Ameen Qudir

Published:
2017-01-25 22:43:40 BdST

অতএব প্রমানিত হইলো-চিকিৎসকের প্রাণ হইতে হাতের লেখাই গুরুত্বপূর্ণ


 

 

ডা. রোকন জামান
_________________________
(কাল থেকেই খুব মন খারাপ ছিলো। কারনটা পরে বলছি।)

দুপুর দুইটা : সাতদিন ধরে আমাদের ওয়ার্ডে এক রোগী ভর্তি ছিলেন । চল্লিশ বছরের মহিলা। বমি নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রোগ ধরা পড়লো, সাইকোজেনিক ভমিটিং ;মানসিক কারনেই এই বমি। রোগ ধরা পড়ার পর চিকিৎসা দিলে রোগী ভালো হয়ে গেলেন। আজকে রাউন্ডের পর ছুটি দিলাম।
...বেলা দুইটার দিকে রোগীর এক আত্মীয় হাজির।
এসেই আবদার জুড়ে দিল -আজকে রোগীকে ছুটি দিয়েন না।

কেন?
-আজকে খুলনায় আমাদের এক বিয়ের অনুষ্ঠান আছে। শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আজ রাতটা একটু রেখে দেন। কাল ছুটি দিয়েন .............লোকটাকে দেখে বেশ হোমরাচোমরাই মনে হলো। হাতের মোবাইলটার দাম কমপক্ষে তিরিশ হাজার হবে।
বড়ই আজব জাতি আমরা।এতো এতো গোল্ডেন জিপিএ দিয়ে আমরা আসলে কী করছি ? আমরা তো এখনো হাসপাতাল আর হোটেলের মাঝে পার্থক্যই শিখতে পারলাম না!!

দুপুর একটা : কিছু স্টুডেন্ট এসেছে। কথা বলছি। এমন সময় হাজির আমার এক দুর সম্পর্কের নিকটাত্মীয়। .....


তার মেয়ের ব্রেস্ট এ্যাবসেস হয়েছে। গতকাল আউটডোরে সার্জারি বিশেষজ্ঞ দেখালে তিনি ভর্তি হতে পরামর্শ দেন। রোগীরা ভর্তি করাতে চাননি। কারন- চক্ষু লজ্জা। আঠারো বছরের মেয়ে। ভর্তি হওয়ার পর পুরুষ ডাক্তার দেখবে। ....ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছিলেন। তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসে এক দালাল। বলে -সামনে চলেন। চুলপাকা, বাপের বয়সী এক ডাক্তার আছে। ...উনি বাইরে যেয়ে এক হাতুড়িকে দিয়ে অপারেশন (!)করিয়েছেন।

 

জিজ্ঞেস করলাম-যে লোককে দিয়ে মেয়েটার সর্বনাশ করেছেন তার বয়স কত?
বললেন -চল্লিশোর্ধ।
ভালো। তা অপারেশন তো করিয়েছেনই। আমার কাছে এসেছেন কেনো?
-কাটা জায়গা দিয়ে সারারাত পুঁজ আর রক্ত পড়েছে।
-আজকে কি ভর্তি হবো?

আমি আর কথা বলার শক্তি পেলাম না।
বললাম - আর দশ বছর পরে আসেন।আমাদের সবচেয়ে সিনিয়র সিএর বয়স এখনো মধ্য তিরিশেই আছে। .....

......
দুপুর বারোটা : চেম্বারে এক রোগী দেখেছিলাম সাতদিন আগে । থাইরয়েডের পরীক্ষা করাতে বলি মেডিকেল কলেজে।
অন্তত দশ মিনিট বুঝিয়েছিলাম। মেডিকেলেই করাবেন, দালালদের পাল্লায় পড়বেন না। ........আজ রিপোর্ট এনেছে। দেখলাম এক চরম নিম্নমানের ডায়াগনস্টিক থেকে রিপোর্ট করিয়েছে।কথা বলে বুঝলাম এক বাটপারদের পাল্লায় পড়ে ...... .......

সঙ্গে রোগীও আছেন। উনার স্ত্রী।
জিজ্ঞেস করেই বসলাম -ইনি কি প্রথমজন?
উনি কাচুমাচু করে বললেন -জ্বী ইনিই প্রথম। উনি কিছুই না বুঝে বললেন -এখন কী চিকিৎসা দিবেন স্যার?

বললাম -কিছুই লাগবে না।

কেন স্যার?
-বৌটা খুব ভালো। বাড়ি যেয়ে টানা সাতদিন বিশ্রাম দিবেন, আর খালি আদর যত্ন করবেন! তারপর চিকিৎসা।


ঝাড়া দশমিনিট বুঝিয়ে বলে , লিখে দেয়ার পরও যে লোক দালালের এক কথাতেই বাইরে চলে যায়, তার যে বৌটা এখনো টিকে আছে,স্বামী সেবা -সংসার সবই করছে, তাকে আর তিতা ওষুধ খাওয়ায়ে কস্ট দিবেন ক্যান?

সকাল দশটা : বড় ভাইয়ের বন্ধুর স্ত্রী আসলেন। দুইমাস আগে তার ছেলেকে দেখে কিছু ওষুধ দিয়েছিলাম। আজকে এসেছেন ওষুধ খাওয়াবে কিনা জানতে।
এতদিন কি করেছেন?
;দোকানে ওষুধ কিনতে গেলে দোকানি বলেছে :পাঁচশো পাওয়ারের ওষুধ বাচ্চাকে খাওয়াবেন? সেই ভয়ে আর খাওয়াইনি। ...তারপর তিনজন হোমিও দেখাইছি।
-এখন কি আপনার আগের ওষুধ খাওয়াবো?
........এসব শুনলে আগে রাগ করতাম। এখন করিনা। আর বড় ভাইয়ের ছেলেবেলার বন্ধুর স্ত্রী বলে কথা!

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করে বসলাম -কবিরাজ দেখাননি? বললো- এলাকায় তেমন ভালো কবিরাজ নেই, তবে মনিরামপুরে নাকি একজন ভালো কবিরাজ আছে।
যাব নাকি? ...

আমি কথা বাড়ানোর যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেলাম। বললাম তাহলে দেরী না করে কেশবপুরেই একটু পাত্তা লাগান .....
---------------------------------

ডাঃ সুমন শিকদার।।ওর ব্যাপারে সম্প্রতি জেনেছি। খুলনা মেডিকেলের সাবেক একজন ছাত্র, বর্তমান সরকারের একজন বিসিএস কর্মকর্তা। সাতদিন নিখোঁজ থাকার পর তার ডেডবডি মিলেছে। মর্গে।এটা নিয়েই মনটা খুব খারাপ ছিলো।
এখন মনটা ভালো হয়েছে বিএমএর শোকবার্তা সম্পর্কিত মেসেজ পেয়ে! যাক এই গরীব দেশের মেধাবী একজন সরকারি কর্মকর্তা ও চিকিৎসক লাশ হওয়ায় সরকারের টনক না নড়লেও বিএমএর তো বেশ একটা টনক নড়েছে। নইলে কি আর মেসেজ পাঠায়?
ডাঃ সুমন, তোমার বড় কপাল!!

ডাঃ সুমন শিকদার।যেদিন তোমার ডেডবডি মিলেছে সেদিনই আদালত রুল জারি করেছে, চিকিৎসকদের পড়ার উপযোগী সুন্দর হাতের লেখায় স্পস্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লিখতে হবে।যে দেশে সব পিএইচডি ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিত ফার্মাসিস্টরা তোমার বাজে হাতের লেখা বুঝতে না পেরে সব রোগী মেরে ফেলছে সেই দেশে তোমার মতো কষাইরা কেন বেঁচে থাকবে? তোমাকে নিয়ে তো এখনো কেউ কিছু ভাবছেনা।
তবে আমি ভাবছি -কিভাবে মরলে তুমি?
সাপের কামড়ে, নাকি ভুতের ভয়ে?
-----------------------------------

এদেশ দালালের, প্রাইমারী পাশ ফার্মাসিস্টের, এদেশ এইট পাশ কোয়াকদের, এদেশ কাজে ফাকি দিয়ে ক্লিনিকের মালিক হওয়া ওয়ার্ড বয়দের।এদেশ কবিরাজদের, হোমিওদের।
এদেশ ফুলের মতো চরিত্রের রাজনীতিবিদের, সাংবাদিকদের।
এদেশ এভারেজ দ্বিতীয় শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র -প্রশাসনিক কর্তাদের,আমলাদের ।
এদেশ পুলিশের।বালিশের ....।এদেশ কোটি টাকার রাস্তার সত্তর লাখ খেয়ে ফেলা কন্ট্রাকটরদের........

এরা সবাই একএকটা রত্ন! এদেশ রত্নগর্ভা!
এদের নিয়েই তো আমরা মহাসুখে আছি। এদের নিয়ে সরকারের কোনো অভিযোগ নেই। আদালতের মাথাব্যথা নেই। সাংবাদিকদের লেখালেখি নেই।
এদেশের যতো মাথাব্যথা সব তো ডাক্তারদের নিয়েই!

এতো এতো রত্ন, মনিমুক্তোর ভীড়ে কুলাঙ্গার তো ডাক্তাররাই। নয় কি?

_______________________________

ডা. রোকন জামান। সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়