Dr. Aminul Islam

Published:
2020-09-22 00:59:23 BdST

দ্বাদশে ৯৮.২ নম্বর পেয়ে রাজমিস্ত্রীর ছেলে পড়তে গেল কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে




ডেস্ক
____________________

মেধা থাকলে মূল্যায়ণ হবেই। ঘোর গন্ডগ্রাম থেকে মেধার জোরে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সম্ভব। অনুরাগ তিওয়ারি। এক কৃষকের ঘরে জন্ম। সংসারের ব্যয়ভার মেটাতে বাবা মাঝেমধ্যে রাজমিস্ত্রির কাজও করেন। সিবিএসইয়ের (ভারতের দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা) ক্লাস দ্বাদশে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ নম্বর পেয়ে এ বছর উত্তীর্ণ হয়েছেন। পড়তে যাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে কোনো খরচ ছাড়াই, মানে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে পড়বেন তিনি। পাঠকের জন্য তাঁর পথচলার গল্পটি তুলে ধরা হলো।


সাধারণ ঘরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও অনুরাগ তিওয়ারি আসলে কোনো সাধারণ ছেলে নন। উত্তর প্রদেশের লখিমপুর জেলার ছোট গ্রাম সারাসানে জন্ম। ১৩ জুলাই ফল ঘোষণার পরে গ্রামের সবাই একটু অবাক। সবাইকে আরও অবাক করেছেন গবেষণার জন্য বিশ্বের অন্যতম সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাচ্ছেন বলে।


মানবিক বিভাগে পড়ুয়া অনুরাগ ইতিহাস ও অর্থনীতিতে পেয়েছেন পুরো নম্বর, ১০০। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ১ কম পেয়েছেন (৯৯) ইতিহাস ও অর্থনীতির চেয়ে। ইংরেজিতে ৯৭ আর অঙ্কে ৯৫।


প্রান্তিক কৃষকের ছেলে অনুরাগ তিওয়ারি সিবিএসইতে অবিশ্বাস্য ফল ছাড়াও তাঁর গ্রামের প্রথম ব্যক্তি, যিনি ভারতের বাইরে পা রাখতে চলেছেন। আর নিজ যোগ্যতার কারণে ১০০ শতাংশ বৃত্তি নিয়ে বিশ্বের একটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যাবেন। তবে করোনার কারণে তাঁর যাওয়াটা পিছিয়েছে।



অনুরাগ তিওয়ারির পড়াশোনা উত্তর প্রদেশের বিদ্যাজ্ঞান একাডেমিতে। শিব নাদার ফাউন্ডেশনের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে আসা। তাঁদের অনেকেই সফল হয়ে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন।


বিদ্যাজ্ঞান একাডেমিতে পড়াশোনার সাতটি বছর কাজে লাগানোর চেষ্টা করে গেছেন অনুরাগ তিওয়ারি। ভবিষ্যতের ভালো কিছু করার আশায় কোনো সময় নষ্ট না করা কৃষকের ছেলেটির স্বপ্ন পড়া শেষে ভারতেই ফিরবেন। তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও গণিত নিয়ে পড়বেন। ভারতে ফিরে নিজের মতো অন্য সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার পথ তৈরিতে কাজ করবেন। তারা যেন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে, চান সেই সুযোগ করে দিতে।

বোর্ড পরীক্ষাগুলোর জন্য নিজের তৈরি স্টাডি প্ল্যান অনুসরণ করেছিলেন অনুরাগ তিওয়ারি। ‘আমি কোথায় পড়াশোনা করছি, সেই পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে পড়ার পরিকল্পনাটা করা জরুরি,’ বলছিলেন অনুরাগ। দিন শুরু ভোর সাড়ে চারটার পরে। সব ক্লাসেই উপস্থিত থাকতেন। সময়ের কাজ সময়ে শেষ করে ঘুমাতে যেতেন রাত ১১টার পরে। তিনি বলছিলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান থাকলে বা বন্ধুরা পড়ায় সহায়তা চাইলে বা মাঝেমধ্যে পড়াশোনা করতে ইচ্ছা না করলে আমার পরিকল্পনাগুলো পরিবর্তন করতাম।’ মজার ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগে জোরকদমে পড়াশোনা করেন। অনুরাগের জন্য বিষয়টি ছিল একটু আলাদা।


বোর্ড পরীক্ষা শুরুর মাসখানেক আগে চাপ কমিয়ে পড়ার রুটিন তৈরি করেন অনুরাগ তিওয়ারি। এর কারণ, মানসিক চাপ কমিয়ে বেশি বেশি ঘুম। ফাইনাল বোর্ড পরীক্ষার বিরতির মধ্যেও ক্রিকেট খেলেছেন। কোনো পরীক্ষায় দু-তিন দিন বিরতি থাকলে তিনি ক্রিকেট খেলা ছাড়াও স্কুল লাইব্রেরিতে নিয়মিত বই পড়তেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর গানেও সময় কাটাতেন। অন্যকে কীভাবে পড়া শেখানো যায়, তার একটি দুর্দান্ত উপায় বের করা অনুরাগ বলেন, ‘কখনো কখনো বন্ধুদের পড়ায় সাহায্য করতাম, আর এটি আমাকে একটি বিষয় আরও ভালোভাবে জানতে সাহায্য করেছিল।’ শুধু যে বন্ধুদের সাহায্য করতেন তা নয়, নিতেনও। বন্ধু বা শিক্ষক, যাঁর কাছে যখন প্রয়োজন, পড়ায় সাহায্য নিয়েছেন। ক্লাসে কোনো কিছু না বুঝলে বন্ধুদের সহায়তা নিতেন।

বিদ্যাজ্ঞান একাডেমির খোঁজ কীভাবে

ভারতে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থী আছে, যাদের অনেকেরই অবিশ্বাস্য প্রতিভা রয়েছে। তবে এগুলো যথাসময়ে ‘খুঁজে পাওয়া যায় না’। অনুরাগের এক চাচাতো ভাই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অনুরাগকে জানান। আর বড় তিন বোন বিদ্যাজ্ঞানে ভর্তির প্রস্তুতিতে সহায়তা করেছিলেন।


২০১৩ সালের ৮ জুলাই অনুরাগ তিওয়ারি বাড়ি ছেড়ে সীতাপুরের বিদ্যাজ্ঞান একাডেমিতে পা রাখেন। সেখানকার পড়াশোনার রীতিনীতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে এবং ভবিষ্যতের জন্য ‘অসম্ভব’ স্বপ্ন দেখার পথ তৈরি করে দেয়। অনুরাগের ভাষ্য, ‘বিদ্যাজ্ঞানে পৌঁছে আমি জানতে পারি শিক্ষার অর্থ আসলে কী। এটি আমাকে নতুন কল্পনাশক্তি ও দূরের পথ দেখার দৃষ্টি দিয়েছে।’


বিদ্যাজ্ঞানের একটি পরিবর্তন দেখেছিলেন অনুরাগ তিওয়ারি। তাঁর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ ছিল না। তাঁর নতুন সহকর্মীরা পড়াশোনা অনেক পছন্দ করতেন। সেখান পড়ার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। শিক্ষক, বন্ধু ও সিনিয়রদের সহায়তায় অনুরাগ ভাষাটি রপ্ত করে ফেলেন। এখন বেশ সাবলীল ইংরেজিতে।

স্যাটের প্রস্তুতি ও ‘অসম্ভব’ স্বপ্ন

অনুরাগ তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন। এ সময়ের একটি সিদ্ধান্ত তাঁর বাকি জীবনকে অদ্ভুতভাবে বদলে দিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কলেজে–বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য স্যাটের (স্কলাস্টিক অ্যাসেসমেন্ট টেস্ট) জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলেন। এর পেছনে রয়েছে তাঁর ইংরেজি শিক্ষকের অনুপ্রেরণা। এ জন্য ওই শিক্ষককে ধন্যবাদও জানান বারবার।

‘কয়েকজন সিনিয়র, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়ছেন, তাঁদের সম্পর্কে তিনি আমায় বলেছিলেন। তখন থেকেই আমি স্যাটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। তাঁর প্রেরণার পর আরও বড় কিছু অর্জনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। বড়রা পরামর্শ দিতেন হাল না ছাড়তে। কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ হলে তা পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে উৎসাহ দিতেন তারা।’ বলছিলেন অনুরাগ। এর ফল অবশ্য অনুরাগ পেয়েছেন। স্যাটে ১৩৭০ স্কোর করেন, যা ৯০ শতাংশেরও বেশি।

কলেজশিক্ষার উজ্জ্বল প্রতিভা অনুরাগ তিওয়ারি শিগগিরই সম্পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে যাবেন ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তবে ছোট্ট গ্রাম থেকে পড়াশোনা করা ছেলেটির প্রথম থেকেই কর্নেলে পড়ার পরিকল্পনা ছিল না। অবিশ্বাস্য যোগ্যতা এবং স্যাটে দুর্দান্ত স্কোরই তাঁর গন্তব্য ঠিক করে দিয়েছে। এই স্কোরের অর্থ, তিনি বিদেশের যেকোনো একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বেছে নিতে পারেন। তবে বন্ধু, সিনিয়র ও শিক্ষকদের অনুপ্রেরণার কথা কোনো সময়ই ভোলেন না অনুরাগ।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনুরাগ তিওয়ারি বলেন, ‘গবেষণার সুযোগ, শিক্ষক-অধ্যাপকদের অবস্থান আমাকে কর্নেলকে বেছে নিতে সহায়তা করেছে। আমার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হিসেবে কর্নেলে আবেদন করেছিলাম গত বছরের ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে। ভর্তির যোগ্য হওয়ায় অন্য কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করিনি।’

কোভিডের কারণে অন্য সবার মতো অনুরাগও ক্ষতিগ্রস্ত। এ বছরের আগস্টে তাঁর কর্নেলে পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। ভিসার ইস্যু আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত। এ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে অনুরাগকে।

অর্থনীতি ও গণিত কেন বেছে নিলেন


অনুরাগের আগ্রহ সব সময় মানবিকের বিষয়গুলোর প্রতি। যদিও গণিত ও অর্থনীতি সহজ ব্যাপার নয়। তবে অনুরাগ এ জন্য হতাশ ছিলেন না। তিনি ঠিকই জানতেন কী চান এবং কেন চান। অর্থনীতির শিক্ষককে কৃতিত্ব দেন, তাঁরই পড়ার ধরনে এ বিষয়ে আগ্রহ তৈরি করতে সহায়তা করেছিল। অনুরাগ বলেন, ‘ক্লাসে শিক্ষক কেবল সিলেবাস শেষ বা এ সম্পর্কে কথা বলেননি, বর্তমান অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বুঝতে আমাদের সহায়তা করেছেন। আর আমি মনে করি, অর্থনীতির পড়াশোনা দেশকে সহায়তা করতে অবদান রাখবে।’

অনুরাগ তিওয়ারি গণিত পছন্দ করতেন। অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অর্থনীতির প্রতি আরও বেশি ভালোবাসা তৈরি হয়। এ জন্য কর্নেলে পড়াশোনার জন্য অর্থনীতি ও গণিতকে বেছে নেন। ভবিষ্যতে অর্থনীতিবিদ হতে চান অনুরাগ। ভারতে ফিরে দেশসেবা করতে চান। শিব নাদার ফাউন্ডেশনের মতো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সহায়তা করে তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সুযোগ চান অনুরাগ।

পরিবারের প্রতিক্রিয়া আসলে কেমন ছিল

গ্রামের কৃষক দম্পতির পক্ষে তাঁদের ছেলের সিবিএসইতে শীর্ষ নম্বর পাওয়া, পড়তে বিদেশে যাওয়া অবশ্যই স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
বাবা কমলাপতি তিওয়ারি ও মা সংগীতা তিওয়ারি ছেলের কৃতিত্ব শুনে প্রাথমিকভাবে হতবাক হয়েছিলেন। বাবা চেয়েছিলেন অনুরাগকে সফল ছেলে হিসেবে গড়ে তুলতে। কিন্তু অনুরাগই তাঁর বাবাকে সফল বাবার তকমার জন্য যোগ্য করেছেন।


তিন বোনই—প্রতিভা, শিল্পী ও প্রবীণ—অনুরাগ তিওয়ারির বড়। তাঁদের অবদানও কম নয়। প্রথমে বিদ্যাজ্ঞান একাডেমিতে পাঠানোর জন্য মা–বাবাকে রাজি করানো এবং পরে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেরণাও বোনদের কাছ থেকে পান অনুরাগ। বোনেরা ভাইকে সম্পূর্ণ আলাদা পৃথিবীতে পা রাখার বিষয়ে আগ্রহী করে তুলেছিলেন।


শিক্ষা কীভাবে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিল

বিদ্যাজ্ঞান একাডেমিতে পড়াশোনাই অনুরাগের জীবনযাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমন এক পথে তাঁকে নিয়ে গিয়েছে, যা আগে কল্পনাও করতে পারেননি অনুরাগ।


অনুরাগ তিওয়ারি বলেন, ‘বিদ্যাজ্ঞানে আমি যা শিখেছি, তা কেবল নম্বরের দিকে ছোটা নয়, ডিগ্রি অর্জন নয়; বরং এটি একটি ভালো জীবনযাপনের পথ বাতলে দেওয়া শেখায়। কীভাবে পা মাটিতে স্থির রাখতে হয় এবং সর্বদা শিকড়ের স্মরণ রাখতে হয়, তাও শিখিয়েছিল। শিক্ষা আমাদের স্বাবলম্বী হতে এবং আমাদের যা আছে তাতে খুশি থাকতে শেখায়। কীভাবে সীমাবদ্ধ সুযোগকে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হয়, শিক্ষকেরা আমাদের তা শিখিয়েছিলেন। কীভাবে সাফল্য উপভোগ করতে হয় এবং মনোযোগ ধরে রাখতে হয়, তাও শিখিয়েছিলেন শিক্ষকেরা।’

সৌজন্য : ইন্ডিয়া টুডে

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়