Ameen Qudir

Published:
2017-02-05 15:19:39 BdST

জাহেদ সাহেবের মতো লোভী ডাক্তারদের কিছু লোভী গল্প


 


মারুফ রায়হান খান , ইন্টার্ন চিকিৎসক
_______________________

 

 

১) গর্ভবতী মহিলা ভর্তি হলেন অবসটেট্রিক্স ওয়ার্ডে। ডেলিভারি হলো। যে বাচ্চাটি জন্ম নিলো সে স্বাভাবিক সময়ের অনেক আগেই জন্ম নিলো, লো বার্থ ওয়েট— মাত্র ১.৫ কেজির মতো ওজন। বাচ্চার অবস্থা বিশেষ ভালো না। নিবিড় পরিচর্যা অতি প্রয়োজন, তাকে পাঠানো হোল NICU তে ভেন্টিলেটরে। যেহেতু প্রাইভেট মেডিকেল, জেনে থাকবেন— ICU তে অনেক খরচ। আর ওদিকে অবসটেট্রিক্স ওয়ার্ডে ভর্তি বাচ্চার মা। এবার আপনার অবাক হবার পালা। মা একটু সুস্থ হবার পর রোগীর লোকেরা মাকে নিয়ে কেটে পড়লেন, বাচ্চাকে ফেলে! হ্যাঁ, বাচ্চা তখনও NICU তে,আর উনারা পগারপার!

 

NICU তে দায়িত্বরত ডাক্তাররা বাচ্চার এটেণ্ডেন্ট না পেয়ে বারবার ফোন দিতে লাগলেন উনাদেরকে। হয় উহারা ফোন ধরেন না, নয়তো এই যে আমরা আসছি, অমুক জায়গায় আছি— এসব বলেন। এভাবে কেটে গেলো প্রায় এক মাস। অবশেষে বাচ্চার মায়ের চন্দ্রমুখ দেখা গেলো। বাচ্চাকে নিয়ে যেতে হলে তো হসপিটালের এতদিনের বিল পরিশোধ করে যেতে হবে। বিল হয়ে গিয়েছে এতদিনে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। উনাদের কাছে কোনো টাকা নেই। বাচ্চাকে কীভাবে নিয়ে যাবেন? ইন্টার্নরা একসাথে বসলেন কী করা যায়, বাচ্চাটার জন্য তাদের গভীর মায়া জন্মেছে ততদিনে। চাঁদা তুলে তারা জোগাড় করলেন ৪০/৫০ হাজার টাকা। ছোট করে দেখবেন না, ইন্টার্ন ডাক্তারের বেতন আপনার গাড়ির ড্রাইভারের চেয়েও অনেকক্ষেত্রে কম। এবার তারা গেলেন হসপিটালের ডিরেক্টরের কাছে— বিলটা যদি একটু কানসিডার করেন। অবশেষে প্রায় ১ লক্ষ টাকা মাফ করিয়ে ঐ টাকাতেই বাচ্চাটাকে রিলিজ করা হোল। ঘটনা শুনে কেউ আবার বলে বোসেন না— মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি!

 

২। আমরা ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক ইন্টার্ন হাতে কয়েকটা টাকার নোট এবং পাশে এক লোককে নিয়ে আমাদের কাছে এলেন। ঐ লোকের মা মারা গিয়েছেন, দাফন-কাফনের টাকা নেই। আমরা যেন হেল্প করি। যে যা পারি দিলাম। এভাবে তিনি তার বিভিন্ন কলিগদের কাছে যেয়ে যেয়ে টাকা তুলছেন। তিনি একজন ধনীর দুলালী— সব সঙ্কোচ ভুলে হাত পাতছেন, এমনকি জুনিয়রদের কাছেও! এটা কোনো বিচ্ছিন্ন কিংবা অস্বাভাবিক ঘটনা না। উজবুক টাইপ নিউজ পোর্টালের নিউজ পড়ে গলাবাজি না করে একটু হসপিটালে ঘুরুন— এরকম আরও অনেক কিছুই দেখতে পাবার কথা। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব প্রায়ই এ ধরনের কাজ করেন।

 

৩। অনেকটা দু:খের সাথেই বলতে হয়, বাচ্চা প্রসবকালীন সময়ে যে প্রসূতির রক্ত লাগা খুবই স্বাভাবিক এবং এজন্য আগে থেকে রক্তদাতা ম্যানেজ করা উচিত— বেশিরভাগই হয়তো জানেন না, জানলেও হয়তো মানেন না। সে যাহোক, ওটির টেবিলে যখন পেশেন্টের রক্ত প্রয়োজন হয়, রোগীর লোকদের বলা হয়, রক্ত খুঁজে পান না তারা। সাধারণত রক্তের গ্রুপ মেলে না, রক্তের গ্রুপ মিললে তারা নাকি খুবই দুর্বল, স্বাস্থ্য ভালো না, ভয় পান ইত্যাদি— বাধ্য হয়ে ডাক্তাররাই খোঁজ করেন রক্তের। কখনও সহকর্মীদের, কখনও জুনিয়রদের ফোন করে ব্যবস্থা করেন রক্তের। কখনও নিজে ডিউটিতে থাকা অবস্থাতেই ডাক্তাররা রক্ত দেন অহরহ। খুব কম ডাক্তারই বোধহয় আছেন যারা এরকমভাবে রক্ত ম্যানেজ করে দেন না পেশেন্টদের।

 

৪. ডাক্তার সাহেবকে একটা ওষুধ কোম্পানি এসে কিছু স্যাম্পল দিয়ে গেলেন। তিনি গ্রহণ করলেন। একটু পর নার্সকে ডেকে বললেন অমুক বেডে ওষুধগুলো দিয়ে আসুন— গরীব মানুষ ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই। প্রাপ্ত বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ অনেক ডাক্তারই দিয়ে দেন অসহায় রোগীদের। আমাদের কতো বন্ধুরা স্যাম্পল চেয়ে নিয়ে যান, টাকা নিয়ে যান অসহায় রোগীদের জন্যে সেসব বলতে যাবার মানে হয় না। সত্যি কথা। কতো ডাক্তার যে তার প্রেসক্রিপশনে ২৫% ছাড় লিখে দেন তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের অনেক শিক্ষক আছেন যাদের কাছে ১০ জন রোগী এলে ৩-৪ জনকেই ফ্রি দেখতে হয়, কখনও আরও বেশি। কতো চিকিৎসক রোগীর অবস্থা দেখে ভিজিট নেবেন আর কী নিজেই উলটো তাকে টাকা দিয়ে দিয়েছেন ওষুধ আর টেস্ট করাবার জন্যে--সে গল্প কি খুব অজানা?

 

৫। প্রসববেদনা উঠেছে রাত ১০টায়। লেবার রুমে আনা হয়েছে যে কোনো সময় ডেলিভারি হবে। পৌনে ৪টার দিকে ডেলিভারি হলো। পুরো সময়টাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি বাচ্চার অপেক্ষায়, মাঝে মাঝে পাশে একটু টুলে বসেন, অযথা বসে থাকেন না গ্লাভস খুলে বইয়ের পাতায় চোখ বুলান। সামনে 'সিম্পল এমবিবিএস'—এর অপমানজনক তকমা এড়াতে পোস্টগ্রাজুয়েশান নামক সোনার হরিণের পেছনে দৌঁড়াবেন তিনি।

 

৭। অন্যদের কথা বাদ দিই। আমার বন্ধুদের কথায় আসি। তখন থার্ড ইয়ারে নতুন নতুন সার্জারি ওয়ার্ড করা শুরু করেছি। স্যার একটা পেশেন্ট দেখাতে নিয়ে গেলেন— তার ফিকাল ফিস্টুলা ডেভেলপ করেছে। রোগী স্যারের হাত বড় নির্ভরতার সাথে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন— "সার আমি বালো অমু তো, গরীব মানুষ আমরা সার।" স্যার আশ্বাস দিয়ে এলেন ঠিকই, পরে আমাদের ডেকে শোনালেন হৃদয়বিদারক কথাটা। সম্ভাবনা খুব একটা ভালো না। রোগীটির যে জটিলতা— তাতে তাকে মুখে খাবার দেয়া যাবে না। শিরার(Vein) মধ্য দিয়ে পর্যাপ্ত পানি, ইলেক্ট্রোলাইটস, খুব প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো তরলাকারে সরবরাহ করতে হবে। চার সপ্তাহ যদি তাকে এভাবে সাপোর্ট দেওয়া যায় তাহলেই তার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা । প্রচুর খরচ এতে, অনেক বেশিই বলা চলে। যদি দিতে না পারা যায়, তাহলে এ পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। ২য় বারেও মেয়ে সন্তান হওয়ায় উনাকে ফেলে নাকি চলে গিয়েছে তার পাষণ্ড স্বামী, বাবাও জীবিত নেই। স্যার বললেন, দেখ তোমরা কিছু করতে পারো কিনা।

 

এর আগের দিনই আমাদের কলেজে পিঠা উৎসব ছিল। যে টাকা প্রফিট হয়েছিল, সেটা দিয়ে আমরা একটা পার্টি দেব ভেবে রেখেছিলাম। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো— যা টাকা সবাই মিলে ইনভেস্ট করেছিলাম এবং যা লাভ হয়েছে সব দিয়ে দেব উনার ট্রিটমেন্টের জন্য। শুধু তা না, এর পরদিন থেকে সব ক্লাসমেটরা যে যেভাবে যেখান থেকে পেরেছে টাকা জোগাড় করে একসাথে জমা করেছে। আমাদের টিচাররা ওষুধ কোম্পানির সাথে কথা বলে কমদামে ওষুধের ব্যবস্থা করেছে। এভাবে প্রায় ৩ মাস ধরে চললো তার ব্যয়বহুল চিকিৎসা। অপারেশান হলো। কোনো টাকাই তার কাছে ছিল না। রিলিজের দিন সবাই মিলে গেলাম হসপিটাল ডিরেক্টরের কাছে। অনেক কম টাকা ব্যয়ে তাকে রিলিজ করা হোল। এতো টাকা উঠেছিল যে, পুরো চিকিৎসার পরেও আমাদের কাছে আরও টাকা থেকে গিয়েছিল। যাবার সময় সে টাকাটা আমরা দিয়ে দিলাম যাতে কিছু করে খেতে পারে। ছাগল কিনে পালা শুরু করলো। তা দিয়ে সংসার চলে না। আবার অভিযোগ তাদের।

 

একটা অর্গানাইজেশানের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করা হলো সেলাই মেশিন। তার মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো মোহাম্মদপুরের একটা ভালো মাদ্রাসায়। একটা সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন একজন স্যার ফ্রি দেখে নিজের কাছে থাকা ওষুধ দিয়ে দিলেন। সেদিনের কথা ভোলা সম্ভব না—আমাদের এ উদ্যোগটা দেখে এক স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন, মানিব্যাগ থেকে একটা বড় নোট বের করে দিয়ে বলেছিলেন, এ স্পিরিটটা ধরে রাখিস সবসময়। স্যারকে আমার একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে এখন— সে স্পিরিট ধরে রাখা এই বর্বর সময়েও কি ধরে রাখা সম্ভব।

 

৭। আমাদের স্যার-ম্যাডামরা আমাদেরকে শেখান রোগীদের বাবা-মা বলে সম্বোধন করতে— চাচা,মামা, খালা না। রোগীদের উপর যখন পরীক্ষা দিতে হয়, তখন রোগী যদি একটুও ব্যথা পায় কিংবা অন্য কোনোভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করে— তাহলে সে ছাত্রের আর পাশ করা লাগবে না। এভাবেই ট্রেইনড হয় প্রতিটি ছাত্র।

 

৮। যক্ষ্ণার রোগীর ডিসচার্জ পেপারে Rifampicin যখন লেখা হোল পাশে লিখে দেয়া "এই ঐষধখানা খাওয়ার পর হলুদাভ কমলা রঙ্গের মূত্র নির্গত হইতে পারে" হোল এই টাইপের একটা বাণী। কয়েকদিন পর আবার রোগীকে ভর্তি করা হোল— রোগীর নাকি জণ্ডিস হয়েছে!

 

একজন রোগীকে বলা হলো তার অপারেশানের জন্য মুখে কোনো খাবার দেয়া যাবে না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পানি খাওয়া যাবে? ভাইয়া বললেন, না। তার পরের প্রশ্ন, "টাইগার খাওয়া যাবে কি?"

 

"আমি এমপি সাহেবের চামচা, অমুক কমিশনারের একমাত্র ছাত্তিবাহক আমি, আমার কাম আগে কইরা দেন, তাত্তাড়ি কইরা দেন" —এসব চোখরাঙানি দেখার পর কোনো ডাক্তারের মন-মেজাজ যদি একটু খারাপ হয়ে যায় এত ব্যস্ততা ও কাজের চাপের মধ্যে তাহলে সেটা কি অতি অস্বাভাবিক। ডাক্তারের জুতোটা আপনি নিজের পায়ে না পড়লে কখনোই তাদের সাইকোলজিটা ধরতে পারবেন না। তা আপনি যত বড় সাংবাদিকই হোন আর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হোন আর ঢাকা বোর্ডের বাংলা বিষয়ের প্রশ্নকর্তা হোন।

 

(নিজেদের ভালো কথা আমরা নিজেরা বলতে চাই না। কোনো মিডিয়া আমাদের দু'একটা ভালো কথা লিখতে চাইছে না, ছড়িয়ে দিচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিদ্বেষের বিষবাষ্প। জনতা ভুল বুঝছে। তাদের এখন জানার অধিকার আছে আমাদের ভেতরের কথাগুলো।)

_____________________________

 

মারুফ রায়হান খান , ইন্টার্ন চিকিৎসক , এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়