SAHA ANTAR

Published:
2021-04-14 15:20:54 BdST

ইন্টারভিউ ও কথার মূল্য


বাদল সৈয়দ
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক
---------------------------------

ইন্টারভিউ ও কথার মূল্য।

ভারতের মিজ সুধামূর্তির নাম জানেন না এমন মানুষ খুব কম আছেন।
পেশায় প্রকৌশলী হলেও ইনফোসিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন এ ভদ্রমহিলা শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন অসংখ্য মানবিক ফুলের একটি অপূর্ব বাগান তৈরির জন্য।
অনাথ আশ্রম তৈরি করা থেকে শুরু করে কর্ণাটকের সব স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব এবং লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন৷ পুণর্বাসন করেছেন অসংখ্য ভাসমান নারীদের। চাইলে লিস্টটা আরো অনেক বড়ো করা যায়। তা করছি না কারণ আজকের গল্পটা অন্য ব্যাপারে।

১৯৭৪ সাল। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা সুধামূর্তি এমআইটিসহ আমেরিকার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশীপ পেয়েছেন। সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন সময় পত্রিকায় একটি চাকুরির বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়লো। বিজ্ঞাপনটি দিয়েছে টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান টেলকো (এখন টাটা মটরস)। তাঁরা কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার নেবেন, কিন্তু শর্ত হচ্ছে কোনো মহিলা তাতে আবেদন করতে পারবেন না।
মানে! ভাবলেন সুধামূর্তি। মহিলারা যোগ্যতা থাকলে কেন আবেদন করতে পারবেন না?

আগপিছ না ভেবে তিনি টাটা গ্রুপের তখনকার চেয়ারম্যান জেআরডি টাটাকে একটি পোস্টকার্ডে লিখলেন,

‘মিস্টার টাটা, আপনি এত প্রগতিশীল একজন মানুষ আর আপনার প্রতিষ্ঠানে মহিলারা চাকুরির আবেদন করতে পারবেনা! এ অদ্ভুত শর্ত আমাকে অবাক করেছে। আমার বিনীত প্রশ্ন আপনি কি ভারতের পঞ্চাশ ভাগ জনবলকে প্যারালাইজড বানিয়ে ফেলছেন না? এদেশের মানুষের অর্ধেক হচ্ছেন মহিলা, তাঁদের বাদ দিয়ে একটি দেশ কীভাবে এগুবে? আপনার কোম্পানিই বা কীভাবে এগুবে? অন্য কেউ এ বিজ্ঞাপন দিলে আমি মেনে নিতাম, কিন্তু আপনি এবং টাটা- যারা সব সময় সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকেন তাঁদের কাছ থেকে এ শর্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।‘

মজার ব্যাপার হলো সুধামূর্তি কিন্তু তখন জেআরডি টাটার ঠিকানাও জানতেন না। তাই তিনি পোস্ট কার্ডে ঠিকানার ঘরে লিখলেন, মিস্টার জেআরডি টাটা, চেয়ারম্যান, টেলকো, বোম্বে।

যাই হোক, যেহেতু জেআরডি অতি বিখ্যাত মানুষ তাই সে অসম্পুর্ন ঠিকানায় লেখা চিঠিটি ঠিকই তাঁর হাতে পৌঁছালো। তিনি কিন্তু বিজ্ঞাপনের বিষয়টা জানতেন না। এটা দেখতেন অন্যরা। তিনি তাঁদের ডেকে  বললেন, কাজটা তোমরা ঠিক করোনি, দিস ইজ আ সেইম।  এ তরুণীকে ইন্টারভিউতে ডাকো।

শেষ পর্যন্ত সুধামূর্তিকে ইন্টারভিউতে ডাকা হলো।
তিনি রুমে ঢুকেই বুঝলেন বোর্ড সদস্যরা তাঁকে ডাকতে বাধ্য হয়ে খুব একটা খুশি নন। দেয়ালের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ভেসে বেড়াচ্ছে বৈরি নিঃশ্বাস। সামনে বসা কারো চোখে অবজ্ঞা কারো চোখে বিরক্তি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো, তারপর একজন সামনে ঝুঁকে বললেন, মিজ মূর্তি, আপনাকে কাজ করতে হবে আমাদের জামশেদপুর কারখানায়। সেখানকার পরিস্থিতি আপনি জানেন না। দ্যাটস আ মেইল ডোমেইন। শ্রমিকরা আগে কখনো মহিলা ইঞ্জিনিয়ার দেখেনি, আশেপাশে আপনি কোনো  মহিলা কলিগ পাবেন না। তারপরও আপনি কাজটি করবেন?
‘করবো স্যার।‘
‘ওখানে মেয়েদের আলাদা ডর্ম নেই, টয়লেটও নেই। পারবেন ছেলেদের সাথে এক ডর্মে থাকতে? টয়লেট শেয়ার করতে?  তাছাড়া রাতের শিফটেও ডিউটি করতে হবে। কোনো মেয়ে কিন্তু এর আগে এ চাকুরি করেননি।'

সুধামুর্তির মনে হলো বোর্ডের সদস্যরা মনেপ্রাণে চাইছেন তিনি ভয় পেয়ে যাতে চাকুরিতে জয়েন না করেন, তাহলে জেআরডির সামনে তাঁদের মুখ রক্ষা হয়।

তিনি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললেন, স্যার, হিইয়েন সাং যখন চীন থেকে ভারত যাত্রা করেছিলেন তখন অনেকেই তাঁকে বলেছিলেন, এপথ অতি দূর্গম, যাত্রায় পড়বে অসংখ্য বনজঙ্গল যা সাপ ও হিংস্র প্রাণিতে ভরা, তুমি পথেই মারা যাবে, তারপরও কি ভারতবর্ষে যেতে চাও?  হিউয়েন সাং তখন আবৃত্তি করেছিলেন একটি পুরানো চিনা প্রবাদ, 'দশ হাজার মাইলের যাত্রাও শুরু হয় একটি মাত্র পদক্ষেপ দিয়ে- তারপর বলেছিলেন,  'আমাকে আমার  যাত্রার প্রথম পা-টি ফেলতে দাও।' স্যার একইভাবে আমি বলতে চাই, যেকোনো দেশের উন্নতির প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে মহিলাদের কাজের সুযোগ দেওয়া। তাই টেলকোতে আমি জয়েন করবো। আপনাদের উচিত আমাকে প্রথম পা ফেলতে দেওয়া।

'ওকে লেডি, ইউ হ্যাভ গট ইট’- তিতা করলা খাওয়া মুখে বোর্ডের চেয়ারম্যান বললেন।

বিজয়ের আনন্দ নিয়ে সুধামূর্তি বাড়ি ফিরে প্রথমেই তাঁর বাবাকে খবরটি দিলেন।
তাঁর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তা চাকুরিটা তুমি করবে?
আনন্দোচ্ছল সুধা উত্তর দিলেন, পাগল নাকি! কে যাবে ওই ধ্যারধ্যারা জামশেদপুরে চাকুরি করতে? আমি পিএইচডি করতে এমআইটি যাবো।

বাবা নড়েচড়ে বসলেন, তারপর বললেন, আচ্ছা, তুমি  কি জেআরডিকে যা লিখেছ বা ভাইভা বোর্ডকে যা বলেছ তা বিশ্বাস করো? তুমি কি মনে করে মহিলাদের চাকুরি না দেওয়াটা অন্যায়? জেন্ডার ইনইকুয়ালিটি ইজ আনফেয়ার?
'অবশ্যই বিশ্বাস করি বাবা।'
তাহলে তোমার ওই চাকুরিতে যোগ দেওয়া উচিত। যে অন্যায়ের প্রতিবাদ তুমি করেছ, তাতে যোগ না দিলে তো সে অন্যায়কেই তুমি জাস্টিফাই করলে। ভবিষ্যতে মহিলাদের চাকুরি না দেওয়ার জন্য তাঁরা তোমার রেফারেন্স দেবেন। মহিলাদের চাকুরির অযোগ্য ভাবার এ অচলায়তন তাহলে কখনোই ভাঙবে না। সবচে বড়ো কথা, তুমি চাকুরি করবে বলে তাঁদের কথা দিয়েছ। সে প্রতিশ্রুতির একটা দাম আছে না?  সে দাম তোমাকে শোধ করতে হবে। ইউ সুড ফরগেট দ্য পিএইচডি ফ্রম এমআইটি, মাই কুইন।

সুধামূর্তি কিছুক্ষণ পাথরের মতো বসে রইলেন তারপর ধীরে ধীরে নিজের রুমে ফিরে এলেন। সেখানে টেবিলে পেপার ওয়েটের নিচে অপেক্ষা করছে এমআইটির বহু প্রতিক্ষিত পিএইচডির অফার।
তিনি কাঁপা হাতে তা ছিঁড়ে ফেললেন।

কথার দাম আসলে হীরার চাইতেও বেশি।
অনেক অনেক বেশী।

(শ্রদ্ধেয় সুধামূর্তির বয়ানে ঘটনাটি শোনা।)

#আসুনমায়াছড়াই

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়