SAHA ANTOR

Published:
2020-07-09 01:38:05 BdST

অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর


 


অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল
____________________

আমাদের খাসলতের জন্য বাংলা ভাষার বাগধারা আর প্রবচনগুলো এমনিতেই বিশ্রামের সুযোগ তেমন একটা পায়না।তারপর এই করোনাকালে আমাদের কীর্তিমান স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের একের পর এক হটকারীতায় ওগুলো সব এক সাথে তেড়ে ফুঁড়ে বেরোচ্ছে।
জে কে জি’র ক্ষতে একটু টান ধরতে না ধরতেই রিজেন্টের দগদগে ঘা যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা।
গত কয়েক মাস ধরে রাজনীতির মাঠ এক রকম উত্তাপহীন,খেলার মাঠের ঘাসগুলো বড় হতে হতে এখন আগাছার পর্যায়ে,বিনোদন জগৎও হাই তুলছে,ব্যবসা-বানিজ্য শেয়ার মার্কেটেও ঝিম ধরা ভাব।
তাই এবছরের শুরু থেকেই খবরের সবচাইতে বড় যোগান দাতা আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় আর অধিদপ্তর আর ব্যবসার একমাত্র রমরমা মূল কেন্দ্র তেজগাঁও সাত রাস্তার মোড়ের সিএমএসডি।
অবশ্য একথা মানতেই হবে গত কয়েক মাসে বিনোদন ওনারা খুব একটা কম দেননি।
মন্ত্রী-ডিজির বেফাস কথা, দুপুরের করোনা বুলেটিনের সংখ্যাতত্ত্ব, ডাক্তারদের মাস্ক-সুরক্ষা সামগ্রীর ভেল্কী, বিশ কোটি টাকার রুটি-কলার মচ্ছব প্রভৃতি।
আর এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন জে কে জি আর রিজেন্ট।
এর আগে আপাত আটপৌরে ‘জে কে জি’-জোবেদা খাতুনের সাদা-মাটা নামের আড়ালে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার নামে প্রতারনার আশ্রয় নিতে পারে, সেটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী আর চেয়ারম্যানের মাথায় থাকলেও সাধারন মানুষের কল্পনাতেও ছিল না।
এই তো সেদিন এক বিখ্যাত টিভি চ্যানেলের লাইভ শো-তে তীতুমীর কলেজ বনাম জে কে জি প্রশিক্ষনার্থীদের মাঝে হামলা-মামলা অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ নিয়ে কথা শুনছিলাম। অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা আর অতিথি সাংবাদিকদের প্রশ্নবানে তীতুমীর কলেজের প্রতিনিধি সম্ভবত উপাধ্যক্ষ যে ভাবে জর্জরিত হচ্ছিলেন তাতে জে কে জির পক্ষের চেয়ারম্যান/কনভেনার, দেশের প্রথম মহিলা কার্ডিয়াক সার্জনের দাবীদার ম্যাডামকে তাঁর সুশ্রী মুখাবয়ব প্রদর্শন ছাড়া তেমন কিছু করতে হয়নি।
অবশ্য তাদেরই বা দোষ দেই কিভাবে? করোনা পরীক্ষায় তখন চলছে মহা সংকট, শাহবাগে বিএসএমএমইউ-এর ফিভার ক্লিনিকের সামনে লম্বা লাইন, রিপোর্ট পেতে পাঁচ-সাত দিনের অপেক্ষা। তার রিপরীতে ঢাকা-নারায়নগঞ্জের ৪৪টা স্যাম্পল সংগ্রহ বুথে স্বেচ্ছাশ্রমে প্রতিদিন তিন-চারশো পরীক্ষার আপাত মানবিক কাজের জন্য জে কে জি তখন তো একরকম দেবতুল্য। কিন্তু আরিফুল-সাবরীনার উজ্জ্বল চেহারার পেছনের অন্ধকারাচ্ছন্ন অপরাধ ভাবনার আসল চেহারা দেখা তখনও বাকী। ভুল রিপোর্ট, পরীক্ষা না করেই ইচ্ছামত রিপোর্ট, আর বাড়িতে গিয়ে স্যাম্পল সংগ্রহের নামে লক্ষ কোটি টাকা লোপাটের নোংরা মানসিকার কথা না হয় বাদই দিলাম।
কিন্তু প্রকৃত পজিটিভকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে নেগেটিভ বানিয়ে তাকে করোনা ছড়ানোর চলমান বিভিষিকায় পরিনত করে যে অন্যায় তারা করেছেন তার প্রতিকার আর প্রায়শ্চিত কোন পেনাল কোড আর ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে ?
আর আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের কুম্ভকর্ণরা এখনো দুপুরের বুলেটিনে হাজিরা দিয়েই দায় সারছেন। সাংবাদিকরা ঘাম ঝরানো কষ্টে এসকল অপকর্মের সত্যান্বেষন করার পর উনারা(স্বাস্থ্য বিভাগ) এই অপকর্মের হোতাদের শুধুমাত্র করোনা স্যাম্পল কালেকশনের অনুমতি বাতিল করেই যুধিষ্ঠির বনে যান।
‘জে কে জি’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে আরেক দফা অর্থ আত্মসাত আর সুরক্ষা সামগ্রী হাপিশ করার ঘটনা শীর্ষ কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই তাদের সহজাত ঔদার্য্যে পুরোপুরি ভুলে যাবেন- কারন ভূত তো সর্ষের মধ্যেই।
আর ‘রিজেন্ট হাসপাতাল’! করোনা চিকিৎসায় রোগীর চাপে কুর্মিটোলা আর কুয়েত মৈত্রীর যখন হাস-ফাঁস অবস্থা তখন দৈব আশীর্বাদের মত আবির্ভাব এদের। উত্তরায় মানুষের শত প্রতিবাদ উপেক্ষা করে করোনা চিকিৎসায় হাত বাড়িয়ে উনারা সাধারন মানুষের নামাজ শেষের দোয়ায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ বজ্রপাতের মত এ কী দেখলাম গতকাল? আমাদের সব বিশ্বাসকে এভাবে বার বার ভেঙ্গে তছনছ করার অধিকার কে দিল আপনাদের? রিজেন্টের চেয়ারম্যান ভদ্রলোকের চেহারা টেলিভিশনের সুবাদে অনেকের কাছেই পরিচিত। প্রায়ই জ্ঞানগর্ভ নসিহত শুনতাম। সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ-অতি ভক্তির নেপথ্য কারণ দেখার তখনও অনেক বাঁকী। সেই আপত নির্ভেজাল মানুষগুলো যখন আরেকবার করোনার মত প্রাণঘাতী রোগের রিপোর্ট জালিয়াতী আর রোগী আটকে টাকা আদায়ের মত নির্মমতায় নিজেদের নামিয়ে আনেন তখন তাঁদের জন্যই করুনা হয়।
আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু আপনার পরিজন-সন্তান-তাদের সামনে আপনার এতদিনের পরিচিত দেব তুল্য চেহারা যখন অকস্মাৎ একটা নরপশু-পিশাচের প্রতিচ্ছবিতে পরিনত হয়, তখন-? রিজেন্টের সাথে সরকারের চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ব্যত্যয়, প্রথমত কথা ছিল তাঁরা পরীক্ষা করবেন বিনা পয়সায়, প্রায় ৪ হাজার পরীক্ষা তারা সরকারী ল্যাবে বিনে পয়সায় করিয়েছেন অথচ ভূয়া রিপোর্টে ‘লক্ষ লক্ষ টাকা’ হাতিয়েছেন সেবা গ্রহীতার কাছে। দ্বিতীয়ত, ২০০ রোগীকে বিনা পয়সায় চিকিৎসার নামে স্বাস্থ্য অদিপ্তরে প্রায় ২ কোটি টাকার বিলের তদবির চলছে। অন্যদিকে তাদের প্রত্যেকের কাছে লক্ষ টাকার বিল আদায় হয়েছে। অবাক করা বিষয়, ২০১৪ সালে মেয়াদ শেষ হওয়া এই হাসপাতালের সাথে খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চুক্তি করছে ২০২০ সালে।
ফেসবুকের কল্যানে কাল থেকে রিজেন্টের সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঐতিহাসিক চুক্তির ছবিটা দেখার সুযোগ হচ্ছে বার বার।
রিজেন্টের শাহেদ সাহেব কে ঘিরে মন্ত্রণালয় আর অধিদপ্তরের চেনা বিনোদন শিল্পীদের সারিতে এমন ছবিও আছে যিনি আজকে অন্তত সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেন ‘ধরনী দ্বিধা হও’।

এতসব কিছুর পরেও কি প্রশাসন, সরকার নীতি নির্ধারকরা চুপ করেই থাকবেন? আইন বিচার কি করবে,কতটা করবে,সেটা নিয়ে আমার মত আশাবাদী সম্ভবত বেশীর ভাগ মানুষই নন।
আমি ভাবছি আরেক আঙ্গিকে। আমাদের করোনা রিপোর্ট ইতোমধ্যে জাপান-অষ্ট্রেলিয়া ডাষ্টবিনে ফেলেছে- এখন তালিকাটা আরো লম্বা হবে। ফলাফল?
আমাদের দেশের সরকারি বেসরকারি সকল করোনা রিপোর্টের (এমনকি অন্যান্য মেডিকেল রিপোর্টের প্রতিও) প্রতি বিশ্ব-সমাজের অনাস্থা। আন্দাজ করুন এই অনাস্থার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধাদের ফিরতি যাত্রা অনিশ্চিত হবে- ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ছাত্ররা প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
আমেরিকায় ফিরতী প্রবাসীরা ইমিগ্রেশন কাউন্টার অতিক্রম করতে পারবেন কি না জানিনা। একই অপরাধে গার্মেন্টস রপ্তানী আরেকবার দর পতনের ধাক্কায় পরবে কিনা? কাঁচা সবজী হিমায়িত পণ্য কার্গো বিমানের কন্টেইনারে জায়গা পাবে কি না?

এত হতাশা আর বিশ্বাস ভঙ্গের আবহে বাঁচার আলোকরশ্মী তো চাই- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগ্য প্রতিস্থাপনের কোন বিকল্পই কি নেই? যোগ্য-দলবাজ-তেলবাজ নয়।
‘জে কে জি’ কিম্বা রিজেন্ট ছাড়া বুক চিতিয়ে সত্য বলার মত কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কি নেই দেশের কোথাও? যাঁরা বুক চিতিয়ে বলতে পারে আসুন দেখুন- এই পঙ্কিলতার মাঝে আমরা আজও আছি ক্লেদ মুক্ত! লুকাবেন না কোন কিছু! বগুড়ার টিএমএসএস হাসপাতাল, সাভারের এনাম কিম্বা চট্টগ্রামের ইমপেরিয়াল বা খুলনার গাজী-আদ্ দ্বীন অথবা অন্য কেউ!
দয়া করে হতাশ করবেন না জি কে জি’র মত। আপনারা কি সাহস করে বলবেন- আমাদের সদর অন্তপুর অবারিত। আমাদের করোনা রিপোর্টের আইডি নির্ভেজাল, স্বাক্ষর জাল নয়। আমাদের পিসিআর ল্যাব যথাযথ ভাবে স্যাম্পল পরীক্ষা করেই রিপোর্ট দেয়।
পরীক্ষার পর স্যাম্পল গুলো বিপজ্জনক বর্জ্য হিসেবে হেলা ফেলায় আস্তাকুড়ে ফেলে না! বলুন আপনারা কত টাকায় কোন সেবা দেন।
রোগী আটকিয়ে টাকা আদায় করেছেন কি না? বলুন সবাইকে-। বলতেই হবে কাউকে না কাউকে নইলে সাধারণ মানুষ, আমার সেই পূর্ণ পিপিই, আর টাইট মাস্ক-গগল্স পরা হাঁসফাঁস গরমে ১২ ঘন্টা ডিউটি করা তরুন স্বাস্থ্যকর্মীর একটা বিশ্বাসের জায়গা তো চাই, নইলে করোনা আক্রান্ত আমাদের তরুন চিকিৎসক যোদ্ধা আইসোলেশন কক্ষে মাঝরাতে নির্ঘুম অপলক তাকিয়ে থাকবে মামুলী পালস অক্সিমিটারের কালো এলইডি প্যানেলের কম্পনাল নীল সংখ্যার দিকে, ওটা ৯৩-৯৪ এর ঘরে নেমে এলে নিজের অজান্তেই ওর বুক কেঁপে উঠবে, ওর বাড়ীতে বাবা- মা- শিশু সন্তান আর স্ত্রী- অসময়ে মৃত্যুর বিলাসিতা ওকে মানায় না।

বিবেকবান মানুষেরা- খুব বেশী দেরী হবার আগেই কিছু একটা করুন।

অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল
প্রাক্তন অধ্যক্ষ
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া এবং দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর;
এবং সাবেক সভাপতি, সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশ।
ই-মেইল: [email protected]
মোবাইল নং- 01711869325

________________INFORMATION___________________

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়