Ameen Qudir

Published:
2017-01-31 18:18:29 BdST

ডাক্তার : কেউ বলে সাক্ষাৎ দেবতা :কেউ বলে কসাই


মডেল ছবি

 

 

 

ডা. অসিত বর্দ্ধন , কানাডা থেকে।
__________________________

হররোজ দেশে থেকে অনেক মানুষ বিদেশে যান। এদের একটা অংশ যান চিকিৎসা করাতে। এই চিকিৎসা অভিবাসনের স্বাস্থ্যগত দিক ছাড়াও অর্থনৈতিক দিক আছে।দেশের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। যা অগোচরে থাকে তা হল কখনো কখনো সেটা দেশের ডাক্তার দের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করতে পারে।


চিকিৎসা নিতে বিদেশ যাওয়া নতুন কিছু নয়। বঙ্গবন্ধুর অপারেশন লন্ডনে হয়েছিল। তবে সেই সময় লাপারস্কপিক সার্জারি চালু ছিল না। হাল আমলেই বেগম খালেদা জিয়া সৌদি আরবে চিকিৎসার জন্য গিয়েছেন। আমাদের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ছাড়াও প্রায় সব রাষ্ট্রপতি তাদের চিকিৎসার প্রয়োজনে সিঙ্গাপুর গিয়েছেন। শীর্ষস্থানীয় ধনীরাও একইভাবে এই কাতারে নাম লিখিয়েছেন অনেক আগে।


সাধারণত ধনী ব্যক্তবর্গ বিদেশ গেলে তা আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয় না এজন্য যে, এরা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত থাকলেও যেতেন। এটা যতটা প্রয়োজন তাঁর চাইতে বেশি ক্লাস সিম্বল।
৮০ র দশকে আমরা যখন মেডিকেলে পড়ি, তখন ভারতে চিকিৎসা বলতে বেশি নাম শোনা যেত ভেলরের। এদেশে কোন চিকিৎসা না হলে মানুষ শেষ চেষ্টা করতে যেতেন ওখানে। তবে একেবারে শুরুতেই চিকিৎসার জন্য ভেলরে নিতেন না কেউ। ভেলরের সেই চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ছড়িয়েছিল ভারত ছাড়িয়ে এদেশে। তখন মোবাইল নামের সর্ব রোগের মহৌষধ মার্কা ফোন চালু ছিল না। সুনাম ঘুরত মানুষের মুখে মুখে ।

 

এই বিষয়ে যাওয়ার আগে আরেকটা কথা বলা দরকার যে মানুষ ভাল চিকিৎসার জন্য দেশের মধ্যেই দূরবর্তী স্থানে যেত। সমস্ত উত্তরবঙ্গ থেকে মানুষ আসতেন রাজশাহীতে। দক্ষিণ বঙ্গ থেকেও। গোলাম সাহেব ছিলেন নামকরা সার্জন। আমরা মেডিকেলে ভর্তি হই ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে। তখন উনাকে কলেজে দেখিনি। তাঁর অস্ত্রোপচারের যেমন সুনাম ছিল , তেমনি মানুষ জানত তাঁর রাগের কথা। কিন্তু সুনামের নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল অন্য সীমাবদ্ধতা।


তাকে নিয়ে একটা গল্প আছে। কোন এক রোগী গেছেন ইংল্যান্ডে অস্ত্রোপচার করাতে। তিনি রাজশাহীর কাছের শহর থেকে এসেছেন শুনে নাকি সেই অধ্যাপক বলেছেন যে ওখানে তো গোলাম সাহেব আছেন। তিনি থাকতে আপনার আমাদের এখানে অপারেশন করানোর প্রয়োজন নেই।


আমার বিদেশে থাকা অভিজ্ঞতা দিয়ে জানি যে এটা হয়ত রটনা। অতিরঞ্জিত। কিন্তু তিনি যে যশস্বী ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। উনার ক্লিনিকে উনি টাকা নিয়ে বেশ কড়া ছিলেন। এমন রটনা ছিল যে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে উনি বলতেন যে আপনার সাথে তো এপেন্দিক্স কাটার চুক্তি কিন্তু পেটে একটা টিউমার আছে , টাকা দিলে সেটা কেটে দেব। না হলে পরে আবার আলাদা করে টাকা দিয়ে কাটতে হবে। উনাকে কেউ মনে করতেন সাক্ষাত দেবতা, কেউ বলতেন কসাই।

 


আমাদের সময়েই মেডিসিনের রফিক স্যারকে দুর দূরান্ত থেকে মানুষ দেখাতে আসতেন। স্যার কখনো রোগী দেখতেন রাত ২ টা পর্যন্ত। রোগী শেষ হোতো না, আবার শুরু করতেন সকাল ৬-৬৩০ এ। হাসপাতালে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। উনার বাসায় ছাদে অনেকে নাকি রাত কাটিয়েছেন পরের দিন সকালে রোগী দেখানোর জন্য।


এদেশ থেকে ক্যন্সার চিকিৎসায় ইন্ডিয়াতে যাওয়ার হার বাড়ে বোধহয় ৯০ এর দশকে। ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে। কোলকাতায় , হাতের কাছে হওয়ার সুবাদে। এর সাথে যোগ হয় হার্ট অপারেশনে যাওয়ার বাড়তি সংখ্যা। দেবী শেঠি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সেই সময়ে। তাঁর অপারেশন করা রোগীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন বাংলাদেশি। নিউরো সার্জারির বেশ কিছু রোগী সেই সময় যেতে দেখেছি ইন্ডিয়াতে। এছাড়া বিভিন্নভাবে হতাশ হওয়া রোগীরাও যেতেন।


৭০- ৮০'র দশকে বেসরকারি ক্লিনিক তেমন ছিল না। বেসরকারিতে শুধু সার্জারি হোতো, অনেক সময় সার্জনের বাড়ির নিচতলাতেই। অনেক সার্জনের সহধর্মিণী ইথার ঢালতেন। এরা আমাদের এখনকার হাসপাতাল ব্যবসার পূর্বপুরুষ।


২০০০ সালের আগে-পরে থেকে বাংলাদেশ , ইন্ডিয়া দুই জায়গাতেই বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। সেই সাথে প্রতিযোগিতা। টিকে থাকার লড়াই। ব্যবসা প্রসারের লড়াই। এই সময়ে মোবাইল ফোনের প্রসারের সাথে যোগাযোগ বাড়ে জ্যামিতিক হারে। মানুষ ইচ্ছা করলেই ইন্ডিয়া যেতে পারে, খবর সংগ্রহ করতে পারে। এর চল গত দুই দশকে একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশে এখন তো আনাচে কানাচে ক্লিনিক হয়েছে। কিন্তু সরকারি মানদণ্ডে দেখলে এর যে কয়টি মানসম্পন্ন বিবেচিত হবে তা হাতে গণা যেতে পারে। একেবারে বড় জেলাগুলো ছাড়া বিশেষায়িত সেবা তেমন একটা গড়ে উঠে নি। ক্লিনিক হাসপাতালগুলোতে এনেস্থেসিয়া মেশিন এখনো আসেনি সব জায়গায়। পোস্ট অপারেটিভে মনিটর করার মত যন্ত্র ও মানুষের অভাব। অনেক ক্লিনিক হাসপাতালে ৩ শিফটের ডাক্তার নেই। নেই পর্যাপ্ত নার্স। কোথাও কোথাও তো আয়া দিয়ে নার্সের কাজ চালানো হয়। ঠিক এরকম অপেশাদার মনোভাবের সাথে যোগ হয়েছে ডাক্তারদের হাত থেকে এসবের ব্যবস্থাপনা অপেশাদার কিন্তু মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীর হাতে চলে যাওয়া।


পাশাপাশি দেশ হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে স্বাস্থ্য পরিষেবা ইন্ডিয়াতে পেশাদার হয়েছে , আমদের দেশে তা হয়নি। আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে অগোচরে। সেটা হল যে এখানে একটা রোগীর হয়ত চিকিৎসা হল সাধারণ কোন হাসপাতালে যেখানে বিশেষায়িত সেবা নেই। এই রোগীটা এখানে বিশেষায়িত হাসপাতালে না যেয়ে চলে যায় ইন্ডিয়াতে বিশেষায়িত হাসপাতালে। কিন্তু তুলনা করে যে এদেশের চাইতে বিদেশের চিকিৎসা ভাল।

 

আমাদের দেশে সমান তালে আর একটা জিনিষ গড়ে ওঠেনি তা হল সামগ্রিক চিকিৎসা। সব আছে কিন্তু ছড়ানো , ছিটান। একই ছাদের নিচে রোগীর প্রয়োজনীয় সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে ঠিক কয়টা হাসপাতাল আছে? বিদেশে গেলে এটা কিন্তু খুব সহজে চোখে পড়ে রোগীদের। প্রশ্ন উঠতে পারে যে বিদেশে যে পরিমাণ টাকা রোগী খরচ করেন এখানে তা করেন না কেন? আমার ব্যক্তিগত ধারনা সন্তুষ্টি পেলে মানুষ এদেশেই টাকা খরচ করতে চাইবে, বিদেশে নয়। আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো ৫০ জনের সুবিধা ১০০ জনকে দিতে যেয়ে কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না। কেউ এই প্রসঙ্গ তোলে না কখনো যে কিভাবে বরাদ্দের টাকা দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ রোগীর ব্যবস্থাপনা সম্ভব? জনবলের সুষম বণ্টন নেই। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, অনৈতিকতা খেয়ে ফেলেছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত। শুধু একটা ব্যাপারে সবাই সিদ্ধহস্ত আর তা হচ্ছে চিকিৎসকের সমালোচনা, সব অব্যবস্থাপনার দায় তাঁর উপড়ে চাপানো।

বিদেশ যাওয়াটা সব দেশেই আছে। কানাডা থেকে আমেরিকাতে চিকিৎসা নিতে যায় অনেক কানাডিয়ান। কারণ উন্নত চিকিৎসা নয়, কারণ বেসরকারি চিকিৎসা কানাডাতে সহজলভ্য নয়। কানাডা থেকে অনেকেই দাঁতের চিকিৎসায় যান মেক্সিকোতে। ওখানে খরচ কম। বেড়ান আর দাঁতের চিকিসার সাকুল্য খরচ শুধু দাঁতের চিকিৎসার চাইতে কম। অনেক বুদ্ধিমান মানুষ এজন্য ব্যয়বহুল দাঁতের চিকিৎসা এদেশে করান না। আয়ারল্যান্ড থেকেও মানুষ স্পেনে কিম্বা পূর্ব ইউরোপের দেশে যেতেন এই ধরনের ব্যয়বহুল চিকিৎসা এড়াতে। মেইন স্ত্রিমে না হলেও সাইড স্ট্রিমে এধরনের চিকিৎসার বিজ্ঞাপন দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে ''ওয়ার্ড অফ মাউথ'' কাজ করে।

আজ দেশে আমাদের রোগীদের বিদেশ যাওয়া , এদেশে মেইন্সট্রিম পত্রিকায় অন্য দেশের বিজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ক্ষোভ কিম্বা অভিযোগ এই সমস্যার সমাধান নয়। সমাধান হতে পারে আমাদের বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে তলার মধ্যে। প্রশাসন যেমন আরও সতর্ক হতে পারেন মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে , তেমনি সমন্বিত মানস সম্পদ উন্নয়ন প্রয়োজন। ক্যান্সার সেবার জন্য আগামী ৫ বচ্ছরে আমাদের দেশে জনসংখ্যার ভিত্তিতে কয়জন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন ? সারা দেশে এনেস্থেটিস্ট কয়জন? আমাদের মেডিকেল কলজে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? এরকম প্রশ্ন নিয়ে নিজেদের নিজের সামনা সামনি হওয়া উচিত। সব বিশেষজ্ঞের অবস্থান হবে দেশজুড়ে না কি এক কেন্দ্রিক?

 

বেসরকারি ক্লিনিক গুলোতে ডিউটি ডাক্তারদের জন্য সরকারি বেতন স্কেলের এক ধাপ উপরে বেতন নির্ধারণ করা উচিত কারণ ওখানে পেনশন নেই। প্রভিডেন্ড ফান্ড থাকতে হবে এবং প্রভিডেন্ড ফান্ডে সমপরিমাণ টাকা ক্লিনিক / হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। নার্সদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এরকম বিন্যাস না থাকার ফলেই ব্যাঙের ছাতার মত সংখ্যায় প্রতিষ্ঠান গজিয়েছে এবং গুণগত মান রক্ষা হয়নি। দেশে সমস্ত মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনারারি নামের নারকীয় পন্থা বিলুপ্ত করা উচিত। যারাই কোন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার জন্য মনোনীত হবেন তাদের কমপক্ষে ইন্টারনিদের সমান হারে ভাতা দিতে হবে। ইন্টারনিদের ভাতা প্রথমশ্রেণীর গেজেতেদ অফিসারের বেতনের সমান নির্ধারিত থাকা উচিত। এতে বেতন ভাতা বাড়লে আলাদা করে ইন্টার্নদের ভাতা নির্ধারণ করার প্রয়োজন পড়বে না। এতে শিক্ষার্থীদের পেটে ভাতে থাকার জন্য নাকে মুখে দৌড়াতে হবে না। আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত যে একজন প্রশিক্ষণার্থী যে কাজটি করেন সেটি আরেকজন চিকিৎসকের কাজের সমতুল্য। কাজেই তাকে সম্মানী না দেওয়া অমানবিক। এতে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা হ্রাস পেলেও গুণগত মানের উন্নতি ঘটবে। আখেরে লাভ হবে বাংলাদেশের। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ডিজিটাল করা প্রয়োজন। তথ্য সংরক্ষণ জরুরি। তথ্য থাকলেই শুধু প্রমাণ করা সম্ভব যে দেশে কি ধরনের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব এবং তাঁর কতটুকু দেওয়া হচ্ছে। এই তথ্য না থাকার জন্য শুধু জটিলতা (কমপ্লিকেশান) গুলো প্রচার পায়, সাফল্য আড়ালে মাথা কুটে মরে।


আমাদের বিখ্যাত চিকিৎসকদের সিরিয়াল পাওয়া যেন সোনার হরিণ। তারমানে ভাল চিকিৎসকের এসব রোগী বিদেশে যান না। দেশে বিরল রোগের চিকিৎসা হয় যেমন বৃক্ষ মানবের চিকিৎসা। সুতরাং দেশে বেশ কিছুমান সম্পন্ন চিকিৎসক আছেন। যখন এমন চিকিৎসক জেলায় জেলায় পাওয়া যাবে এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা চিকিৎসা দেওয়ার উপযুক্ত হবে , ঠিক তখনি এদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া রোগীর সংখ্যা কমে যাবে। আমাদের কিছু টার্গেট এলাকায় বড় হাসপাতাল হওয়া উচিত যা সীমান্তের কাছে। যেন ওদেশের রোগীরাও আমাদের চিকিৎসকদের চিকিৎসা নিতে আসেন গাঁটের টাকা খরচ করে। হেলথ ট্যুরিসম কোনদিন বন্ধ হবে না, কিন্তু রিভার্স করার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। আমাদের জনবল তৈরি, ( দেশে যত চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে সবার কর্মসংস্থান সম্ভব) পরিসেবা চাই, চাই সরকারের সঠিক দিকনির্দেশনা।

_____________________________

ডাঃ অসিত বর্দ্ধন
কনসালটেন্ট এনেস্থটিস্ট , কানাডা bdemr.com (অনলাইন মেডিকেল ইএমআর) এর প্রতিষ্ঠাতা)

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়