলাম রঞ্জনদের বাড়ি। ক্লাসের ফার্স্ট বয় হিসেবে ওর রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। কৌশিক মুখার্জী সবাইকে টেক্কা দিয়ে হাইয়েস্ট পেল। ‌ এর জন্য অনেক অবাক হলেও আমরা ঘনিষ্ঠরা জানি কৌশিক এই রেজাল্টের হকদার।
আজকে আরগ্রামের বাড়ি ফিরলাম না। জানিনা কি কুরুক্ষেত্র হবে। রেজাল্টের কারণে তেমন আর ভয় করছে না। এরপর কৃষ্ণনগরের আত্মীয়স্বজনের বাড়ি দেখা করতে গেলাম। বড় মামাকে সব কথা খুলে বললাম। বড় মামা বাবার উপর ভীষণ রেগে গেলেন। টিউশন ঠিক করার কথা বললাম। মামার সঙ্গে সঙ্গে বোনকে পড়ানোর কথা বললেন। তখন তার ক্লাস ফাইভ। চল্লিশ টাকার প্রথম টিউশন, মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। বিকেলে একচোট ঠেক হলো ঘাটের ধারে। সবাই মিলে একসঙ্গে সরকারি মহাবিদ্যালয় ঢুকব। এর মধ্যে যারা ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি তারা একটু ম্রিয়মাণ।
পরদিন গ্রামে পৌঁছে গিয়ে দেখি বাবা ভীষণ খুশি। আর এক দিনও থাকতে দিলেন না। সেইদিনই ফিরতে বললেন। আমি অবশ্য আরো একদিন থাকলাম। বাবা একটি নতুন সাইকেল কেনার প্রসঙ্গ তুললেন কেননা খাবার রসদ নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এবার আমায় নিতে হবে। আমি বড় হয়ে গেছি।
পরদিন সকালে আবার একটা ফেরা। আব্দার আমায় পৌছে দিয়ে গেল ভিমপুরে। ওর পড়া বোধহয় এখানেই শেষ। বাবা অসুস্থ, সামান্য জমি এবার মনে হয় ওকে মাঠে নামতে হবে। আমাদের দুজনেরই মন খারাপ। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বন্ধুকে ফেলে বাসে উঠে পড়ি। ‌ বাস ছেড়ে দেয় জানালা দিয়ে দেখি ওর চেহারাটা ছোট হতে হতে একসময় আড়ালে চলে যায়।

( ছবিতে আমি আর আব্দার , সেদিনের ক্লাসের একটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ছেলেটি আজ জীবনযুদ্ধে প্ৰথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ। আর কাঁথা ভেজানোর সময় থেকে আমাদের বন্ধুত্ব এখনো অমলিন।)

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়