রাতুল সেন

Published:
2020-07-04 19:36:19 BdST

‘ভুল- সবই ভুল'



অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল

__________________________


 
'অতল জলের আহ্বান' সত্তর দশকের শুরুর দিকের বাংলা সিনেমা।
সুজাতা চক্রবর্তী গায়িকা হিসেবে অপরিচিতই বলা চলে- গানও খুব বেশী গাওয়া হয়নি। কিন্তু ঐ ছবিতে তাঁর গাওয়া একটা গান নিয়েই আজকে কথা বলতে ইচ্ছে করছে-
মনে হচ্ছে এই করোনা কালে আমাদের জীবনের আত্ম বিশ্লেষনের জন্য গানটা যেন নতুন করে শুনছি।
পঞ্চাশ বছর আগে তাঁকে দিয়ে এই গানটি গাইয়েছিলেন- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়!
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন ‘‘ভুল- সবই ভুল'’,
এই গানটির কথাই বলছিলাম। আজ করোনার এই মহামারীকালে সেই ভুলের হিসেব যেন নতুন করে সামনে এলো।
অন্য কাউকে নিয়ে কিছু বলার আগে নিজেকে নিয়েই শুরু করি।
মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি- কতটা চিনি আমি নিজেকে?
খুব স্থুল ভাবে বলি- আমি নিজেকে কি দেখেছি কখনো? আরে ঠিকই তো,নিজেকে তো আমরা কেউ দেখতে পাইনা! আমাদের দেখে অন্যরা,আমি দেখতে কেমন, সেটা তো আমার কখনোই জানা হবে না।
আমি নিজেকে দেখি বিজ্ঞানের ক্যামেরায়,পারদের প্রলেপ দেওয়া আয়নায়।
ওরা যেটা দেখায় সেটাই কি আমি?
নিজ চোখে নিজেকে দেখা সে তো অসম্ভব, তাই না?
ঐ গানেই কিন্তু একটা পংক্তি আছে; ‘প্রশ্ন করি নিজের কাছে, কে আমি?’
হ্যাঁ, কাগজে কলমে আমি একজন অধ্যাপক,চিকিৎসা বিজ্ঞানের।
ছোট বেলায় আম চুরি কিম্বা পুষ্প অপহরনের মতো ভালো মানুষী চৌর্যবৃত্তির বর্ণনায় নিজেকে দস্যু বনহুর কিম্বা দস্যু মোহন বানানোর ভন্ডামি থাক। স্কুল জীবনে ক্লাশ পালানো, বন্ধুর পকেটে আরশোলা ঢোকানো কিম্বা বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে উদ্দেশ্যপূর্ণ ঘোরঘোরির নির্জলা বর্ণনাও না হয় তোলা থাক।
মেডিকেল কলেজ জীবনে প্রাকটিক্যাল খাতার ছবি অন্যকে দিয়ে আঁকানো, হিস্টোলজীর স্লাইড চেনার বিকল্প পদ্ধতির উদ্ভাবন কিম্বা বান্ধবীদের উত্ত্যক্ত করনের মত আপাত গর্হিত কাজের উপাখ্যানও না হয় এযাত্রায় বাদ থাকলো।
কিন্তু চিকিৎসক হবার পরের বিচ্যুতিগুলো কি এতটাই শিশুতোষ?
সার্জারী বিভাগের সহকারী রেজিষ্ট্রার থাকার সময় সব জরুরী অপারেশন সময় মত করতে পেরেছি কি?
অপারেশন পরবর্তী সময়ের তদারকী নিশ্ছিদ্র ছিল কি? আত্মবিশ্বাসে বলতে পারবো কি, তদবীরে পরাজিত হয়ে নিয়মিত অপারেশনের তালিকা এদিক ওদিক করিনি কখনো? রেজিষ্ট্রার হবার পর প্রস্তুতি ছাড়াই ছাত্রদের ক্লাসে হাজির হই নি কি কোনো দিন? ওদের ক্লাসে না জানা প্রশ্নের উত্তরে বানিয়ে বানিয়ে গোঁজামিল দেইনি কি কখনো?
শিক্ষক-পরীক্ষক হবার পর, লিখিত পরীক্ষার সবগুলো উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় সমান একাগ্রতা ছিল কি? মৌখিক পরীক্ষার সময় শতভাগ নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছিলাম কি?
টেন্ডার কমিটির সভায় স্বাধীন সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছি কি সবসময়?
এমনি হাজারো প্রশ্নের সামনে নিজেকে দাঁড় করালে নিশুতি মাঝ রাতের বিশুদ্ধতায় যে সত্য উচ্চারিত হয় আজ সে সত্যটাই অসহায় দীর্ঘশ্বাসের জনারন্যে বলি, এতগুলো আত্মজিজ্ঞাসার একটাই সংক্ষিপ্ত জবাব- ‘না’।

কেউ কেউ পাল্টা প্রশ্ন ছুড়তে পারেন, তাহলে ঠিক কোন কিছুই কি কখনো করিনি?
হ্যাঁ, করেছি,অজস্র বার করেছি। কিন্তু সেটা হলো আত্মবিশ্লেষন, আত্মজিজ্ঞাসা নয়।
শুধুমাত্র আটটা-আড়াইটা কিম্বা নয়টা-পাঁচটা অফিস করে আমি দেশকে এমন কিছু কৃতার্থ করিনি।
আবার হাজার ভালো কাজ করেছি বলেই তাদের ভিড়ে আমার এই নগণ্য আত্মজিজ্ঞাসা নেহায়েত পানসে হয়ে যাবে- এমন দায় মুক্তিও অপ্রয়োজনীয়-অপ্রাসঙ্গিক।

আমার এই উত্তর শুনে কোন আমলা, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ কিম্বা সাংবাদিক ‘এই তো পেয়েছি’ বলে লাফিয়ে উঠবেন না যেন।

একটু সবুর, আপনাদের জন্যও আমার কিছু প্রশ্ন আছে।

জনাব প্রকোশলী মহোদয়, সারাজীবন সবকটা প্রাক্কলন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে অনুমোদন করেছেন তো? ব্রীজের রড বাইন্ডিং কিম্বা বিল্ডিং এর ছাদ ঢালাইয়ের সময় সরেজমিনে উপস্থিত থেকে শতভাগ মান নিশ্চিত করেছেন তো?
দিনশেষে ঠিকাদারের মোটা খাম ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন নিশ্চয়ই?

প্রশাসনের কর্মকর্তারা আপনাদেরও বলি,- একটা যৌক্তিক ফাইল মাসের পর মাস আলমারীর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কোন দিন বন্দি করে রাখেন নি ? তাই না?
তথাকথিত উপরের অন্যায় টেলিফোনে আপনার বিশাল ছাতির নীতিবোধকে কোনদিন বিসর্জন দেন নি? ঠিক না? সবসময় নিজ থেকে জন মানুষের সাথে মিশে তাদের জিজ্ঞাসার আগেই সব সমস্যার সমাধান তাৎক্ষনিকভাবে করেছেন, তাই না?

ব্যবসায়ী শিল্পপতি- আপনারাই বা বাদ যাবেন কেন ? আপনারই তো আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন।
অতি নগন্য আমরা আপনাদের চোখে।
মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম, টরেন্টোর বেগম পাড়া, পানামা পেপারস এসবই তো মিথ্যা প্রপাগান্ডা, কি বলেন?
ঋণ খেলাপী, ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়া, শেয়ার বাজারে লক্ষ লক্ষ গরীবকে পথে বসানো এসবের সাথে তো আপনাদের নিশ্চয়ই কোন সম্পর্ক নেই? গুদামে চাল মজুদ, রোজা আসলেই পণ্য মূল্য আকাশ ছোঁয়া করে ফেলা, ভেজালের নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন এসব কিছুুই তো ডাহা মিথ্যা ? ঠিক বলছি তো?

ভাই রাজনীতিবিদ- আপনাদের কথা আর কী বলি,
আপনারা তো আবার দেবতুল্য, দেখুন না বাংলা ভাষার যত উপাদেয় বিশেষণগুলো সবই আপনাদের জন্য বরাদ্দ।
জন মানুষের নেতা, মাটি ও মানুষের নেতা, নির্যাতিত নেতা, সৎ ও নির্ভিক, গরীবের বন্ধু, বড় লোকের যম, ফুলের মতো পবিত্র, অমুক বন্ধু-তমুক বন্ধু- সে এক মহাকাব্য।
পত্রিকায় আপনাদের প্রায় এটা চোর, সেটা চোর এসব আপত্তিকর কথা বলে, এসব কি ঠিক?
আপনাদের আলমারীতে বস্তা ভরা টাকা, চৌকির তলায় সয়াবীন তেলের সুইমিংপুল , ড্রয়ার খুললে এফ ডি আর এর বন্যা, এ্যাটাচী কেসে ক্রেডিট-ডেবিট কার্ডের ছড়াছড়ি, টেবিলের উপর অযত্নে পড়ে থাকা ডজন ডজন চেক বইয়ের সারি- এসবই তো ক্যামেরার কারসাজি- ফটোশপ। ঠিক বললাম তো?
বিকেলে কোন এক প্রাইমারী স্কুলের টয়লেট উদ্বোধন করবেন বলে, রোদ ঝড় বৃষ্টিতে শত শত শিশুকে সকাল থেকে লাইনে দাড় করানোর মত অর্বাচীন নেতা আপনি নিশ্চয় নন? নির্বাচনের আগে ভাঙ্গা মোটর সাইকেল চালানো এক পাতি নেতা, যে কিনা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই প্রাডো-পাজেরো, গুলশানের ফ্ল্যাট, উত্তরার প্লট, সিঙ্গাপুরের স্যুট, প্যারিসের পারফিউম, বৌ এর নামে পাঁচটা কোম্পানী- সাতটা ট্রলার- আরো কত কিছু ? এই নেতা তো আপনি নন নিশ্চয়ই?

সাংবাদিক ভায়েরা- আপনারা তো আবার জাতির দর্পণ। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলাই আপনাদের ব্রত, জীবনের শিক্ষা।
হলুদ সাংবাদিকতা, রঙীণ সাংবাদিকতা এসব কিছুই তো ফালতু- রাবিশ, কি বলেন? অর্থের বিনিময়ে কারো চরিত্র হনন আর সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য আসল বিচারের আগেই মিডিয়া ট্রায়ালের দায় নিশ্চয় আপনার উপর চাপানো উচিৎ না, তাই তো?
যত চাপই আসুক সত্য প্রকাশে অবিচল- আপনিই তো ?
জন ধিকৃত কাউকে টেলিভিশনের পর্দায় এনে কৌশলে তার সাফাই গাওয়া আর দায় মুক্তির প্রচেষ্টার অভিযোগ আপনার উপর চাপালে তো বিরাট অন্যায় হবে, ঠিক না?
রাজনৈতিক বিভাজনের ধার না ধেরে সত্য প্রকাশের বিবেকবদ্ধতাকে সবসময়ই উঁচুতেই রেখেছেন তো, তাই না?
অপকর্মের নিউজ আইটেমকে ব্ল্যাক মেইলের অস্ত্রে পরিণত করার অপবাদ নিশ্চয়ই আপনার জন্য নয়?

আর বুদ্ধিজীবি- ওরে বাপ রে বাপ, আপনাকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস কোথায় আমার?
ভাবতেই পিঠের পেছনে দর দরে ঘামের শীতল-স্রোত মেরুদন্ড বেয়ে নীচে, আরো নীচে- ওখানকার হলুদ রঙের দুর্গন্ধযুক্ত আরেক তরলের সাথে একাকার।
করোনা কালে আবার হঠাৎ করে বুদ্ধিজীবিদের উৎপাদন বেড়েছে আশঙ্কাজনক,
করোনা থেকে যে যত দূরে সেই তত বড় বুদ্ধিজীবি।
শুনেছি দেশ-রাষ্ট্র-পৃথিবী-সমাজ এসবের চিন্তায় অনিন্দ্রা আপনাদের নিত্যসঙ্গী।
তাই কোন এক নিশুতি মাঝরাতে যখন ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর ছাড়া সবাই ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন তখন,ঐসব চিকিৎসক-প্রকৌশলী-সাধারন প্রশাসন-নিরাপত্তা প্রশাসন-ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদদের সাথে আপনিও জনাব বুদ্ধিজীবি নিজের বিবেকের আয়নার সামনা- সামনি হোন, অন্তত একবার,এই করোনা কালে যখন জীবন এতটাই অনিশ্চিত। জিজ্ঞেস করুন সেই পুরাতন প্রশ্নগুলো- এগুলোর জবাব যদি হ্যাঁ হয়- তাহলে তো অনিদ্রা আপনার ত্রি-সীমানাও ঘেঁষবার কথা নয়, আর যদি উত্তর হয় ‘না’ তাহলে আমি আর কী বলবো।
আপনার স্কুল পড়ুয়া সন্তানকে জিজ্ঞেস করুন। আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। আপনারাই তো বইয়ের পাতা ভর্তি করেছেন ‘সুবচন’ দিয়ে। আপনারাই তো বলছেন শিশুদের ‘হ্যাঁ’ বলুন। তাহলে আপনারাই বা ‘না’ থেকে আপনার উত্তর ‘হ্যাঁ’ তে আনতে পারবেন না কেন?
দেখুন না একবার- অন্তত একবারের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করে, দেখবেন রাতারাতি পুরো দেশটা কেমন পাল্টে গেছে।

আজ এই করোনা যুদ্ধের মাঝামাঝি যদি এত দিনের সালতামামি করতে চাই তাহলে দেখবো চারিদিকে শুধু ভুল আর ভুল।
স্বাস্থ্য বিভাগের অতি আত্মবিশ্বাসের ভূল,আমাদের দেশে করোনা আসবেইনা এমন অর্থহীন আত্মবিশ্বাস গলা ফাটিয়ে জাহির করার ভূল,
একটি মাত্র পিসিআর ল্যাব আর দুই হাজার কিটের আত্মতুষ্টির ভুল,
বিদেশ ফেরত কয়েক হাজারকে কোয়ারেন্টাইনে না নেয়ার ভূল, প্রথম দফার লকডাউন কার্যকর করতে না পারার ভুল।
গার্মেন্টস শিল্পীদের নিয়ে বিজিএমই’র বার বার ব্যাডমিন্টন খেলার ভুল,
স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় আর অধিদপ্তরের অর্বাচীণদের অজ্ঞতা আর সমন্বয়হীনতার ভুল।
সময় পেয়েও স্বাস্থ্য কর্মীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী না দিতে পারার ভুল,
স্বল্প আর মানহীন সুরক্ষায় করোনা যুদ্ধে নামিয়ে তাদের ব্যাপক হারে আক্রান্ত আর মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয়ার ভুল,
করোনা সাধারন সর্দি-জ্বর,এ ভাইরাস বাতাসে ভাসে না- মাস্ক পরার দরকার নেই- এমন ভূল ধারনা দেবার ভুল।
জানালা দিয়ে রোগী দেখার,দম বন্ধ করে রোগী পরীক্ষার মতো উদ্ভট পরামর্শ দেবার ভুল,মুষলধারের বৃষ্টিতে করোনা ধুয়েমুছে বিদায় হবে এমনতর উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক ধারণা দেয়ার ভুল,লকডাউনের সময় শুধু মাত্র একটা নিম্নমানের মাস্ক পরিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর মাঠ পর্যারের কর্মীদের দায়িত্বে নামিয়ে ব্যাপক সংক্রমন ঘটানোর ভুল,
সময় পেয়েও হাসপাতালগুলোকে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন,হাইফ্লো অক্সিজেন হিউমিডিফায়ার (হাইফ্লো নাজাল ক্যানুলা),আর আইসিইউ তে সজ্জিত না করার ভুল,অর্থহীন আবেগে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে দক্ষ জনবল আর প্রায়োগিক সুবিধা ছাড়াই দুই হাজারী আর এক হাজারী শয্যার শ্বেত হস্তী ফিল্ড হাসপাতাল তৈরীর ভুল।
স্বাস্থ্য প্রশাসন, আমলা প্রশাসন, সর্বোচ্চ প্রশাসন- সব খানে হয় ভুল,না হয় সমন্বয়হীনতা।

তাহলে করোনা সংকটের উত্তরনের কোন পথই কি আর খোলা নেই?
আমি তথা কথিত হার্ড ইমিউনিটির মত ধ্বংসাতক সমাধানের সমর্থক নই।

একটি মৃত্যু- পরিসংখ্যানে হয়তো নিছক একটা সংখ্যা। কিন্তু আপনার পরিবারের কাছে ? আপনার প্রিয়জনের কাছে ? প্রতিটি মৃত্যু ই যেন পৃথিবীর সব সুন্দর আর আনন্দকে বিবর্ণ করে ফেলা এক অন্তহীন দীর্ঘশ্বাস আর বুক ভরা নীল যন্ত্রনা ।
প্রয়োজন আমাদের অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত আর কুশিক্ষিত মানুষগুলোকে আরেকবার দুই তিন সপ্তাহের জন্য পরিপূর্ণ লক-ডাউনে নেয়া।
জীবন ও জীবিকার কথা আসতেই পারে কিন্তু ‘না জীবন - না জীবিকা’ এরকম একূল -ওকূল দুকূল হারানো ব্যবস্থার ফলাফল কী হবে জানি না।
তবে এটুকু জানি করোনা ভাইরাসের নিজের হাত-পা নেই। ওকে চলাফেরায় আমরাই সাহায্য করছি।আমরা মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য থেমে গেলে, করোনা-ভাইরাস ও ওর চলার শক্তি হারিয়ে ফেলবে। অর্থনীতি-খাদ্য সরবরাহ- এমন অনেক পার্শ্ব সমস্যার কথাও আসতে পারে- কিন্তু চিকিৎসা যখন অস্ত্রপচার তখন হোমিওপ্যাথি সান্তনা হতে পারে, সমাধান নয়।
আগুন নেভে দু’ভাবে- প্রথমত দমকল সময়মত এসে আগুন নিভিয়ে জান-মাল দুটোই রক্ষা করে।আর দমকল না এলে অথবা সময় মতো না এলে অথবা যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে এলেও আগুন নেভে, কিন্তু কখন নেভে জানেন? যখন পোড়ানোর আর কিছুই থাকেনা।করোনার আগুন আমরা কিভাবে নেভাবো এ সিদ্ধান্ত বড়দেরই নিতে হবে।

মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে।একথা মানতেই হবে, একাত্তরের পরে এদেশের মানুষের- কেবলমাত্র একজনের কথায় জীবন উৎসর্গের সংকল্প হারিয়ে গেছে- আদর্শ এখন শত- স্রোতী- নেতা সমর্থকও তাই। কল্পনা করি, এমন যদি হতো আওয়ামী লীগ প্রধানের আহ্বানে তার অনুসারীরা, বিএনপি প্রধানের ডাকে তাঁর সমর্থকেরা,এমনিভাবে চরমোনাই,আটরশী,হেফাজতে ইসলাম,আজহারী,কাকরাইলের তাবলীগ জামাত,ইত্যাদিরা যদি তাদের অনুসারীদের ঘরে থাকতে বলতেন- আর বাকী যে দু-চারটা এদিক ওদিক- তাদের জন্য তো বেনজীর সাহেবের লোকজন আছেনই।ফল হতো কী কিছু? জানি না।তবে এটুকু জানি এমন করতে পারলে হয়তো আমরাও ভিয়েতনাম, ভুটান, নেপাল কিম্বা শ্রীলংকার মতো সুফল পেতে পারতাম। আর তাহলে প্রিয়জন হারানোর বেদনা আমাদের বারে বারে নীল করতো না।
এই অধমের উপর একবার আস্থা রেখেই দেখুন না? আর তা না হলে যে কোনো শাস্তি- মাথা পেতে নেব।অবশ্য আমার বা আমাদের মতো তুচ্ছের শাস্তি হিসেবে প্রাণ বিসর্জনের গুরুত্ব তেমন আছে,এমন আত্মবিশ্বাসী আমি অন্তত নই।আমি জানি এই লেখার শুরুর সহযাত্রী পাঠকের অনেকেই এতক্ষনে আর আমার সাথে নেই - থাকবার কথাও নয়,প্রয়োজনও নেই।যাদের থাকবার কথা এরকম গুটিকয়েক থাকলেই চলবে- আমার শেষের কথাগুলো যে শুধু তাদেরই জন্য।

ফিরে যাই সেই ভুলের কথায়। এই করোনায় তাহলে সব কিছুই কি ভুলময়? মোটেই না। শত শত ভুলের মাঝেও আছে আশা জাগানিয়া আমার এমন বন্ধুরা- যারাই ‘ঠিক’। আজ ওরা ‘ঠিক’- বলেই, পূর্ণ পিপিই, দম বন্ধ করা মাস্ক, টাইট গগলসে তীব্র গরমে একটানা ৮-১২ ঘন্টা ডিউটি করেও ওরা অভিযোগহীন। আঁটো সাঁটো মাস্ক খুলে ডরমিটরীর ঘঁষা কাঁচের আয়নায় নিজের তোবড়ানো চেহারা দেখে ওরা নিজেরাই হেসে কুটি কুটি,বিলম্বিত এশার নামায শেষে বিবর্ণ ঠান্ডা-স্বাদহীন খাবারকে নৈশভোজ বানিয়ে,ক্লান্ত শরীরে ওরা প্রিয় ব্যান্ডের অনুচ্চারিত সংগীতের আবহে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ে- আত্মীয়হীন নিঃসঙ্গ- পরদিন সকালে আবার কাজে যেতে হবে যে!‘ঠিক’- ঐ তরুণ পুলিশ সদস্য, যে গভীর রাতে বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়েও ডিউটি পোস্ট ছেড়ে পাশের বারান্দার পিলারে সারাদিনের শ্রান্ত শরীরটাকে এক সেকেন্ডের জন্যও এলিয়ে দেয় না। ‘ঠিক-ঐ সদ্য বিসিএস উত্তীর্ণ তরুণ সহকারী কমিশনার যে, লক্কর ঝক্কর মিটসুবিশির কাঠ শক্ত সীটে রাত কাটনোর প্রস্তুতিতে কটুগন্ধের মশার কয়েলের মাঝেও দায়িত্ব পালনের প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে। এই মাঝ রাতে সঙ্গী বলতে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবীদের সাথে খুনসুটির দু’একটা টুকরো স্মৃতি মাত্র। ‘ঠিক’- পূর্ব রাজা বাজারের লকডাউনের ঐ স্বেচ্ছাসেবক, যে মাঝরাতে অর্বাচীণদের ফরমায়েশ মেটাতে বাড়ী বাড়ী হাকিমপুরী জর্দা মেশানো কাঁচা সুপারীর পান আর ডায়েট কোক পৌছে দিয়েও চোখে মুখে এতটুকু বিরক্তির ছাপ ফুটতে দেয় না। ‘ঠিক’- নিঃশঙ্ক ঐ মারকাজুল ইসলাম আর কোয়ান্টামের বীর সেনানীরা যাঁরা- পরিবার- প্রিয়জন প্ররিত্যক্ত করোনা রোগীর মৃতদেহ পরম যত্নে গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে হাতে কাঁধে বহন করে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার কাদা জল পেরিয়ে সসম্মানে কালান্তর করছে, দিনের পর দিন- প্রশ্নহীন- স্বীকৃতি হীন।‘ঠিক’- ঐ সহকারী কমিশনার আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যারা রিলিফের চাল-ডাল কাঁধে করে পৌছে দিয়েছেন তদবীরহীন গন্তব্যে। ‘ঠিক’- আমার সেই সাংবাদিক বন্ধু, যিনি এক রকম বিনা ব্যক্তিগত সুরক্ষায় দিন-রাত শহর-গঞ্জ চষে বেড়িয়েছেন করোনা কবলিত বাংলাদেশের খবর গৃহবন্দী দর্শক-পাঠকের কাছে পৌছাতে।সহকর্মীদের একের পর এক আক্রান্ত হওয়া কিম্বা পরপারে যাত্রা কিছুই থমকায়নি তাকে।
‘ঠিক’- আমার সেই সংবাদকর্মী সুহৃদ, যিনি খবরের পেছনে ছুটতে ছুটতে শেষ রাতে মেঝেতে এক টুকরো নিউজ প্রিন্ট বিছিয়ে শিয়রে ভিডিও ক্যামেরা রেখে শ্রান্ত শরীরে হাসপাতালের কোন নির্জন মেঝেতে তদ্রালু হয়েছেন মাত্র, মুহুর্তের জন্য আবার পরক্ষনেই সব ক্লান্তি ঝেড়ে আবারো ক্যামেরা হাতে সজাগ দৃষ্টি। ‘ঠিক’-ঐ সেনা সদস্য যিনি নিশুতি রাতে অজানা পথ পেরিয়ে ঐ পরিজনহীন চলৎশক্তিরহিত অশীতিপর বৃদ্ধার শীর্ণ কুটিরের অন্ধকার দরজায় চাল-ডালের বস্তা পৌঁছে দিয়েছেন খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুপ্রেরনায়- পরদিন ভোরে বৃদ্ধার ছানিপড়া চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু দেখার সৌভাগ্যও তার হয়নি।‘ঠিক’- সেই স্বাস্থ্য কর্মী যে, মৃত্যু ঝুঁকি তুচ্ছ করে করোনার গুহায় হানা দিয়ে- সংক্রমনের সেন্টিমিটার দূরত্বে গিয়ে সোয়াব স্টিক দিয়ে নাক আর গলার নমুনা সংগ্রহ করছে দিনের পর দিন।‘ঠিক’- ঐ পরিচ্ছন্নতা কর্মী যে মামুলী মাস্কে মুখ-নাক ঢেকে করোনার জীবাণুঘন আইসিইউ’র মেঝে পরিস্কার করে চলেছে দিনের পর দিন।‘ঠিক’- আমার সেই তরুণ চিকিৎসক বন্ধু যে করোনার সম্মুখ সমরে নিজেই আক্রান্ত হয়ে নির্জন মাঝরাতে একাকীত্বে- নিকষ কালো অন্ধকারে আইসোলেশন কক্ষে স্থির তাকিয়ে মামুলী একটা পালস অক্সিমিটারের কালো ‘এলইডি’ প্যানেলের কম্পমান নীল সংখ্যার দিকে।বাড়ীতে ওর শিশু কন্যা-স্ত্রী-বাবা-মা-ছোট ভাই।করোনায় হেরে যাবার বিলাসিতা যে ওকে মানায় না। তাই পালস অক্সিমিটারের নীল লেখা কাঁপতে কাঁপতে যখন তিরানব্বই-চুরানব্বই ছুঁই ছুঁই তখন- অজানা আশঙ্কায় নিজের অজান্তেই মোবাইল ফোনটার দিকে হাত যায়- ভাবে একবার ফোন করি স্যারকে- পরক্ষনেই থেমে যায়- এখন যে মাঝ রাত!

বন্ধুরা, এই লক্ষ কোটি ‘ভুলের’ মাঝে তোমরাই গুটিকয়েক ‘ঠিক’- তোমরা আছো বলেই হাসপাতাল আর লোকালয়ের অসহায়েরা আজো নিরাপদ। ভাঁড়ার ঘর ভর্তি করা চাল-ডাল-ময়দা, ফ্রীজ উপচানো মাছ-মাংস আর ডিমের সমারোহ, ঔষধের বাক্স ভর্তি ইভারম্যাকটিন, ডক্সিসাইক্লিন আর ডেক্সামেথাসনে- আর ঘরের কোনে সযত্নে আচ্ছাদনে পূর্ণ বোতল অক্সিজেন সিলিন্ডার জমিয়ে রাখা এই ঘৃণিত আমাদের ক্ষমা করো যীশুর ঔদার্যে।আর সুজাতা চক্রবর্তীর ঐ ‘ভুল- সবই ভুল’ গানটা নষ্টালজিয়ার খাতায় জমা রেখে সবাই মিলে চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে গাও- ‘মাগো, ভাবনা কেন? আমরা তোমার শান্তি প্রিয়, শান্ত ছেলে। তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি।আমরা পরাজয় মানবো না।’ লড়বো শরীরের শেষ বিন্দু ঘাম আর প্লাজমার শেষ ফোঁটা দিয়ে।

অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর পাভেল
অধ্যাপক (সার্জারী), টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ, বগুড়া
প্রাক্তন অধ্যক্ষ
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া এবং দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর;
এবং সাবেক সভাপতি, সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশ।
ই-মেইল: [email protected]
মোবাইল নং- 01711869325

___________________INFORMATION_______________

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়