Ameen Qudir

Published:
2017-01-30 16:01:34 BdST

মর্মস্পর্শী এই লেখার লেখককে খুঁজে পাওয়া যায় নি


 

 

কাল কিডনি স্টোন অপারেশান হয়ে গেল ।
অপারেশান থিয়েটার থেকে কেবিনে ফিরে এলাম । ঝিমুনি লাগছিল । অনেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে । যেরকম হয় আর কি । নিকটাত্মীয়দের উৎকন্ঠিত মুখের মধ্যে একজনকে দেখে অদ্ভুত লাগল । আত্মীয় নন , অথচ চিনি , আবার পরনে রোগীদের পোশাক ! মাথাটা ঠিক কাজ করছিল না ।একটু ব্যথা ব্যথা করছিল , নার্সকে বলতেই ইন্জেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে য়ে দিলেন ।
একেবারে ঘন্টা দশেক পরে ঘুম ভাঙল । বেশ ফ্রেশ লাগছিল । ব্রেকফাস্ট করছি , আবার সেই ভদ্রলোক এলেন ।
কী, কেমন আছো ?
ভারি আন্তরিক কন্ঠস্বর ।
এবারে আর চিনতে অসুবিধা হল না । খুবই নামকরা নিউরোলজিস্ট । কাল ঝিমোচ্ছিলাম , নামটা পেটে আসছিল , মুখে আসছিল না ।
বসুন , বসুন ।
গিন্নির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম । মিলি ডাক্তার নয় । কিন্তু ওনার নাম শুনেছে ।
সবাই মিলে একটু গল্প গুজব হল ।
জিগ্যেস করলাম কি জন্য উনি ভর্তি হয়েছেন । বললেন পাশের কেবিনে আছেন । কি কারণে আছেন সেটা বললেন না । বোধহয় মিলি আছে বলেই । বুঝলাম ব্যাপারটা সিরিয়াস ।
কিন্তু অন্যান্য ব্যবহারে সেটা বোঝার উপায় নেই । খুবই অমায়িক , হাসিখুসী । দুদিন ছিলাম । রোজ তিনবেলা আসতেন ।
যেদিন ডিসচার্জ হলাম , ওনার ঘরে গেলাম ।
দেখি কেবিনের এক কোণে বেশ কিছু ঠাকুর দেবতার ছবি ,মূর্তি ।
বেশ অবাক হলাম ।
এমনিতে ডাক্তারদের ভক্তি টক্তি একটু কমই হয় , হলেও এরকম প্রকাশ থাকে না । একটু খারাপ লাগছিল । দুদিনেই বেশ ভাল লেগে গেছিল ওনাকে । এসব লোক দেখানো ভডং দেখে মেজাজ খাট্টা হয়ে গেল । এমন নামকরা লোক !
বাডি ফিরে এলাম । দু তিন দিন বিশ্রাম নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম । এবং ভদ্রলোকের কথা ভুলেই গেলাম ।
কাজকর্ম চলছে ।
প্রায় ছ সাত দিন পরে একটা রেফার পেশেন্ট দেখতে ,আমি যে কেবিনে ছিলাম , সেই কেবিনে গেছি ; ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল । সিস্টারকে জিগ্যেস করলাম কবে ওনার ছুটি হল ।
ছুটি ত হয় নি স্যার ।
সে কি !
ওনার কেবিনে গেলাম । এই এক সপ্তাহেই বেশ রোগা হয়ে গেছেন । বেশ কাহিল কাহিল লাগছিল । পুজো করছিলেন । ইশারায় জানালেন দু মিনিট লাগবে ।
বসলাম ।
বলো ভায়া , কি খবর । আজ জয়েন করলে ?
নির্বিকারভাবে হ্যাঁ বলে দিলাম । আসলে একটু লজ্জা করছিল । ওনার কথা ভুলেই গেছিলাম ।
আজ জিগ্যেস করলাম কি অসুখ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ।
গ্লায়োব্লাসটোমা মালটিফরমি !
মুচকি হেসে জানালেন ।
হতবাক্ হয়ে গেলাম ।
গ্লায়োব্লাসটোমা মালটিফরমি । সাংঘাতিক ব্রেন টিউমার । সাক্ষাত মৃত্যু । এই রোগ হলে হলে কেউ সাত আট মাসের বেশী বাঁচে না । সেই রোগ মাথায় নিয়ে ইনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন !
ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলাটা যদিও ভুল , হসপিটালে আছেন । কিন্তু চালচলনে এরকম মারাত্মক একটা রোগের কোন চিহ্নই নেই । না বললে বিশ্বাসই হত না । সত্যি কথা বলতে কি , শোনার পরও বিশ্বাস হচ্ছে না ।
আরে , তাতে কি হয়েছে । অমন চুপ মেরে গেলে কেন ।
কি আর বলব । ইনিয়ে বিনিয়ে দু চারটে কথা বলে পালিয়ে এলাম ।
কোন মানে হয় । ভগবানের এ কি অবিচার । এত নামকরা , দারুণ একটা লোক । তার এই রোগ !
তারপর থেকে রোজই ওনার ঘরে যেতাম ।
আধ ঘন্টা , পঁয়তাল্লিশ মিনিট গল্পগুজব করতাম । খুব খুসি হতেন ।
অদ্ভুত লাগত । কোন ভিজিটরকে কোনদিন দেখি নি ।
একদিন জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম ।
কেউ নেই ভাই ।
সে কি স্ত্রী , ছেলেমেয়ে , আত্মীয় স্বজন কেউ নেই । মনে মনে ভাবছিলাম । তারপর এত নামকরা ডাক্তার । এদের ত অ্যাসিসটান্ট , চ্যালা চামুন্ডার অভাব হয় না । আর একটা ব্যাপারও লক্ষ্য করার মত , ভদ্রলোকের বাডি সাউথ ক্যালকাটা । উনি ভর্তি হয়েছেন এই ধ্যাধ্ধেরে নর্থে !
এরোগের প্রগনোসিস ত তুমি জানো । কাউকে খবর দিই নি । বলেছি তিন মাসের জন্য বাইরে যাচ্ছি । তার মধ্যেই হয়ে যাবে , কি বল ?
বলার আর কি আছে !
ভাই , তুমি হাতির মৃত্যু দেখেছ ?
হ্যাঁ । নর্থ বেঙ্গলে রেলে কাটা পড়ে .....
না না । ন্যাচারাল ডেথ । তুমি কেন , প্রায় কেউই দেখে নি । হাতি মারা যায় নির্জনে , একাকী । আমি হচ্ছি সেই হাতি । বুঝলে ? বলে হাসলেন । তবে একটু করুণভাবে ।
আপনার পরিবার ?
ছেলেপিলে হয় নি , বুঝলে ? আমি থ্যালাসেমিয়া ক্যারিয়ার । আমার স্ত্রীও তাই ছিলেন । তাই .....
চুপ করে রইলাম ।
তুমি নিশ্চই ভাবছ বিয়ের আগে টেস্ট করাইনি কেন ? লাভ ম্যারেজ ভাই । ব্লাড টেস্ট করে ত আর প্রেম করা যায় না , কি বল ?
ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন ।
তা , ম্যাডাম কি?.....
ম্যাডামের কাছে যাব বলেই ত রেডি হচ্ছি । ব্রেস্ট ক্যান্সার । পাঁচ বছর হয়ে গেল ।
পার্স খুলে বিগতা স্ত্রীর ছবি দেখালেন । অপরূপ সুন্দরী ।
তারপর আরো প্রায় দশ মিনিট বলে চললেন কি করে ওনাদের আলাপ হয়েছিল , কোথায় থাকতেন ইত্যাদি ইত্যাদি ।
মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল ।
মিলিকে সব বললাম । ও ত মর্মাহত । একদিন এসে দেখা করে গেল ।
তিন চার দিন পরে দেখি গেরুয়া পরা একটি লোক ওনার কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
শুনলাম ওনার মৃত্যুর পর সব সম্পত্তি যাতে রামকৃষ্ণ মিশন পায় তার ব্যবস্থা করে ফেললেন ।
ঈশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছেন , বুঝলে ভাই।
এইবার খুব বিরক্ত হলাম । সেদিন এমনিতেই মেজাজটা খারাপ ছিল । একটি অতি পন্ডিত পেশেন্ট পার্টির ব্যবহারে মেজাজটা এমনিতেই তিরিক্ষে হয়ে ছিল । আর সামলাতে পারলাম না । বলা উচিত হল না , তবু বলেই ফেললাম - এত সব কিছুর পরও আপনি বলছেন ঈশ্বর আপনাকে অনেক দিয়েছেন ! এত যে পুজো করছেন , কি লাভ হল ?
অপূর্ব একটা হাসি উপহার দিলেন । বললেন- সময় আছে ? বসো ।
সময় ছিল না । তবু বসলাম ।
দ্যাখো , তুমি আমি এত যে ক্যান্সার পেশেন্ট দেখি , তাদের সবারই প্রাথমিকভাবে একটা কমন কমপ্লেন থাকে । কি বলত ?
ঠিক বুঝতে পারছিলাম না উনি কি বলতে চাইছেন । অগত্যা চুপ করে রইলাম ।
সেটা হচ্ছে যখনই কোন পেশেন্ট জানতে পারে তার ক্যান্সার হয়েছে , তার মনে হয় -হে ভগবান । আমারই কেন হল ? আমি কি দোষ করেছি ! তাই ত ?
একদমই তাই । এই অনুভূতিটাই সবার আগে আসে । সে যেরকম পেশেন্টই হোক । সেদিন ক্রিকেটার যুবরাজ সিংয়ের অটোবায়োগ্রাফি পড়ছিলাম । ওনারও একদম এই অনুভূতিটাই হয়েছিল । মনে মনে ভাবছিলাম ।
তারপর যেটা হয় আস্তিক হয়ে যায় নাস্তিক । ভাবে - দূর শালা । পুজোটুজো করে কি হবে । যতসব ফালতু ব্যাপার । কিন্তু বিশ্বাস করো আমার এ দুটোর একটা ফিলিংও হয় নি ।
একবারও মনে হয় নি ,এত লোক থাকতে আমারই কেন ?
না ।
আপনার অসম্ভব মনের জোর । স্বীকার করতে বাধ্য হলাম ।
আরে না , না । ভদ্রলোক জোরে জোরে মাথা নাডলেন । ওসব কিছু না । দ্যাখো , আমি না খুব গরীব ঘরের ছেলে । হুগলি জেলার ডিহিভুরশুটের এক অজ পাডা গাঁএ আমার জন্ম । চার কিলোমিটার হেঁটে আমি স্কুলে আসতাম । বাবা ছিলেন ভাগচাষী । একবেলা খাবার জুটতো । পডাশুনোয় ভাল ছিলাম । এক প্রাক্তন জমিদার , অত্যন্ত ভাল মানুষ, তার হঠাৎ নজরে পডে যাই । তিনি আমার জন্য কিছু টাকার ব্যবস্থাকরে দেন । তারপর আমার এক মুসলমান মাস্টারমশাই আমাকে আল আমিন মিশনের একটা অনুদান জোগাড করে দেন । ওদের কোচিংএ আমি জয়েন্ট কোয়ালিফাই করি । আমার রাংক ছিল তিন । তারপর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই । আমি নটা গোল্ড মেডেল পেয়েছিলাম । বুঝতেই পারছ ফ্রি তে পড়াশুনো করেছি । তারপর এক চান্সে ডি এম পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করলাম । তারপর যা হয় । গুরুজনের আশীর্বাদে দুর্দান্ত প্র্যাকটিস হল । পয়সা কডির অভাব ত দূর অস্ত , এত পয়সা হল যে শেষদিকে বিরক্ত লাগতে থাকল ।
একটানা বলে ভদ্রলোক চুপ করলেন । তারপর জিজ্ঞাসা করলেন - তা এই সব , আমার এই আশাতীত উন্নতি কেন হয়েছে বলে মনে হয় ।
কেন আবার , আপনার মেরিটের জন্য।
ভদ্রলোক খুব খুসি হলেন । ঠিক বলেছ । তা আমার ঈশ্বরদত্ত মেরিটের জন্য ত ঈশ্বরকে কোনদিন অনুযোগ করি নি , হে ভগবান এত লোক থাকতে আমায় কেন এত মেরিট দিলে? তাহলে আজই বা আমি ঈশ্বরের কাছে কেন বলব -এত লোক থাকতে আমারই বা কেন ক্যানসার হল ! কি বল?
কি আর বলব । গলার কাছটা ধরে গেছিল ।

তিন দিন পরে ভদ্রলোক মারা গেলেন ।
___________________________________
# লেখাটি প্রখ্যাত লোক সেবী চিকিৎসক ডা. গোলাম ফারুক বাবুল এর কাছে পাওয়া।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়